বাইডেনের বিতর্ক দেখে তার জেতার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন ডেমোক্র্যাটরা

আমেরিকা সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

জো বাইডেনের মিত্ররা চেয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার রাতে বিতর্কের মঞ্চে তিনি আরও জোরালো সওয়াল ও শক্তি প্রদর্শন করুন যাতে ৮১ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাটের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা নিয়ে যাবতীয় প্রশ্ন নস্যাৎ হয়ে যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির বৃহত্তম মঞ্চে শুভানুধ্যায়ীদের সাধারণ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি বাইডেন।

দীর্ঘ ৯০ মিনিটের উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্কের শেষে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টের সমর্থক ও মিত্ররা (দলের কুশলী ও ভোটার নির্বিশেষে) হতাশ ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কেননা এই বিতর্কে বাইডেন হোঁচট খেয়েছেন, অস্বস্তিকরভাবে বিরতি নিয়েছেন এবং তার কথা বলার ধরণ ছিল বেশ নিচু স্বরে যার ফলে অনেকের তা বুঝতে কষ্ট হয়েছে প্রায়শই। বিতর্কের মঞ্চে বাইডেনের এই উপস্থাপনার পরই তার মিত্ররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

প্রকাশ্যে ও একান্তে ডেমোক্র্যাটরা প্রশ্ন তুলেছেন, ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বাইডেনকে দল সরাতে পারে বা সরানো উচিত কিনা।

সাবেক ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্লেয়ার ম্যাকক্যাসকিল এমএসএনবিসি-কে বলেন, “এই মুহূর্তে আমার একারই শুধু মন ভেঙে যাচ্ছে না। আজ রাতে অনেক মানুষই এই অনুষ্ঠান দেখেছেন এবং জো বাইডেনের জন্য তারা মর্মাহত। আমি জানি না, একে সমাধান করতে কিছু করা যেতে পারে কিনা।”

এই মুহূর্তে বাইডেনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই ক্ষতি স্থায়ী কিনা। নির্বাচনের এখনও চার মাসের বেশি সময় বাকি। অনেক ভোটার এখনও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত নন। প্রেসিডেন্ট ও তার মিত্ররা লক্ষ লক্ষ ডলারের উপর বসে রয়েছেন যা বিজ্ঞাপন ও সুইং-স্টেট খাতে ব্যয় করা হবে আগামীতে।

বাইডেনের ২০২৪ সালের পুনর্নিবাচনের প্রচারণা অনেকটা জুয়াবাজির উপর নির্ভর করে রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, ভোটাররা শেষ পর্যন্ত গোটা জীবন ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ৮১ বছর বয়সী নেতাকে সমর্থন করবেন। এই ধরনের দায়বদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাইডেনের দল জোর দিয়েছে, ওয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন রুখতে তিনি নজিরবিহীন অবস্থান নিয়েছেন, যেমনটা চার বছর আগে তিনি নিয়েছিলেন।

তারা অনেক আগে থেকেই ভবিষ্যতবাণী করেছে যে, ট্রাম্পের বিশৃঙ্খল নেতৃত্বের কথা পর্যাপ্ত পরিমাণে স্মরণ করার পর বাইডেনের রাজনৈতিক জোট শেষ পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টকেই গ্রহণ করবে। তবে, বিতর্কে বাইডেনের দুর্বল উপস্থাপনার পর এমন আত্মবিশ্বাস ও আস্থা ধাক্কা খেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস বিতর্কের পর সিএনএন-এ বলেন, “শুরুটা ধীর গতিতে হয়েছে। এটা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি এই বিষয়টা নিয়ে তর্ক করতে চাই না। আমি নভেম্বরের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি। আমাদের সকলের (সমষ্টিগত) জীবদ্দশায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে আমি কথা বলছি।”

বাইডেন-ট্রাম্পের বিতর্কে প্রধান কিছু বক্তব্য

আটলান্টায় বৃহস্পতিবার সিএনএন প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কঠিন প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকটি মূল বিষয়ের মুখোমুখি হন। বিতর্কটি দুই প্রার্থীর মধ্যে মতপার্থক্যের রাত হিসাবে প্রমাণিত হয় যারা খুব কম বিষয়ে একমত এবং বেশিরভাগ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। মতবিরোধের মূল বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, প্রজননগত অধিকার, পররাষ্ট্রনীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকির বিষয়াবলী।

মুদ্রাস্ফীতি

মডারেটর জেক ট্যাপারের প্রথম প্রশ্ন ছিল মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে, যা তিনি বলেন অনেক আমেরিকান ভোটারের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগ।

বাইডেন সমস্যাটির জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করে বলেন, তিনি তার পূর্বসূরি থেকে একটি ব্যর্থ অর্থনীতি পেয়েছেন। বাইডেন বলেন, “আমাদের যা করতে হয়েছিল তা হল সবকিছু আবার একত্রিত করার চেষ্টা করা।” বাইডেন তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করার মাধ্যমে এবং অনেক আমেরিকান অত্যাধিক খরচের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এটি স্বীকার করার মাধ্যমে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেন।

বাইডেন তার সমাপনী বিবৃতিতে বলেন, “আমরা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে এবং জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।”

ইতিমধ্যে, ট্রাম্প তার অর্থনৈতিক সাফল্যগুলোর পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারী পরিচালনার বিষয়ে প্রশংসা করেন। কিন্তু, অর্থনৈতিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় ২০১৭ সালে ট্রাম্প স্বাক্ষরিত অত্যধিক কর হ্রাসের ফলে কিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে ট্রাম্প যেরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কাছাকাছি কোনও উন্নতি হয়নি।

মে মাসের গ্যালাপ জরিপে ১০ জনের মধ্যে ৩ জন আমেরিকান বলেন, অর্থনীতি ছিল দেশটির মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তবে এতে আরও অনেক অর্থনৈতিক সমস্যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

গর্ভপাত

বিতর্কে প্রজননগত অধিকারের বিষয়ও উঠে আসে। ট্রাম্প বলেন তিনি গর্ভপাতের ঔষধগুলির ব্যবহার অবরোধ করবেন না। প্রেসিডেন্ট হিসাবে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে তিনজন বিচারপতি নিয়োগ করেন যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ২০২২ সালে গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে বাতিল করেন। এই সিদ্ধান্ত রাজ্যগুলিকে গর্ভপাতের উপর নিষেধাজ্ঞামূলক নিয়ম আরোপ করার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বিতর্কের সময় ট্রাম্প বলেন, তিনি ধর্ষণ, অনাচার বা মায়ের জীবন ঝুঁকির ক্ষেত্রে গর্ভপাতের বিরোধিতা করবেন না। ট্রাম্প বিলম্বিত গর্ভপাত সম্পর্কে কিছু মিথ্যা দাবিও করেন।

অন্যদিকে, বাইডেন প্রজননগত অধিকারের জন্য তার দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “আমি নির্বাচিত হলে, আমি রো বনাম ওয়েড আইনটি পুনঃস্থাপন করব।” তিনি আরও বলেন তিনি বিলম্বিত গর্ভপাতের বিরোধিতা করেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

রাশিয়ান সামরিক বাহিনী ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে একটি পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করে। তখন প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাইডেনের মেয়াদের প্রায় দুই বছর হয়েছে। বিতর্ক চলাকালীন, বাইডেন এবং ট্রাম্প যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিবৃত শর্তাবলীর বিরোধিতায় একমত হতে দেখা যায়। তবে ট্রাম্প তার দাবি দ্বিগুণ করে বলেন, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তবে যুদ্ধটি প্রথমত শুরুই হত না। যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে যত সাহায্য দিয়েছে তা নিয়েও সমালোচনা করেন তিনি।

বাইডেন বলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে নেটো থেকে বের করে নিবেন এবং যুদ্ধ সম্প্রসারণের ঝুঁকি নিবেন। আর রাশিয়ার নেতার বিষয়ে বাইডেন বলেন, “সত্য হল পুতিন একজন যুদ্ধাপরাধী।”

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধকে ঘিরে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নেও বাইডেন এবং ট্রাম্প বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ট্রাম্প বাইডেনের যুদ্ধ পরিচালনার সমালোচনা করে বলেন, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েল আরও বেশি কিছু করার বাইডেনের দাবির কারণে বাইডেন “ফিলিস্তিনিদের মতো হয়ে উঠেছেন”। ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুরও সমালোচনা করেন। এপ্রিলের এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন যে তার উচিত ছিল ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলা প্রতিরোধ করা যা সংঘর্ষটির জন্ম দিয়েছে।

বাইডেন তার বিরুদ্ধে সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করেন যে তার প্রশাসন ইসরায়েলের কাছ থেকে কিছু অস্ত্র সরিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, “আমরা ইসরাইলকে তাদের প্রয়োজনীয় সকল অস্ত্র দিচ্ছি।” বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য তার তিন-পর্যায়ের প্রস্তাবের রূপরেখাও তুলে ধরেন, এবং এখনও কোনও চুক্তি হয়নি তার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দায়ী করেন।

এ নিয়ে বিতর্ক করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, “ইসরায়েলই এর পিছে দায়ী। আর আপনার উচিত তাদের কাজ শেষ করতে দেওয়া।” বাইডেনের প্রতিক্রিয়া: “আমি এত বোকামির কথা কখনও শুনিনি।” গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয় গত অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার ফলে যাতে ইসরায়েলি মতে ১,২০০ জন নিহত হয়, এবং প্রায় ২৫০ জন জিম্মিকে বন্দী করা হয়। গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণে ৩৭,৭০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। অঞ্চলটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুসারে তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

বাইডেনের প্রচারণার একটি কেন্দ্রীয় অংশ এবং বিতর্কের সময় তার কথা বলার বিষয়গুলি হল ট্রাম্পকে আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসাবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা। ট্রাম্পকে মে মাসে একটি ঘুষ দেয়া সংক্রান্ত মামলায় ৩৪ টি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যা তাকে দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রথম প্রধান-দলীয় প্রার্থী করে তোলে। তিনি ৬ জানুয়ারী ইউএস ক্যাপিটলের বিদ্রোহের ঘটনায় তার ভূমিকার জন্য আইনি অভিযোগের মুখোমুখি।

বাইডেন বিতর্কের এক পর্যায়ে ট্রাম্পকে উল্লেখ করে বলেন, “মঞ্চে একমাত্র ব্যক্তি যিনি একজন দোষী সাব্যস্ত অপরাধী, সেই ব্যক্তি হলেন যাকে আমি দেখছি।” বাইডেন পরবর্তী সময়ে বলেন, “আপনার নৈতিকতা একটি রাস্তার বিড়ালের সমান।” ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের বিষয়ে তার মিথ্যা দাবির পুনরাবৃত্তি করেন এবং ক্যাপিটলে ২০২১ সালের আক্রমণের তীব্রতা বাস্তবের তুলনায় কম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। তিনি আরও বলেন, তিনি ভবনটি রক্ষার জন্য ন্যাশনাল গার্ড সৈন্যদের সরবরাহ করার জন্য আগাম প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

আরেক সঞ্চালক ডানা ব্যাশ চাপ দিলে ট্রাম্প বলেন, তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করবেন যদি এটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। তবে, এই রিপাবলিকান প্রার্থী এই বছর আগের দিকে জোর দিয়ে বলেছেন, ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে প্রতারণা করবে এবং যে কোনও নির্বাচনে যা তিনি জিতবেন না তা জালিয়াতি হতে পারে।
– ভয়েস অফ আমেরিকা (ভিওএ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *