বাবার চলে যাবার স্মৃতিকাতরতা ।। তৌহিদুল করিম মুজাহিদ

প্রবাসী বাংলাদেশ
শেয়ার করুন

দিন, মাস, বছর এভাবেই চলতে থাকবে জীবন। সময়ের আবর্তে চলতে চলতে হারিয়ে যায় কত স্মৃতিকাতর সময়। আবর্তনের এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে কিভাবে যেন পার হয়ে যাচ্ছে সময়, ভাবতেই বুকভাঙ্গা কান্না অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ে দু‘চোখ বেয়ে। গত ৮ এপ্রিল ২০২৪ (২৯ রমাদান ১৪৪৫) সোমবার দুপুর ২টার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে আমাদের পরিবারের সর্বশেষ সূর্য অস্তমিত হলো মধ্যাহ্নের আকাশে।

আম্মুর মৃত্যুর ঠিক ৩ বছর ৪ মাস ৯ দিনের মাথায় আব্বু এ্যডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন (অবঃ জোনাল এসপি, সিআইডি) আমাদেরকে ছেড়ে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে নশ্বর এ পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন। রেখে গেলেন এক ভাই, এক বোন, ১১টি সন্তান (৬ ছেলে ৫ মেয়ে), ১৬ জন নাতী-নাতনী, আত্মীয় স্বজন ও ভালোবাসার হাজারো মানুষ। যাদের স্মৃতির পটে আজীবন ভেসে থাকবে পরোপকারী মহান এ মানুষটির চেহারা মোবারক।

সেদিন বাদ আসর ঢাকার মিরপুর রূপনগর আবাসিক জামে মসজিদে আব্বুর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন বাদ ফজর ঝিনাইদহ আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ২য় জানাজা এবং গ্রামের বাড়ি গবরায় সকাল ৯ টায় ৩য় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আব্বু ছিলেন কোমল হৃদয়ের একজন অসাধারণ মানবিক মানুষ। পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের বাইরে আরও কত শত মানুষের জীবনের নানা অধ্যায়ে তাঁর মহানুভবতার উদাহরণ রয়েছে, যা সংখ্যায় গণনা করা প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন অঞ্চলে মামলার তদন্ত করতে গেলে সেখান থেকে কত যে এতিম অসহায় মানুষকে এনে আমাদের সাথে রেখে মানুষ করেছেন, সে সংখ্যাও হয়তো আমাদের মনেই নেই।

আব্বু সবসময় বলতেন, আল্লাহ আমাকে ১১টি সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব দিয়েছেন, এদের সাথে আর এক-দু’টি মানুষ যোগ হলে তারা কি আটকে থাকবে? সত্যিই তাই, তারা কখনোই আটকে থাকেনি। আমাদের সাথে নিজ ভাই-বোনদের মতো মানুষ হয়ে আজ তারা স্ব স্ব কর্মস্থলে ব্যস্ত আছেন।

আব্বুর অসাধারণ পান্ডিত্ব ও মনোমুগ্ধকর আলোচনা কখনো ভোলার নয়। আমার সুয়োগ হয়েছিল আব্বুকে নিয়ে এক ঘন্টার একটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম রেকর্ড করার। এটি দেখে অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এখন বার বার মনে হয় আরো কিছু রেকর্ড করে রাখতে পারলে, অজানা অনেক কথা আমরা জেনে রাখতে পারতাম, যা পার্থিব এ জীবনের জন্য অনেক বেশী শিক্ষনীয় হিসেবে বিবেচিত হতো। এ বিষয়গুলো নিয়ে আগামীতে হয়তো ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকবো ইনশা‘আল্লাহ।

আব্বুর মৃত্যুর আগমূহুর্তগুলো ছিলো অবিস্মরণীয়। শেষ এক মাস যাবৎ আমি আব্বুর পাশেই ছিলাম। কিন্তু শেষ রাতে আমাদের মেজ আপু রাতে আব্বুর পাশে থেকে গেলেন। আব্বুর পাশে বসে আপুরা সারারাত অনেক দোয়া করলেন। সকাল থেকে আমি আর আমাদের সেজ ভাই ডাঃ সালেক আব্বুর জমে থাকা কফ বের করতে অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ঔষধ, নেবুলাইজ, সাকার ম্যাসিন আর ম্যানুয়াল পদ্ধতি-সহ সকল প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি দ্রুত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ আলালকে কল দিলাম এবং ঔষধ তৈরী করতে বললাম।

ডাঃ সালেক ও তার সহধর্মীনী ডাঃ ফাতেমা জাহরাকে আব্বুর পাশে রেখে আমি দ্রুত ঔষধ আনতে গেলাম। ঔষধ নিয়ে রওয়া হবো ডাক্তার সাহেব বল্লেন যোহরের জামাত দাড়িয়ে গেছে নামাজ পড়ে যান। মন বাসার পানে ছুটে চললেও নামাজ না পড়ে যেতে পারলাম না। নামাজ শেষ করতেই বাসা থেকে ফোন ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসেন। আর এক মূহুর্ত দেরী না করে ঝড়ের গতিতে মটরসাইকেল চালিয়ে বাসায় পৌছলাম।

আব্বুর পাশে গিয়ে দেখি ডাঃ সালেক পাগলের মত আব্বুর বুকে পাম্প করছে, যদি আব্বুর হৃদপিন্ডের কম্পন ফিরে আসে সে আসায়। পাশে বসে থাকা সালেকের স্ত্রী আব্বুর পালস পরীক্ষা করে জানালো আব্বু আর নেই। আমি কোনভাবে সালেককে থামালাম। কি হাসিমাখা মুখ আব্বুর। মনে হচ্ছে সবে মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছেন। একটু পরেই হয়তো আবার জেগে উঠবেন।

ক্ষণিকের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মৃত্যুর মুহুর্তটি নিয়ে সালেকের সহধর্মীনী ডাঃ ফাতেমা বলছিল, আব্বু ছাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলেন, মনে হলো মালাকুল মাউত দেখছিলেন। এরপর পশ্চিম দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন এবং আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেন। কি অভাবনীয় ছিল আব্বুর চলে যাওয়া।

আব্বুকে যখন গোছলের জন্য মসজিদে নিয়ে গেলাম, মসজিদের খাদেম জানালেন শেষ ১০ বছর আব্বু এই মসজিদে ইতিকাফ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আজ এখানে রমজানের শেষ বিজোড় দিনে আব্বুর শেষ গোসল করাতে হচ্ছে। এই খাদেমের ভাষ্যমতে বহু মানুষের শেষ গোসল দেয়ার সুযোগ উনি পেয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আব্বুর শরীরের মত এত পরিস্কার দেহ উনি আর একটিও পান নি।

আব্বুর মুখের হাসিটি শেষ পর্যন্ত ছিল অবিচল। আমরা আব্বুকে যখন কবরে নামালাম তখনও মনে হচ্ছিল আব্বু যেন ঘুমিয়ে আছেন। আব্বুর দাফন সম্পন্ন করে পারিবারিক দ্বায়িত্ব পালন শেষে আব্বু-আম্মুর জন্য উমরাহ করে লন্ডনে ফিরে আসলাম। কিন্তু আব্বুর সেই হাসিমাখা মুখ কোনভাবেই যেন আমার চোখ থেকে সরছে না। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি আব্বু আমাকে আব্বুজি বলে ডাক দিবেন।

আব্বুর এমন আদর-ভালোবাসা ও দোয়া এ জীবনে আর তো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আব্বুকে আম্মুর সাথে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে রাখুন আর আমাদেরকে তাদের সাথে জান্নাতে মিলিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। সন্তানের নেক আমল পিতা-মাতার কাজে লাগতে পারে। আল্লাহপাক আমাদেরকে যেন এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালনের তৌফিক দান করেন।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা নেক বান্দার মর্তবা জান্নাতে বুলন্দ করবেন। সে বলবে, ‘হে আমার রব এটা আমার জন্য কিভাবে হলো? তিনি বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তেগফারের কারণে।’ (হাদিসে কুদসি: ১২১)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থাক এবং বলো, ‘হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছিলেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)

আবু সাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সাঃ) এর কাছে বসেছিলাম। এমতাবস্থায় বনু সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর কাছে এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মা-বাবা‘র ইন্তেকালের পরেও কি তাদের কোনো হক বাকি থাকে, যা আমার প্রদান করা উচিত? রাসূল (সাঃ) বললেন হ্যাঁ, তাদের জন্য দোয়া করবে, ক্ষমা চাইবে, তারা যদি কোনো ওসিয়ত করে গিয়ে থাকেন তবে তা পূরণ করবে। যাদের সাথে মা-বাপের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল, তাদের আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখবে এবং মা-বাবা‘র বন্ধু-বান্ধবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।’ (আবু-দাউদ)

হে আল্লাহ্ আপনি আব্বু-আম্মুকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নিন এবং আমাদেরকে তাদের দেখানো “দ্বীনের পথে” অটুট থেকে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন ইয়া রাব্বুল আলামিন। আব্বু-আম্মুর রুহের মাগফেরাতের জন্য আমি আপনাদের সকলের কাছে দোয়া চাই।

* তৌহিদুল করিম মুজাহিদ ব্রিটেনের জনপ্রিয় ইসলাম চ্যানেল বাংলার হেড অব প্রোডাকশন এবং চ্যানেল এস টিভির সাবেক হেড অব চ্যারিটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *