ইস্ট লন্ডন মাতালেন কিং চার্লস ও কুইন কনসোর্ট

যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

যুক্তরাজ্যের রাজা বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) ইস্ট লন্ডন এসে জনতার হৃদয় জয় করেছেন। নতুন রাজা কিং চার্লসের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা।

সফরের শুরুতেই তিনি ইস্ট লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল রোডে বাংলাদেশিদের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের স্মারক আলতাব আলী পার্কে এসেছেন। তারপর বাংলা টাউন ব্রিকলেন ঘুরে দেখেছেন। ব্রিকলেন মসজিদ পরিদর্শন করেছেন। গ্রাম বাংলা রেষ্টুরেন্টে বাংলাদেশী খাবার খেয়েছেন। সেই সাথে শত শত মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট লন্ডনের (ইউইএল) স্ট্রাটফোর্ড ক্যাম্পাস পরিদর্শন করে নিজ প্রাসাদে ফিরেছেন।

রাজা হবার পর ইস্ট লন্ডনে এটি কিং চার্লসের প্রথম সফর। এর আগে প্রিন্স চার্লস হিসেবে তিনি এসেছেন ২০০১ সালে ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারে।

বুধবার সকাল ১১টায় চার্লস ও ক্যামিলা ঐতিহাসিক আলতাব আলী পার্কে এসে পৌছলে তাদের স্বাগত জানান লর্ড লেফটেন্যান্ট স্যার কেনেথ ওলিসা ওবিই ও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের স্পীকার সাফি আহমদ মুন্না। সাথে ছিলেন অনুষ্ঠানের মুখ্য সংগঠক ব্রিটিশ বাংলাদেশী পাওয়ার এন্ড ইন্সিপিরেশনের ট্রাস্টি আয়েশা কোরেশী এমবিই ও কাউন্সিলার আব্দাল উল্লাহ এবং লন্ডন মুসলিম সেন্টারের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল বারি এমবিই।

চতুরদিকে দাড়িয়ে থাকা জনতা হাততালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে ভালোবাসা ও স্বাগত জানান। এ সময় মালবেরী স্কুল এবং লন্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমীর এক দল শিক্ষার্থি রাজাকে সম্মান জানায়। রাজা তখন শিক্ষার্থি সহ জনতার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় এবং করমর্দন করেন।

এরপর টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র মাইমুন মিয়া, সাবেক কাউন্সিলার রাজন উদ্দিন জালাল, হেলাল উদ্দিন আব্বাস সহ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রিন্স চার্লসের সাথে মিলিত হন। তারা শহীদ আলতাব আলীর জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে বর্ণবাদ নির্মূলে বাংলাদেশিদের ভূমিকার কথা জানান।

আলতাব আলী পার্কে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, লেখক আনসার আহমেদ উল্লা, সিনিয়র সংবাদ পাঠিকা ডা: জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, টিভি উপস্থাপিকা উর্মী মাজহার প্রমুখ কিং চার্লসকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য অবহিত করেন।

রাজা দম্পতি আলতাব আলীর স্মরণে একটি এলম গাছ রোপণ করেন। ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদীদের প্রাণঘাতী ছুরিকাঘাতে যুবক আলতাব আলী শহীদ হন। তার সম্মানে এই জায়গাটির নামকরণ হয়েছে আলতাব আলী পার্ক। টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান এই পার্কের আধুনিকায়, ইতিহাস অঙ্কন ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেছেন।

এখান থেকে গাড়িতে করে বাংলাটাউন তথা ব্রিকলেন যান কিং চার্লস ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা। সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে তাদের স্বাগত জানান ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। হাই কমিশনার এসময় রাজাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে ইতিবাচক সাড়া দেন।

ব্রিকলেনের দুপাশে দাঁড়ানো সমবেত জনতা ফেস্টুন নেড়ে রাজাকে স্বাগত জানান। এসময় তরুন কিশোরী দল ড্রামার ছন্দময় আওয়াজের সাথে মাটিতে ফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়। রাজাও হাত নেড়ে তাদের প্রতি শুভেচ্ছা জানান। সেখানে ক্রাইস্টচার্চ স্কুলের শিক্ষার্থি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলা টাউন ফটকের কাছে ‘মাটির টান’ শীর্ষক দেয়ালচিত্রের অঙ্কন শিল্পী মোহাম্মদ আলী এমবিই সহ বেশ ক’জন অবিই, এমবিই এবং জনপ্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।

এরপর আয়োজকদের পূর্বপ্রস্তুতি মোতাবেক রাজা ও তার সহধর্মীনিকে গ্রাম বাংলা রেষ্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজা বাংলাদেশী সমুচা খেয়ে এবং কুইন কনসোর্ট চা পান করে উপস্থিত সকলের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করেন। এরপর রাজা বিবিপিআই জামদানী নেটওয়ার্কের নারী উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলেন। এসময় কুইন কনসোর্ট ক্যামিলাকে একটি জামদানী শাড়ি উপহার দেওয়া হলে তিনি স্বাদরে গ্রহন করেন।

অবশেষে রাজা ব্রিকলেন জামে মসজিদ পরিদর্শন করেন। মসজিদে তাদের স্বাগত জানান ব্যবস্থাপনা কমিটি ও মুসল্লিগন। সেখানে তিনি ব্রিকলেন মসজিদের ইতিহাস এবং ফিনারেল কার্যক্রম সম্পর্কেও অবহিত হন।

কিং ও কুইন কনসোর্ট হোয়াইটচ্যাপেল এবং ব্রিকলেন সফর শেষে ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট লন্ডনের (ইউইএল) স্ট্রাটফোর্ড ক্যাম্পাসে যান। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৫তম বার্ষিকীকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশেষ ফলক উন্মোচন করেন।

রাজা ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল এবং প্রাথমিক কেয়ার ট্রেনিং পরিদর্শন করেন। তিনি শিক্ষার্থী নার্সদের সাথেও কথা বলেন। তারা জানান, পেশাদার হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এবং সারা দেশে স্বাস্থ্য বৈষম্য মোকাবেলায় কাজ করার জন্য পরিকল্পনা ডিজাইন করা হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট লন্ডনের স্বাস্থ্যসেবা ওয়ার্ড এবং নিবিড় পরিচর্যা ওয়ার্ডে প্রশিক্ষণার্থী এবং সেবা কর্মীদের সাথে কথা বলে রাজা মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। যারা নার্সিং, ফিজিওথেরাপি এবং পোডিয়াট্রি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন, তাদের তিনি উৎসাহিত করেন।

রাজা সেখানে তিনজন মা, ইউনিক ওয়েস্ট আলিস, ম্যাডেলিন রাইট এবং হান্না বোসলে এবং তাদের শিশুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, যারা ইউইএলের বেবিডেভল্যাবে গবেষণায় অংশ নিচ্ছেন। ল্যাবটির লক্ষ্য শিশুরা কীভাবে চিন্তা করে এবং আচরণ করে তা বোঝা এবং বর্তমান শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের কীভাবে প্রভাবিত করে তা নির্ণয় করা।

ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট লন্ডনের ভাইস-চ্যান্সেলর এবং প্রেসিডেন্ট প্রফেসর আমান্ডা ব্রোডারিক বলেন, তিনি মনে করেন কিং চার্লস তাদের প্রদর্শনী দেখে বেশ প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি উপস্থিত সকলকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

কিং চার্লস ও কুইন কনসোর্ট ইস্ট লন্ডনে প্রায় আড়াই ঘন্টার সফরে বেশ আনন্দিত মনে হয়েছে। সর্বত্রই শত শত মানুষ হৃদয় দিয়ে তাদের প্রতি ভালোবাসা জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *