“ফিফটিন গভর্নরস আই সার্ভড উইথ”

সময় সংবাদ
শেয়ার করুন

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

বইটি প্রত্যেক বাঙালির পড়া উচিত! এমন একটি বই বার বার লেখা হয় না। কারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ একাধিক মানুষের জীবনে আসে না। বাংলাদেশ পৃথিবীতে অনন্য এক দেশ। বাংলাদেশে যা ঘটে, পৃথিবীর কম দেশেই তা ঘটে। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যথার্থই বলেছেন, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি”।

পৃথিবীর আর কোথাও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের দৃষ্টান্ত নেই। এত অল্প সময়ের যুদ্ধকালে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ও চার লাখ মা-বোনকে ধর্ষণের নজীর পৃথিবীতে নেই। বাংলাদেশে পরাজিত বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্যের যুদ্ধবন্দী হওয়ার মতো ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। তেমনি নজীরবিহীন একটি ঘটনা ২৪ বছর পর্যন্ত টিকে থাকা পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ২১ জন গভর্নরের মধ্যে ১৫ জনের এডিসি হিসেবে সেনাবাহিনীর একজন মেজরের কর্তব্য পালন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে একজন এডিসি টানা ১৮ বছর যাবত ১৫ জন বিভিন্ন বৈশিষ্টের, বিভিন্ন রুচির গভর্নরের সঙ্গে কাজ করেছেন, এমন ঘটনা যে ঘটেনি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই কৃতিত্বের দাবীদার মেজর এস, জি, জিলানি। এতগুলো গভর্নরের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় তাঁর অভিজ্ঞতার ঘড়া কানায় কানায় উপচানো ছিল।

মেজর জিলানি তাঁর অভিজ্ঞতা টুকে রাখতেন ডায়েরিতে, যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক দশক পর “ফিফটিন গভর্নরস আই সার্ভড উইথ: আনটোল্ড স্টোরি অফ ইস্ট পাকিস্তান,” নামে প্রকাশ করেন। বইটির ভূমিকা লিখেছেন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খান। মেজর জিলানি তাঁর অভিজ্ঞতা লিখেছেন অনেকটা গল্পের মতো।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করতে গিয়ে আমরা ১৯৪৭ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ২৪ বছরের ঘটনাবলী প্রায়ই ভুলে যাই। সেই বিস্মৃত ইতিহাসকে চাঙ্গা করার এমন কিছু দুর্লভ তথ্য এই বইয়ে রয়েছে, যা ইতিহাসবিদ ও ইতিহাস পাঠকদের জন্য “মিসিং লিঙ্ক” হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে কতটা অবহেলা ও দায়িত্বহীনভাবে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছেন, কীভাবে জনগণের আকাংখাকে পদদলিত করেছেন, তা পূর্বাঞ্চলের সর্বোচ্চ নির্বাহীর সার্বক্ষণিক সহকারীর দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর জিলানি তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদেরও কাছে থেকে দেখেছেন যে তারা এক-আধটু ক্ষমতা হাতে পেলে তা অপব্যবহারের প্রতিযোগিতায় কীভাবে কাদা ছোঁড়াছুড়িতে লিপ্ত হন।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ বছর ৪ মাস ১৮ দিন মেয়াদে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বা পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর ও ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২১ জন ব্যক্তি। তারা বিভিন্ন পর্যায় থেকে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন উচ্চ আদালতের বিচারক, পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও বেসামরিক আমলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার মেজর এস, জি, জিলানি প্রথম এডিসি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামানের এবং শেষ সামরিক গভর্নর লে: জেনারেল টিক্কা খান পর্যন্ত ১৫ জন গভর্নরের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মেয়াদে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় গভর্নর ছিলেন মোনায়েম খান, ৬ বছর ৪ মাস ২৭ দিন এবং সবচেয়ে কম সময় মাত্র ৩ দিনের জন্য গভর্নর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. এম এন হুদা।

মেজর জিলানি খুব কাছে থেকে দেখেছেন গভর্নরদের জীবন, তাদের কাজের ধরন, ব্যক্তিগত আচার-আচরণ এবং ‘লাটভবন’ হিসেবে পরিচিত ‘গভর্নমেন্ট হাউজ’ অর্থ্যাৎ বর্তমান বঙ্গভবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে।

এটি লেখকের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ। ওই সময়ের রাজনৈতিক কিছু ঘটনা ওঠে এসেছে, যা ইতিহাসের কোনো বইয়ে নেই। বৈঠকী আলোচনার ঢংয়ে বর্ণনা করা কাহিনি পাঠকের জন্য সুখপাঠ্য হবে বলে আশা করি।

গত অক্টোবরে বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে “পেন্ডুলাম পাবলিশার্স” এবং প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে পাঠকদের পক্ষ থেকে এত সাড়া পাওয়া গেছে যে এটির অনুবাদক হিসেবে আমি উচ্ছসিত, প্রকাশক হিসেবে পেন্ডুলামের সত্ত্বাধিকারী রুম্মান তার্শফিকও আনন্দিত। যে কারও সংগ্রহে রাখার মতো ২৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ৫৫০ টাকা। কপি শেষ হওয়ার আগেই অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ এ “পেন্ডুলাম পাবলিশার্স (স্টল নম্বর: ৫৪২-৫৪৩) এ যোগাযোগ করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *