বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনা

যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকের আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, পৃথিবীতে বর্তমানে সাত হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে, এর মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান ৭ম। আর বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ২৭ কোটির অধিক। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নির্দেশ দিলে তা অগ্রাহ্য করে এই অঞ্চল তথা বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের ভাষার অধিকার। সেদিন সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা সংগ্রামীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর-সহ আরও অনেকে শহীদ হন। এতে সারাদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালের ৭মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। এই আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ভাষা আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে ইস্ট লন্ডনে ভ্যালেন্স রোডের উডহাম সেন্টারে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত। সংগঠনের ট্রেজারার খান জামাল নুরুল ইসলামের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা ও বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের জনপ্রিয় কাউন্সিলার আবু তালহা চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহার শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন করেন সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকের উপদেষ্টা প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট কে এম আবুতাহের চৌধুরী। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক খালেদ মাসুদ রনি, ডাঃ গিয়াস উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আব্দুল হাই, শেখ ইসতাব উদ্দিন, এ কে এম হান্নান, আফসার উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন শাওন, মো: আব্দুল মুকিত, মইজুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ আহবাব মিয়া, হাজী আব্দুর রহিম বেগ, ফয়সল আহমদ প্রমুখ।

প্রধান অতিথি মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে অবিচ্ছেদ্য উল্লেখ করে বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠার কারণে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

কাউন্সিলার আবু তালহা চৌধুরী বিলেতে জন্মনেয়া আমাদের সন্তানদের ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা শিক্ষা দেয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, যেসব মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার অভ্যাস তৈরি করেছে, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি বেড়ে যায়। বহুভাষায় যোগ্যতা অর্জন বহুভাবে সমৃদ্ধি বয়ে আনে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুতদের স্কুল-কলেজে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে জার্মান, ফ্রেঞ্চ বা ইতালিয়ান না শিখে বাংলা শিক্ষা নেয়ার প্রযোজনীয়তা বিশ্লেষন করেন।

আবু তালহা চৌধুরী টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বর্তমান নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমানের নেতৃত্বে মাতৃভাষার বিকাশে নেয়া ৮০০ হাজার পাউন্ডের কর্মসূচি তুলে ধরেন।

মূল প্রবন্ধে সাংবাদিক সাঈদ চৌধুরী উল্লেখ করেন, অভিবাসিদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ায় ব্রিটেনে বাংলা ভাষাও গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্রিকলেন বাংলা টাউন বিলেতের মানচিত্রে একটা আইকনের মর্যাদা পেয়েছে। ইস্ট লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনের সাইনবোর্ডে বাংলায় স্বাগত জানানো হয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড এবং মসজিদ, দোকানপাট, হাসপাতাল, পার্ক সবখানে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। নিউহাম, ওয়েস্টহাম, ক্যামডেন, বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার, কার্ডিফ ও নিউক্যাসলের মতো এলাকাগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নাম বাংলায় লেখা আছে।

প্রবন্ধে আরো বলা হয়, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আলোচনা ও জাতীয় দিবসগুলো বাংলা চর্চার প্রধান অবলম্বন। বাংলা সংবাদপত্র এবং রেডিও-টেলিভিশন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু স্কুল, ওসমানী স্কুল, কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার, আলতাব আলী পার্ক, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ইত্যাদি বাঙ্গালি জাতি ও বাংলা ভাষার পরিচয় ধারণ করে আছে। ড্রাইভিং টেস্টের থিওরি পরীক্ষায় এবং এনএইচএস হাসপাতালগুলো ভয়েস ডিরেকশনে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় নির্দেশনা চালু হয়েছে। স্থানীয় স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ও সিলেটি ভাষা তালিকাভুক্ত হয়েছে। অসংখ্য লাইব্রেরিতে এখন বাংলা বই গুরুত্বের সাথে রাখা হয়। এসকল ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তার পাশাপাশি আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।

বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকের ট্রেজারার খান জামাল নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানান। তিনি শিশুদের বাংলা শিক্ষায় অভিভাবকদের এগিয়ে আসারও আহবান জানান।

সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত মাতৃভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় অংশ গ্রহনের জন্য উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

সংগঠনের উপদেষ্টা কে এম আবুতাহের চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রবাসে বাংলা ভাষার চর্চা বৃদ্ধির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানদের সাথে বাংলায় কথা বলা ও বাংলা শিখানোর উপর জোরদেন। তিনি মাতৃভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *