বাইডেনের সঙ্গে নেতানিয়াহু লড়াই বাধাতে চায়, এবার তাঁর রক্ষা নেই

আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আলন পিনকাস

জালিয়াতি করে গোটা জাতিকে কীভাবে যুদ্ধের মধ্যে টেনে আনা হলো? একই কায়দায় কীভাবে একটি পরাশক্তিকে (মিত্র) যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করা হলো? একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব থেকে কীভাবে একটা দেশকে একঘরে করে ফেলা হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে জিজ্ঞাসা করো। কারণ, এই সব বিষয়ের ‘মেধাস্বত্ব’ নেতানিয়াহুর নামে।

গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষ থেকে নেতানিয়াহু পরিষ্কারভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর পথ খুঁজছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৭২৮ নম্বর প্রস্তাবটি (যেখানে গাজায় ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির’ দাবি তোলা হয়েছে) নেতানিয়াহুর সেই পূর্বপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সর্বশেষ অজুহাত। (উল্লেখ্য, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাসের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছেন)।

এই বক্তব্য আপনাদের কাছে অদূরদর্শী বলে মনে হতে পারে। তার কারণ অবশ্য অনেক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল খুবই ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ সামরিক সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল, কূটনৈতিক ছাতা দিয়ে ইসরায়েলকে আগলে রাখে যুক্তরাষ্ট্র, ৭ অক্টোবরের বড় বিপর্যয়ের পর ইসরায়েলকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদে জড়ানোর পেছনে নেতানিয়াহুর কাছে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বড় প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে খাঁটি জালিয়াতি। কারণ, তিনি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটটার একটা মনগড়া বয়ান তৈরি করতে চান। যুদ্ধের দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চান। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়া, যাতে রাজনৈতিক মীমাংসা অসাধ্য হয়।

নেতানিয়াহুর এই ভাষ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর নিছক একটা পরাজয়। ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী এই পরাজয় এড়াতে পারত এবং গোয়েন্দাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। নেতানিয়াহু মনে করেন, এখন সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। গাজায় আক্রমণ শুরুর পর বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ওপর এটা তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই বয়ান অনুসারে, একমাত্র নায়কোচিত নেতানিয়াহুই যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন এবং মার্কিনদের প্রতারণা প্রতিরোধ করতে পারেন।

নতুন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাইরে থেকে ‘চাপিয়ে’ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এই বয়ানের মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু তাঁর চরম ডানপন্থী জোট ও বন্ধুদের শান্ত রাখতে চাইছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আসছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে মূল মনোযোগের কেন্দ্রে রেখে নেতানিয়াহু নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন।

দ্বিতীয় কারণটি আরও সমসাময়িক ও বাস্তবসম্মত। ‘পুরোপুরি বিজয়’ ও ‘হামাসের নির্মূল’—এই দুটি লোকপ্রিয় স্লোগান নেতানিয়াহু নিয়মিত আওড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তা অর্জনে নেতানিয়াহু ব্যর্থ হয়েছেন। সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই বাইডেনকে বলির পাঁঠা করে তুলতে চাইছেন তিনি।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যে প্রস্তাবে দ্রুত যুদ্ধবিরতির দাবি জানানো হয়েছে, সেই প্রস্তাবে ১৪টি সদস্যরাষ্ট্র সমর্থন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটিতে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এ ঘটনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে আরও সূক্ষ্মভাবে বললে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদ বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন নেতানিয়াহু।

কেউ যখন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ উপেক্ষা করবে, দেশটির প্রেসিডেন্ট শুভচিন্তার উপদেশ খারিজ করে দেবে, তাঁকে তো এর জন্য মূল্য দিতেই হবে। অতি সম্প্রতি অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে একঘরে হয়ে যাচ্ছে এবং দেশটি তার গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিপদের মুখে রয়েছে।

জানুয়ারি মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে পরিচালিত ইসরায়েলের ব্যাপারে নেতিবাচক মূল্যায়ন শুরু করেছে। নেতানিয়াহুর সঙ্গে আর মিত্রের মতো আচরণ করা হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি ইস্যুতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে কমেছে। যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা নিয়ে পরিকল্পনার ব্যাপারে খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন নেতানিয়াহু।

এ বিষয়েই ওয়াশিংটনের কাছে গুরুতর সন্দেহের জন্ম হয়েছে যে গাজা যুদ্ধ প্রলম্বিত করে নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক টিকে থাকাটাকেই নিশ্চিত করতে চায়। নিরাপত্তা পরিষদে সাম্প্রতিক প্রস্তাব থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, নেতানিয়াহু যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন এই ফাটল বাড়তেই থাকবে।

এ মুহূর্তে ইসরায়েল যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, সেই বিবেচনায় তেল আবিবের সঙ্গে ওয়াশিংটনের তিনটি বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এক. মানবিক সহায়তা। দুই. বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মৃত্যু। তিন. গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন। এই মতপার্থক্যগুলো নিরসন করা গেলে, নেতানিয়াহু ও বাইডেনের মধ্যে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হতে পারত, কিন্তু সেটা হওয়ার নয়।

প্রকৃতপক্ষে জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা এবং এখন বাইডেন—সব কটি প্রশাসনের সঙ্গেই নেতানিয়াহুর বিরোধে জড়ানোর রেকর্ড রয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, ১৯৯০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর নাক গলানোর প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেতানিয়াহুর বর্তমান সম্পর্ককে একটা সন্ধিক্ষণ বলা যায়। এই সম্পর্ক এখন দুই দিকে মোড় নিতে পারে। নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরানো অথবা নির্বাচনে তাঁর পরাজয়। অথবা ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় ধরনের পুনর্মূল্যায়ন আসতে পারে।

নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে মিত্র হিসেবে দেশটির মূল্যবোধ বড় প্রশ্নের সম্মুখীন। হয়তো কিছুদিন সময় লাগবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই সরল উপলব্ধিতে পৌঁছাবে যে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হতে পারে, কিন্তু নেতানিয়াহু কোনোভাবেই তাদের মিত্র নয়।

* আলন পিনকাস ২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কে ইসরায়েলের কনসাল জেনারেল হিসেবে কাজ করেছে, বর্তমানে হারেটজের কলাম লেখক। গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে প্রথম আলো কর্তৃক সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *