ফিলিস্তিন বিষয়ে সম্প্রতি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ‘আল-আকসার মর্যাদা ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন দেশটির শীর্ষ ইসলামিক স্কলার, চিন্তক ও লেকক। ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হুরমতে আকসা কনফারেন্সে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ইসলামিক স্কলার মুফতি তাকি উসমানি। তার ভাষণটি বিশ্বময় সাড়া জাগিয়েছে। এই ভাষণকে সময় পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। অনুবাদ করেছেন লেখক ও শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন গাজী।
(মাসনুন খুতবার পর) হযরাতে উলামায়ে কেরাম, জাতির নেতৃবর্গ ও উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলী! আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি তাআলা ওয়াবারাকাতুহ্!
আমরা এ মুহূর্তে এমন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ও শুনতে একত্রিত হয়েছি, যদি বলি তা অতিরঞ্জন হবে না, এটি পাকিস্তানের বাইশ কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। আর তা হলো- ফিলিস্তিন সমস্যা।
ইতিপূর্বে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপক জোরালো বক্তৃতা হয়ে গেছে। অনেক বিষয়ে মতামতও ব্যক্ত করা হয়েছে এবং প্রস্তাবনাও পেশ করা হয়েছে। আমি সেগুলোর পুনরাবৃত্তি না করে কয়েকটি সূক্ষ্মবিষয়ের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথম কথা হলো, আলহামদুলিল্লাহ, সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, ইসরাইল গাজ্জার বাসিন্দাদের সাথে বর্বরতা ও হিংস্রতার প্রদর্শনী করছে, তারা মানবতার সকল মূল্যবোধকে পদদলিত করে চলেছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে এই নিকৃষ্ট নাপাক দুশমনের কাছে ন্যূনতম মানবতাবোধও অবশিষ্ট নেই। সকলেই এর নিন্দা করেছে।
কিন্তু কিছু বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে, আমি আপনাদের সামনে তা সংক্ষেপে নিরসন করতে চাই।
সারাবিশ্ব ও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ হতে, এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রসংঘ ওআইসির পক্ষ হতে ফিলিস্তিনের চলমান সংকটে যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, তা হলো যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধবন্ধের প্রস্তাব। যুদ্ধ বন্ধের অর্থ হলো ইসরাইলকেও এ যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং হামাসকেও যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে হবে। যুদ্ধ বন্ধের সাধারণ অর্থ এটাই।
কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাব হলো, আমাদের দাবি গাজ্জার ওপর ইসরাইলের বোম্বিং বন্ধ করতে হবে, হামাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ বন্ধ নয়। হামাসের জানবাজ ও লড়াকু মুজাহিদরা তাদের জন্মগত অধিকার ও ইসলামের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের পূর্ণভূমিকে ইসরাইলের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে নেমেছে। এ যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ অমিমাংসিত শেষ করার যুদ্ধ নয়। এটি ততদিন অব্যহত থাকতে হবে এবং থাকা উচিত, যতদিন না পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূমি ইসরাইলের কব্জা থেকে মুক্ত হবে।
এ কারণে আমাদের প্রস্তাব যুদ্ধ বন্ধের নয়। যদি ইসরাইল সাধারণ নাগরিকদের ওপর বোম্বিং করার পরিবর্তে খোলাখুলি যুদ্ধের ময়দানে হামাসের মোকাবেলা করতে চায়, তা হলে মোকাবেলা করুক। লড়াই চলতে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের একটি ট্যাঙ্কও অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন হামাসের প্রতিরোধ যুদ্ধ চলতে থাকবে।
এজন্য অনুভূতিসম্পন্ন যেকোনো মানুষ ও সচেতন যেকোনো মুসলমানের দাবি যুদ্ধ বন্ধের পরিবর্তে ইসরাইলের একতরফা বোমা হামলার বন্ধ হওয়া উচিত। ইসরাইল তার পরাজয় আড়াল করার জন্য নিজের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিরীহ শিশু নারী ও সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে নিচ্ছে। এই যুদ্ধাপরাধ বন্ধের দাবী ওঠা উচিত, যুদ্ধ বন্ধের নয়। এ যুদ্ধ ইনশাআল্লাহ বিজয় অর্জিত হওয়া পর্যন্ত অব্যহত থাকবে।
দ্বিতীয় যে কথা আরজ করতে চাই তা হলো, বারবার সরকারগুলোর পক্ষ হতে এবং অনেক শান্তিপ্রিয় লোকদের পক্ষ হতে ভুল বুঝাবুঝির কারণে ফিলিস্তিনে দু’রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ সেখানে দুই রাষ্ট্র কায়েম হওয়াকে সমাধান মনে করা হয়। একটি ইসরাইল রাষ্ট্র, অপরটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। এটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর প্রস্তাব, আমরা তা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছি।
আমরা প্রথমদিন থেকেই ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী। আমাদের পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সেই প্রথমদিনই ইসরাইলকে পশ্চিমা অপশক্তির জারজ সন্তান আখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা এখনো সেই বিশ্বাসে অটল আছি। কাজেই ইসরাইলের অধিকৃত অঞ্চল ইসরাইলের, এবং গাজ্জা ও পশ্চিম তীর মুসলমানদের, এ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই দু রাষ্ট্র সমাধানের দাবি থেকে বিরত থাকা উচিত।
তৃতীয় কথা, সারা বিশ্বে এমনকি পশ্চিমা প্রোপাগাণ্ডায় প্রভাবিত মুসলমান হুকুমতগুলোতেও এক চরম বিভ্রান্তি বিরাজ রয়েছে। আর তা হলো, পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকার এক চক্রান্ত হলো, যখনই কোনো জাতি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধজিহাদের জন্য দাঁড়ায়, তখনই তাদেরকে সন্ত্রাসী টেরোরিস্ট আখ্যা দিয়ে সারা দুনিয়ায় তাদের দুর্নাম করা হয়। এই নীতিতেই তারা আমাদের কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুজাহিদীনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে।
একটি দীর্ঘসময় পর্যন্ত আফগানিস্তানের তালিবানকেও টেররিষ্ট বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা নতজানু হয়ে একটেবিলে বসে আল্লাহর মেহেরবানীতে তালিবানদের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তালিবান বিজয় লাভ করেছে।
এই অভিন্ন নীতি তারা ফিলিস্তিনেও প্রয়োগ করেছে। হামাস একটি রাজনৈতিক শক্তি। এটা নিছক যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী নয়। আমার আক্ষেপ লাগে, মিডিয়ায় ওদেরকে ‘যুদ্ধকামী গোষ্ঠী’ আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ এরা সকলে মুজাহিদ, পবিত্র জিহাদে রত।
একটু আগে জনাব ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, এদের অধিকাংশই হাফিজে কুরআন। অন্যরাও কুরআনের অনেক সূরা মুখস্ত জানে। তিনি আরও বলেছেন, হামাসের সদস্যদেরকে বিশেষায়িত তারবিয়াত করা হয়। হামাসে ভর্তি হওয়ার পূর্বে তাদেরকে বিশেষ তরবিয়াতের নানা ধাপ অতিক্রম করতে হয়, তারপর হামাসে দাখিল করা হয়। এরা সবাই প্রকৃত মুজাহিদ, যারা আত্মরক্ষায় লড়াই করছে।
একারণে পশ্চিমারা ওদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে সন্ত্রাসী হলো ইসরাইল, যারা পঁচাত্তর বছর থেকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে আসছে। কাজেই হামাস একটি জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন, এরা ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব করে না, এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর কথা প্রচার থেকে বিরত থাকা উচিত। হামাস পুরো ফিলিস্তিনের মুখপাত্র।
চতুর্থ কথা হলো, ইতিপূর্বে অনেক উলামায়ে কেরাম ও নেতৃবৃন্দ বলেছেন এবং আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যে, মুসলমানদের ওপর এহেন জুলম ও নির্বিচার হত্যা সত্ত্বেও, যেখানে মাসুম শিশু নারীর রক্তাক্ত বিভৎস ও ভয়ার্ত চেহারা সহ্য করার মত নয়, এতদসত্ত্বেও মুসলিম সরকারগুলোর পক্ষ হতে আশানুরূপ পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। কেবল মৌখিক নিন্দা বিবৃতি ও সামান্য ত্রাণসামগ্রি পাঠানো ছাড়া তেমন কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আমরা সরকারগুলোর ত্রাণতৎপরতার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো আমাদের শাসকগোষ্ঠীর যেই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল, তা এখনো তারা করতে পারেনি। জনাব ইসমাইল হানিয়া সাহেবও আক্ষেপ করে সেই কথাই বলেছেন- “আমরা চাই না, আপনারা আমাদের পক্ষে সেখানে হামলা করুন। আমরা চাই আপনারা গাজ্জাবাসীকে যথাসাধ্য সাহায্য করুন এবং এতে কোনোরূপ ত্রুটি করা হতে বিরত থাকুন।”
আমি এ প্রেক্ষিতে আপনাদের সম্মুখে শরীয়তের বিধান অবহিত করতে চাই। শরীয়তের বিধান হলো, মুসলমানদের কোনো ভূখণ্ডের ওপর যখন অন্য কেউ দখলদারিত্ব কায়েম করে নেয়, কিংবা কোনো কাফির শাসক চেপে বসে, তখন মুসলমানদের ওপর জিহাদ করা ফরজ হয়ে যায়। এই জিহাদ প্রথমে সে ভূখন্ডের মুসলমানদের ওপর ফরজ হয়, তারপর তৎপার্শ্ববর্তী মুসলিমদের ওপর ফরজ। এভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মুসলিমদের ওপর নিজ নিজ শক্তি স্বামর্থানুসারে জিহাদ ফরজ হয়ে যায়।
আমি একজন তালিবে ইলম হিসাবে আরজ করতে চাই, বিশ্বের সমস্ত মুসলমানদের ওপর এ অর্থে জিহাদ ফরজ যে, তারা নিজ নিজ সামর্থানুসারে সাধ্যমত হামাস ও গাজ্জাবাসীকে সাহায্য সহযোগিতা করবে।
আমি আপনাদের সম্মুখে কুরআনুল কারীমের দুটি আয়াত পড়ে শোনাব। আমি মনে করি, আয়াত দুটি আজকের এ সম্মেলনের পয়গাম ও বার্তা হওয়া উচিত, বিশ্বের সমগ্র মুসলমানদের প্রতি।
প্রথম আয়াত, সূরা নিসায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَ مَا لَکُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ ہٰذِہِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَہۡلُہَا ۚ وَ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ وَلِیًّا ۚۙ وَّ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ نَصِیۡرًا ﴿ؕ۷۵﴾
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۚ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ الطَّاغُوۡتِ فَقَاتِلُوۡۤا اَوۡلِیَآءَ الشَّیۡطٰنِ ۚ اِنَّ کَیۡدَ الشَّیۡطٰنِ کَانَ ضَعِیۡفًا ﴿٪۷۶﴾
আল্লাহ তাআলা সকল মুসলিমদের লক্ষ করে বলছেন, তোমাদের কি হয়ে গেল যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী এবং শিশুদের জন্য, যারা এ বলে দুআ করছে, হে আমাদের রব! এ জনপদ, যার অধিবাসীরা যালিম, সেখান থেকে আমাদেরকে বের করে নিন। আর আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কাউকে অভিভাবকরূপে পাঠান এবং আপনার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায়করূপে প্রেরণ করুন।
যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, আর যারা কফের তারা তাগূতের পথে যুদ্ধ করে। কাজেই তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল। (সূরা নিসা : ৭৫-৭৬)
আল্লাহ তাআলা নারী শিশু ও দুর্বল পুরুষদের দোহাই দিয়ে বলছেন, তোমাদের কী হলো যে, তোমরা এদেরকে উদ্ধার করার জন্য জিহাদ করছো না?
দ্বিতীয় আয়াত হলো, সূরা তাওবায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
قُلۡ اِنۡ کَانَ اٰبَآؤُکُمۡ وَ اَبۡنَآؤُکُمۡ وَ اِخۡوَانُکُمۡ وَ اَزۡوَاجُکُمۡ وَ عَشِیۡرَتُکُمۡ وَ اَمۡوَالُۨ اقۡتَرَفۡتُمُوۡہَا وَ تِجَارَۃٌ تَخۡشَوۡنَ کَسَادَہَا وَ مَسٰکِنُ تَرۡضَوۡنَہَاۤ اَحَبَّ اِلَیۡکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ جِہَادٍ فِیۡ سَبِیۡلِہٖ فَتَرَبَّصُوۡا حَتّٰی یَاۡتِیَ اللّٰہُ بِاَمۡرِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿٪۲۴﴾
আল্লাহ তাআলা নবীজি সা.কে লক্ষ্য করে বলেন, আপনি সবাইকে বলে দিন, যদি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানেরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস, আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহ্র) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ্ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেনা না। (সূরা তাওবা : ২৪)
শেষ কথা : আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আরজ করতে চাই। আমাদের এ সম্মেলনে মুসলিম শাসকদের বেশ সমালোচনা হয়েছে। এর বেশিভাগই যথার্থ ছিল। তানকীদ ও সমালোচনা নিশ্চয় আমাদের অধিকার। আমরা অবশ্যই একথার আদিষ্ট, যে বিষয়টিকে আমরা হক মনে করবো, তা শাসকশ্রেণীর কাছে পৌঁছে দেব।
তবে বিষয়টি ‘মুখাসামাত’ তথা ঝগড়াবিতর্কের আবহে নয়, বরং ‘মুফাহামাত’ তথা তাদের বোঝানো ও নসীহতের আবহে হওয়া উচিত। কারণ, আমাদের দীন সকল মুসলিমের জন্য নসীহত তথা কল্যাণকামিতার আদেশ করেছে। ‘আননুসহু লিকুল্লি মুসলিম’ এর মধ্যে ‘আননুসহু লি উলিল আমর’ও আহলে ইলমের দায়িত্ব।
সে সূত্রে আমি বলতে চাই, আমি আমার অন্তরকে ভালোভাবে যাচাই করে, আল্লাহর দিকে রুজু করে এবং তাঁর কাছে দুআ ও ইস্তিখারা করে আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছি- ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যদি সে মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করা হয়, তাহলে শত শত বছর সেভুলের মাশুল গুণতে হয়। প্রসিদ্ধ উক্তি আছে- لمحوں نے خطا کی ہے، صدیوں نے سزا پائی ۔ ‘মুহূর্ত করেছে ভুল, শতবর্ষ গুণেছে মাশুল।’
ইতিহাসে এমন মুহূর্ত আসে, যখন হিম্মত ও সাহসিকতার সাথে পদক্ষেপ নিয়ে এবং ত্যাগ ও কুরবানীর সর্বোচ্চ পারাকাষ্ঠা দেখিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যদি সেই সঠিক সিদ্ধান্ত যথাসময়ে নেওয়া না-হয়, তখন শত শত বছর তার ক্ষতি ও গ্লানির বোঝা টানতে হয়। আমি মনে করি, এখন ইতিহাসের সেই যুগসন্ধি অতিক্রম করছে।
আপনারা সকলে অবগত, যা অস্বীকার করার উপায় নেই, সমগ্র ইসলামী বিশ্ব, মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমবিশ্ব পশ্চিমা দাসবৃত্তির শিকার। কেউ কি অস্বীকার করতে পারবে যে, আমরা গোলামী জীবনযাপন করছি না? সর্বক্ষেত্রেই চলছে এ গোলামী- অর্থনীতি, সমরনীতি ও রাজনীতি। এ গোলামীর শেষ কোথায়? অথচ মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম দুনিয়াকে আল্লাহ তাআলা যে প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধি দান করেছেন, তা আর কাউকে দেননি।
মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তাদের হাতে সেসব বিস্তৃত মরুঅঞ্চল রয়েছে, যদ্দ্বারা তারা সমগ্র দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। … সুয়েজ খাল তাদের হাতে। এডেন উপসাগর তাদের হাতে। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি তরল সোনা তথা তেলসম্পদ তাদের হাতে। … তারপরেও কেন তাদেরকে গোলামির জীবন কাটাতে হবে? এর কারণ কি?
কারণ একটিই, যা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ানাল্লাম বলে গেছেন। তিনি বলেছেন : মুসলমান অধিক হওয়ার পরেও খড়কুটার মত ভেসে যাবে। কারণ, তারা জীবনকে বেশি ভালোবাসবে, মৃত্যুকে ভয় করবে এবং জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’কে পরিত্যাগ করবে। আজ আমাদের সুরতহাল সেটাই জানান দিচ্ছে।
আজ হামাসের বীর মুজা]হিদরা আমাদের জন্য মুক্তির মহাসুযোগ এনে দিয়েছে, পরাধীনকার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার, পশ্চিমের জোঁয়াল কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলার। হামাস সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
যদি সমগ্র মুসলিম দুনিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সঙ্গ দেয় এবং তাদের জন্য আত্মরক্ষার যৌথ পলিসি গ্রহণ করে, আমি ইয়াকীনের সাথে বলতে পারি আমেরিকা বৃটেন ও পশ্চিমাশক্তি কিছুই করতে পারবে না। কারণ, খোদায়ী আমেরিকার নয়, খোদায়ী আমেরিকার হাতে নেই। খোদায়ী আল্লাহরই হাতে। সুপার পাওয়ার আমেরিকা নয়, সুপ্রিম পাওয়ার আল্লাহই।
কাজেই যদি আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমাদেরকে পেটে পাথর বাঁধার প্রয়োজন পড়লে পাথর বাঁধব, যেকোনো ত্যাগ ও কুরবানীর প্রয়োজন পড়ে, তা দেব। গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াব। কামানের সামনে দাঁড়াব, তা হলে আমেরিকা বা দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই আমাদের পরাজিত করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা এই হাকীকত ও বাস্তবতা বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন! আল্লাহ তাআলা এই বাস্তবতা বুঝে নিজেদের দাসবৃত্তির কাল শেষ করার তাওফীক দান করুন। আমীন!! وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.