স্পেইন নিয়ে পড়ালেখা করার সময় একদিন উত্তেজিত হয়ে মেয়েদের বাবাকে বললাম, জানো? পৃথিবীর সবচে উঁচু মিনারত হচ্ছে সেভিয়্যা তে, ওখানে একসময় মুয়াজ্জিন ঘোড়া দিয়ে উঠতো আযান দিতে, এত উঁচু!
মেয়েদের বাবা পুরাই কনফিউজড হয়ে বলেছিলো মিনারতে ঘোড়া নিয়ে উঠে আযান দিতো- এটা কেমন না?
আমারো তখন মনে হয়েছিলো, তাইতো, মিনারতে কীভাবে ঘোড়া নিয়ে উঠবে?! তাছাড়া এত উঁচু মিনারত ঐ সময় মুসলিমরা বানাবেই বা কেনো? অথবা বানানো সম্ভবই বা কীভাবে? ওদের তো আমাদের সময়ের টেকনোলজি ছিলো না।
সেভিয়্যা আসার পর যখন লা-জিরাল্ডা গেলাম, সেই মিনারতের হিস্পানিক/স্প্যানিশ নাম, যাওয়ার পরে এক স্প্যানিশ ইতিহাসের প্রফেসরের কাছে শুনলাম, কথাটা ঠিক!
মুয়াজ্জিন তখন আসলেই গাধা’য় (নাকি ঘোড়া শিউর না) চড়ে মিনারতের উপড়ে গিয়ে আযান দিতো! যখন নিজে উঠতে গেলাম, তখন টের পেলাম, একজন মানুষের পক্ষে দিনে পাঁচবার এই উঠানামা করা সম্ভবই না!
মিনারতে উঠার রাস্তাটা সিঁড়ি না, ছোট চিকন হাঁটা রাস্তার মত ঘুরে ঘুরে উপরে উঠেছে। উঠতে উঠতে মিনারতের চারিদিক দিয়ে মুসলিমদের বানানো অনেক বড় বড় দরজা আর জানালা। দরজার বাইরে ছোট ছোট বারান্দা যেগুলো এখন গ্রিল দিয়ে আটকানো।
১১৯৮ (১২ শতাব্দী)তে বানানো হয়েছিলো এই মিনারত। আটশ বছর পর্যন্ত, ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এটাই পৃথিবীর সবচে’ উঁচু মিনারত ছিলো। ৩৪১ ফিট উঁচু। ১০৪ মিটার লম্বা। আটশ বছর পর মরক্কোতে কাসাব্লাঙ্কায় বানানো হয়েছে আরেকটা মিনারত যেটা ২১০ মিটার উঁচু। এখন লা জিরাল্ডা তাই পৃথিবীর সেকেন্ড টলেষ্ট মিনারত।

কিন্তু আমার কাছে এটাই অনেক বড় বিস্ময়। সেই ১২ শতাব্দীতে কীভাবে মুসলিমরা বানিয়েছিলো এই মিনারত?!
স্পেইনে মুসলিমদের হিষ্টোরিক্যাল প্লেইসগুলোতে ঘুরলে একটা প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগতে পারে- খৃষ্টানরা মুসলিমদের মসজিদগুলো ধ্বংস করে দিয়ে তারপর নিজেদের ক্যাথেড্রাল বানায়নি কেনো? কেনো মসজিদগুলোকেই কনভার্ট করে নিয়েছে?
কারণ সে সময়ে স্পেইনের মুসলিমরা আর্কিটেকচারাল ডিজাইন এবং বিল্ডিং এর দিক দিয়ে যে অসাধারণ জ্ঞানের জায়গায় পৌঁছেছিলো, ওয়েষ্টার্ন ইউরোপিয়ান খৃষ্টানরা জীবনে- তাদের বাপ দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্মে- কখনো এমন ডিজাইন, এমন বিল্ডিং, এমন ইমারত, এমন কন্সট্রাকশান যে সম্ভব – এটাই কল্পনা করেনি।
এক একটা প্রাসাদ, বাগান, শহর, মসজিদ, সবকিছু খৃষ্টানরা দখল করে নেয়ার পরে খৃষ্টানাইজড করে নিয়েছে। আর তাদের যে আর্কিটেকচারাল ওয়ান্ডারনেস, এগুলো সবই এসেছে পনেরো/ষোলো শতাব্দীর পরে। মুসলিমদের কয়েক শতাব্দী পরে।
আরেকটা ব্যাপার আছে। আপনি খৃষ্টান আর্কিটেকচার আর মুসলিম আর্কিটেকচার যখন স্পেইনে পাশাপাশি একইসাতে দেখবেন- একটা ধরেন প্রাসাদের মুসলিম দরজা আর খৃষ্টান দরজা- একদম চোখের সামনে দেখতে পাবেন- মুসলিম ডিজাইনগুলো খুবই সুদিং, পীসফুল, কেমন যেন মনে হবে এটা যেন আলগা বানানো হয়নি, যেন এই ডিজাইনগুলো এভাবেই পাখি, গাছ, আকাশ, বাইরের উঠানের অংশ, এমনভাবে ডিজাইন করা, চমৎকারভাবে প্রকৃতির সাথে সিংক্রোনাইজড হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু খৃষ্টান ডিজাইনগুলো কেমন যেন ইম্পোজড। আপনি দেখে অবাক হবেন, কিন্তু সেইসাথে খেয়াল না করে পারবেন না যে খৃষ্টানদের ডিজাইনগুলো সব হয় মানুষের মূর্তি না হয় মানুষের ছবি! মূর্তি বানানোতে তারা সেইরকম সফিস্টিকেশানে পৌঁছেছিলো গ্রীক- রোমানদের সময়ের থেকেই, কিন্তু এই এক মূর্তি ছাড়া তাদের আর কোনো কিছুই আমার চোখে লাগেনি।
কোনো এক স্প্যানিশ খৃষ্টান রাজা, আমার নাম-টা মনে নেই এখন, মুসলিমদের থেকে সেভিয়্যা গ্র্যান্ড মস্ক দখল করে নেয়ার পর, পরবর্তীতে খৃষ্টানরা যখন মূর্তি দিয়ে, তাদের রিলিজিয়াস আইকন দিয়ে রিনোভেট করলো- তখন সেই খৃষ্টান রাজা নিজেই বলেছিলো- অসাধারণ একটা স্থাপনাকে সাধারণ করে ফেললাম আমরা!
লা-জিরাল্ডা মিনারতটাতে আপনাকে ঢুকতেই হবে মসজিদের (ক্যাথেড্রালের) ভিতর দিয়ে, কিন্তু এখন স্প্যানিশরা অস্বীকার করে যে এই ক্যাথেড্রাল একসময় মসজিদ ছিলো। যদিও ঠিকই এই ক্যাথেড্রালের কয়েকটা নামের মধ্যে একটা নাম এখনো ‘সেভিয়্যা গ্র্যান্ড মষ্ক্ ক্যাথেড্রাল’!
আপনি এই ক্যাথেড্রালের ভিতরের সাইড পিলারগুলো, মেইন দরজা, বিশাল উঠান আর বাগান যেটা হুবুহু কর্দোবা মসজিদের উঠান-বাগানের মত, বাইরের শেইপ দেখলে, একজন অন্ধও বলতে পারবে এগুলো যে মুসলিমদের ডিজাইন আর এই ক্যাথেড্রাল যে আসলে মসজিদ ছিলো।
সবচে’ বড় প্রমাণ হলো আপনি লা জিরাল্ডায় উঠলে যখন ১০৪ মিটার উপর থেকে দেখবেন ক্যাথেড্রাল টা, চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাবেন পুরোটাই মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদের উপরের গোল গোল শেইপগুলোর উপর ওরা জাস্ট ক্রস জেসাস/ম্যারির/খৃষ্টান রিলিজিয়াস ফীগারদের মূর্তি বসিয়ে দিয়েছে। (চলবে)