বাংলাদেশে কয়েক লাখ মোবাইল ফোনের একই আইএমইআই হয় কীভাবে?

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সৌমিত্র শুভ্র বিবিসি

যারা মোবাইল ফোন প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখেন তাদের সবাই-ই জানেন, বিশ্বের প্রত্যেকটি হ্যান্ডসেটের জন্যই একটি আলাদা নম্বর থাকে যাকে আইএমইআই নম্বর বলা হয়। ফোন চুরি বা হারিয়ে গেলে সেই নম্বর ধরেই অনুসন্ধান চালানো হয়। প্রতিটি হ্যান্ডসেটের জন্য নাম্বারটি ইউনিক বা স্বতন্ত্র হওয়ার কথা থাকলেও নাম্বার ক্লোন বা পরিবর্তনের কথা শোনা যায় প্রায়ই। যদিও পরিমাণে সেটি খুব বেশি নয়।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরে এক সেমিনারে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি’র চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, বাংলাদেশে একটি আইএমইআই নম্বর দিয়েই দেড় লাখের বেশি ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে।

ফোনগুলোর সবই নকল বলেও জানান তিনি। তবে, একটি টেলিকম অপারেটর কোম্পানির সাবেক চিফ টেকনোলজি অফিসার এ কে এম মোর্শেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এখন দেড় লাখ হলে সংখ্যাটা আগের তুলনায় কমেছে। কারণ, “কয়েক বছর আগে কোনো একটি অপারেটরের নেটওয়ার্কে সচল থাকা প্রায় আট লাখ সেলফোনের আইএমইআই কোড ছিল একটিই।” কিন্তু, কীভাবে এতো বিপুল সংখ্যক মোবাইল ফোন একই আইডেন্টিটি বা পরিচয় পেয়েছিল?

আইএমইআই কী?

আইএমইআই ডট ইনফো ওয়েবসাইটের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, আইএমইআই বা ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি নম্বর একটি ১৫ ডিজিটের নম্বর, যেটি কোনো মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি করার সময় এর মধ্যে প্রোগ্রাম করা থাকে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ১৭ ডিজিটও হতে পারে। এই নম্বরটি মূলত মোবাইল হ্যান্ডসেটটির পরিচয় বহন করে। এই নম্বরের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়, কোন ফ্যাক্টরিতে এটি তৈরি হয়েছে এবং কোন এলাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া আইএমইআই নম্বরের মধ্যেই ফোনটির জন্য একটি স্বতন্ত্র সিরিয়াল নম্বর এবং পুরো নম্বরটি যাচাই করার জন্য একটি সংখ্যা দেয়া থাকে।

টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এ কে এম মোর্শেদ বলেন, “গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস্ বা জিএসএম-এর ডিজাইন করাই হয়েছে এমনভাবে যে একটা আইএমইআই’র অ্যাগেইনস্টে একটা মোবাইল নাম্বারই থাকবে। যাতে প্রত্যেককে আইডেন্টিফাই করা যায়।”

সাধারণত হ্যান্ডসেট হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে এই আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে হ্যান্ডসেটটির অবস্থান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। এছাড়া নতুন ফোন কেনার সময় আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে জানা যেতে পারে ঐ ফোনটি এর আগে কখনো ব্যবহার করা হয়েছে কি না। ফোনে *#০৬# ডায়াল করলে আইএমইআই নম্বর দেখাবে। এবার আইএমইআই ডট ইনফো ওয়েবসাইটে গিয়ে নম্বরটি বসিয়ে এবং ‘চেক’ বাটন চাপতে হবে। পরের পেইজে বিস্তারিত তথ্য আসবে।

কীভাবে আইএমইআই জালিয়াতি হয়?

আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো বৈধ নম্বরকে ‘ক্লােন’ (অনুলিপি) করা হয়ে থাকে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে সাধারণত দুই ধরনের ক্লোনিং হয় বলে জানাচ্ছেন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন। একটা সিম ক্লোনিং, অন্যটা আইএমইআই ক্লোনিং।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের এই পরিচালক বিবিসি বাংলাকে বলেন, এতে ফোনের আইডেনটিটিটা ডুপ্লিকেট(নকল) হয়ে যায়। এর জন্য বিশেষ সফটওয়্যার আছে। তবে, বেশ কিছু টেকনিক্যাল স্টেপ থাকায় সাধারণ মানুষ সহজেই এটি করতে পারে না,” বলেন তিনি।

অতীতে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কিছু অবৈধ কারখানায় অভিযান চালায় যেখানে নকল হ্যান্ডসেট তৈরি করা হতো। ডিএমপি’র সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “২০২০ সালের অগাস্টে আমরা একটা নকল ফ্যাক্টরির সন্ধান পাই যেখানে স্যামসাং এবং নোকিয়া ফোনের আদলে হ্যান্ডসেট তৈরি করা হতো।”

এরপর এমন আরো কয়েকটি অভিযান পরিচালনার কথা জানান তিনি। বলেন, স্থানীয়ভাবে হয়তো একটা দোকানের মধ্যে বা দুইটি রুম ভাড়া নিয়ে কাজ চলতো সেসব ‘ফ্যাক্টরিতে’। বিদেশ থেকে হ্যান্ডসেটের যন্ত্রাংশ কিনে এনে সংযোজন করা হতো। ওই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জুড়ে দেয়া হতো ক্লোন করা আইএমইআই নম্বর। “আইএমইআই জালিয়াতিটা বেশি দেখা যায় বাটন বা ফিচার ফোনগুলোতে। স্মার্ট ফোনে সংখ্যাটা কম,” বলেন মি. সরকার।

তবে, বেশি সংখ্যায় ফোনের আইডেনটিটি নাম্বার মিলে যাওয়ার আরও কিছু সম্ভাব্য পন্থার কথা বলে বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক মইনুল হোসেন একটা ধারণা উপস্থাপন করেন, “বাইরে থেকে চোরাই পথে অপরিচিত বা অনামী ব্র্যান্ডের যে হ্যান্ডসেটগুলো আসে সেগুলো হয়তো এভাবেই ম্যানুফাকচারড্ যে বাই ডিফল্ট একটাই আইএমইআই নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
নইলে, “ভিন্ন ভিন্ন নাম্বারও তো ব্যবহার করতে পারতো। দেড় লাখ সেট এক নাম্বার দিয়ে ক্লোন করবে কেন?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

বলেন, কোনো ‘বিদেশি’ কোম্পানির কাছ থেকে যন্ত্রাংশ কেনা হলে তারাই তেমন সফটওয়্যার বা প্রয়োজনীয় ডিভাইস সরবরাহ করে থাকতে পারে। তার মানে ওই হ্যান্ডসেটগুলো বানানোই হয়েছে “ফেকিংয়ের” জন্য, বলছিলেন এ কে এম মোর্শেদ।
“ইনফরমেশন বার্ন (স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ) করে দেয়া হলে, ওটাকে আর চেঞ্জ করা যায় না। কিন্তু, তৈরিই যদি করা হয় কনফিগারেবল (পরিবর্তনযোগ্য) হিসেবে, তাহলে তো বোঝাই যায় সেটাকে নকল হ্যান্ডসেট হিসেবে বাজারজাত করার জন্য বানানো হয়েছে।”

কেন করা হয়?

আধুনিক যুগে অপরাধীর অবস্থান সনাক্ত করতে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বহুল চর্চিত বিষয়গুলোর একটি। অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, কোনো অপারেটরের একটি টাওয়ারের সাথে সংযুক্ত থাকা মোবাইল ফোনগুলোর আইএমইআই জানতে পারে সেই অপারেটর কোম্পানি। কিন্তু, একটা আইএমইআইর বিপরীতে যদি অনেকগুলো হ্যান্ডসেট থাকে তখন একটি নির্দিষ্ট হ্যান্ডসেটকে টার্গেট করা কঠিন হয়ে যায়।

“তখন প্রকৃত অপরাধীকে আইডেন্টিফাই করা আমাদের পক্ষে খুব কষ্টকর হয়। ফলে ফোন ট্র্যাকিংয়ের বদলে অন্য কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা জুনায়েদ আলম। বলেন, এ কারণে অপরাধীদের কেউ কেউ এ ধরনের হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে থাকে। তবে, বড় আকারের আইএমইআই জালিয়াতির নেপথ্য কারণটা অর্থনৈতিক বলে জানাচ্ছেন এ কে এম মোর্শেদ।

প্রত্যেক আইএমইআইয়ের জন্য জিএসএম অ্যাসোসিয়েশনকে একটা রয়্যালিটি পরিশোধ করতে হয়। “ওই র‍য়্যালিটি অ্যাভয়েড করতে একটি দেশের নির্মাতারা এক আইএমইআই নাম্বার দিয়ে লাখো হ্যান্ডসেট প্রডিউস করে,” বলেন মি. মোর্শেদ।

প্রতিকার কী?

আইএমইআই ডেটাবেজ থেকে একই ধরনের আসল ফোনের আইএমইআই নম্বর নিয়ে ক্লোন করা হলে, ডেটাবেইজে ওই হ্যান্ডসেটটির তথ্য পাওয়া যাবে। ফলে, “সাধারণ ব্যবহারকারীর বোঝার উপায় থাকবে না,” বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন। এসব প্রতিরোধে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন তিনি।

প্রথমত, আইনি পদক্ষেপ; দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ। ব্যবহারকারী হাত অব্দি ফোন পৌঁছে গেলে প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ বিশেষ কাজে আসে না বলে মনে করেন তিনি।
সেজন্য, আইনি পদক্ষেপের ওপর জোর দিচ্ছেন মি. হোসেন। তিনি বলেন, দেড় লাখ ক্লোনের ঘটনার নেপথ্যে কারা সেটি, তদন্ত করে বের করা সম্ভব। চুরি করা কোনো ফোন বিক্রি করার আগে চোরচক্র আইএমইআই মুছে ফেলে, বলছেন ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম বিভাগের এডিসি জুনায়েদ আলম সরকার।

আইএমইআই মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ উল্লেখ করে মি. সরকার বলেন, “আইনগত ব্যবস্থাটা আমরা নিই”। এ কে এম মোর্শেদ জানাচ্ছেন, একটি আইএমইআই’র বিপরীতে একটি হ্যান্ডসেট রেখে বাকিগুলোর ব্যবহার বার (বাধা দেয়া) করে দেয়ার মতো ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশেও সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে মন্তব্য করে মি. মোর্শেদ বলেন, “সারা পৃথিবীর অপারেটররা কো অপারেট করলে, একটার চেয়ে বেশি আইএমইআই নম্বর কাজ করবে না। এমন ব্যবস্থা করা যায়।” তিনজনই ভোক্তাদের অবৈধ হ্যান্ডসেট না কেনার তাগিদও দিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *