পারলে ক্ষমা কোরো বন্ধু আসাদ ।। মুজতাহিদ ফারকী

মতামত সময় টিভি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আসাদ বিন হাফিজ। কবি ও সংগঠক। আমার বন্ধু ছিল। হ্যাঁ, বন্ধু। কারণ, ওর ধর্মীয় রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনুসারী লেখক কবি সাহিত্যিকরা যখন আমাকে নীরবে এড়িয়ে যান তখন আসাদই একমাত্র ব্যক্তি যে সেই কারণটা গোপন রাখেনি। বহু বছর, সম্ভবত আজ থেকে বছর চল্লিশেক আগে (১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে) রিক্সা করে কোথাও যাচ্ছিলাম দুজনে। নেমে যাবার সময় চলমান কথার রেশ ধরে এক গাল হেসে বললো, বে-নামাজির সঙ্গে লোকে ক্যামনে ওঠাবসা করে! ওর কথায় কোনও অস্পষ্টতা ছিল কি! না, আমি তো বুঝে নিয়েছি। এর চেয়ে বন্ধুত্বের প্রকাশ আর কী হতে পারে?

তবে ব্যতিক্রম ছিল না এমন নয়। মতিউর রহমান মল্লিকের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক ছিল বললে কম বলা হবে। দুজনে পার্কে ঘুরে বেড়িয়েছি বহুদিন। অফিসে ছুটি নিয়ে সারাদিনের জন্য বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে গেছি একাধিক বার (একই অফিসে কাজ করতাম বলে)। তিনি ছিলেন প্রকৃতই কবি। উদারতা ও মাধুর্য্য ছিল তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বন্ধু আসাদের সঙ্গে বিপরীত উচ্চারণে, বাংলা সাহিত্য পরিষদে অনেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি, কথা বলেছি, কখনও বিতর্ক করেছি। সে সব সময়ই হেসে কথা বলেছে। ভিন্নমত জানিয়েছে মুখে হাসি ধরে রেখেই। আমাদের তর্ক হয়েছে কবিতার বিষয় নিয়ে। ওরা কবিতাকে ইসলামী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক হাতিয়ার হিসাবে নিয়েছে। আমি কবিতা লিখি নিছকই কবিতা লেখার জন্য। সেটা করতে গিয়ে আমার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের স্বাভাবিক প্রতিফলন কবিতায় পড়তে পারে। যেমন আল মাহমুদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, যেমন ফররুখের ক্ষেত্রে।

আমি যে বিষয়টিতে সব সময় সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি, এখনও দিই, সেটি হলো, সাহিত্য তুমি যেটাই করো, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস- তোমার লেখা মানসম্মত হচ্ছে কি না সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সেই লেখা মানুষের মন স্পর্শ করবে। মন পাল্টে দিতে পারবে। মানহীন হাজারটা কবিতা লিখেও কোনও লাভ হবে না।

বামপন্থী যেসব কবি কবিতাকে নিছক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে নিয়েছিলেন তাদের কাব্যিক সফলতার উদাহরণ দিতাম। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে দিনের কবিতা’ থেকে তুলে ধরতাম, “প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/ কাঠফাঁটা রোদ সেঁকে চামড়া।” দিতাম সুকান্তের উদ্ধৃতিও। কালজয়ী সব উচ্চারণের নমুনা হাজির করতাম। কারো লেখায় যুক্তির দুর্বলতা দেখিয়ে দিতাম। আসাদ মানতে চাইতো না। যুক্তির চেয়ে আবেগকে প্রাধান্য দিতে চাইতো। এটি কেবল আসাদের নয়, আমাদের বাঙালি রক্তেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আসাদ শুধু কবিতা লেখেনি। বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়েছে, সাহিত্যের সংগঠন চালিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে সামনে থেকে। তার মধ্যে নেতার গুণ ছিল।

ইসলামী ধারার কবিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল সন্দেহাতীত। তার কবিতা পড়েছি। উচ্চকন্ঠ বলে তেমন উৎসাহ পাইনি। তবে একটা যুক্তি মানি। রণদামামা তো রাবিন্দ্রিক সুরে বাজালে চলে না। বিদ্রোহের সুরেই বাঁধতে হয়।

আসাদ কবিতার শৈলী নিয়ে খুব সজাগ ছিল না। ’৯৯-এর পর তো আমি নিজেই লেখালেখি থেকে সরে এসেছি। বিপরীত উচ্চারণ বা বাংলা সাহিত্য পরিষদে আর যাওয়া হয়নি। কেউ ডাকেওনি। আসাদের সঙ্গে এখানে ওখানে দেখা হলে সেই বন্ধুসুলভ আচরণই পেয়েছি। এক সাথে চাটা খেয়েছি। হাসিঠাট্টা করেছি। বইটই, লেখালেখি নিয়ে টুকটাক কথা, ওইটুকুই।

ওর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয় মনে নেই। তবে সেটি ছিল ওর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রীতি প্রকাশনে। আমি ছেলের জন্য জুল ভার্নের রচনার একটি খণ্ড নিয়েছিলাম ওর দোকান থেকে। ওই বইতে যদি স্বভাবমত তারিখ লিখে রেখে থাকি তাহলে জানতে পারবো শেষ দেখার দিনটি।

গত সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ফেসবুকে অন্তত পাঁচবার আসাদ আমাকে পোক করেছে। পোক করলে কী করতে হয় আমি জানি না। আমিও শুধু পাল্টা পোক করেছি। ওকি আমাকে দেখতে চেয়েছিল? অথবা চেয়েছিল আমি ওকে দেখতে যাই? আল্লাহ জানেন। আর কোনওদিন এ প্রশ্নের জবাব মিলবে না। মনটা বেশি বিষণ্ন লাগছে, কেন আমি ফেসবুকেই ওকে জিজ্ঞাসা করিনি! কেন একটা মেসেজ অন্তত পাঠাইনি!

বন্ধু পারলে ক্ষমা করো। আল্লাহ তোমার রুহের মাগফেরাত দিন, বেহেশত নসিব করুন। এর বেশি আর কীই বা চাইতে পারি মহামহিমের কাছে? তোমার মৃত্যু মনে করিয়ে দিচ্ছে, যাবার তো সময় হলো আমারও!

(আসাদের এই ছবিটাই আমৃত্যু মনে থাকবে আমার) ০১.০৭.২০২৪ সোমবার।

* মুজতাহিদ ফারুকী লেখক, সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *