পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়ছে

মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

জেসি উইলিয়ামসন বিবিসি নিউজ

গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ওই অভিযানের তীব্রতাও। পশ্চিম তীরের উত্তরে অবস্থিত জেনিন শহরটি হামাসের আক্রমণের আগে ওই সামরিক অভিযানগুলির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখন ওই শহর সাপ্তাহিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা যে ক’জন তরুণের সঙ্গে মঙ্গলবার আমার দেখা হয়েছিল, তাঁরা কিন্তু প্রবীণদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বেশ সন্দিহান। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি এবং ইসরায়েলের সামরিক অভিযান থেকে সুরক্ষা চেয়ে বিশ্বের কাছে তাঁর (ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতির) আবেদনের বিষয়টি নিয়েও তারা (ওই তরুণেরা) উপহাস করেছে।

ওই তরুণদের ঠিক পিছনেই ইসরায়েলের সাঁজোয়াযুক্ত বুলডোজার এবং সামরিক জিপ জেনিনের শরণার্থী শিবিরে ঢোকার রাস্তার চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল। শহর জুড়ে বিস্ফোরণ এবং গোলাগুলির আওয়াজ নির্জন রাস্তায় প্রতিধ্বনিত হয়ে চলছিল।

এই শহরের দেয়ালগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত তরুণদের ছবি দিয়ে ঢাকা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য, যাদের যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য বহু দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, মঙ্গলবারই সেখানে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, যাঁদের মধ্যে চারজন মারা গিয়েছেন ড্রোনের হামলায়।

ইসরায়েলের দাবি, তারা নিশানা করছে সেই সব সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের, যাদের হাতে ইসরায়েলিদের রক্ত লেগে আছে।

যদিও জেনিনে হাসপাতালের পরিচালক উইসাম বকর জানিয়েছেন, চিকিৎসা কেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়ায় প্রাণ হারিয়েছে বছর তেরোর একজন। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিল সে।

“জেনিনে ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রবেশ এবং তরুণদের হত্যা করা জনগণকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। প্রতিদিনই আমরা একজন করে বন্ধুকে হারাচ্ছি,” তিনি বলেন।

মি. বকরের কথায়, “এটা কখনওই শান্তি আনবে না। বরং আরও প্রতিরোধের জন্ম দেবে।”

গাজার হামাসের বন্দুকধারীরা দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে সাতই অক্টোবর ১,২০০ জনকে হত্যা ও ২৪০ জনকে জিম্মি করেছিল। এর পর শুরু হওয়া যুদ্ধে ১৮,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক হত্যা করা হয়েছে।

পশ্চিম তীরে হামলার পর থেকে ৬৯জন শিশু-সহ ২৭১জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে প্রায় সবাই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

হামাসের হামলার পর থেকে নাবলুস এবং জেনিন-সহ পশ্চিম তীরের অনেক অংশে সশস্ত্র প্রতিরোধের পক্ষে সমর্থন বেড়েছে।

এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ফাতাহ দলের (পশ্চিম তীরের ক্ষমতাসীন দল যার প্যালেস্তেনিয়ান অথরিটি বা পিএ-র উপর আধিপত্য আছে) যুবনেতা রায়েদ ডেবি বলেন, “আমি এটা লক্ষ্য করেছি- মানুষের কথায়, তাদের গাড়িতে বাজানো গানে, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে, আমার ছাত্রদের মধ্যে তর্কের সময়।”

তিনি আমাকে বলেছিলেন এই হামলাগুলি ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল, ঠিক যেমন ইসরায়েলিদের জন্য ছিল ‘শকিং পয়েন্ট’।

তিনি বলেন, “জনসাধারণ, বিশেষত নতুন প্রজন্ম কিন্তু এখন হামাসকে সমর্থন করছে, এবং তুলনামূলক ভাবে এই সমর্থন আগের চেয়ে বেশি। গত ৩০ বছরে নতুন প্রজন্মের জন্য কোনও রোল মডেল ছিল না, কোনও আদর্শও ছিল না; এখন অন্তত অন্য রকম কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে তারা। একটা নতুন গল্পের সূচনা তারা দেখতে পাচ্ছে।”

এমনকি মি. রায়েদের বছর এগারোর ভাইপোও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রতি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নয়। বরং সে কিন্তু হামাসের সামরিক মুখপাত্র আবু উবাইদাকে আদর্শ বলে মনে করেন। রায়েদের কথায়, “যেহেতু তিনি (আবু উবাইদা) আমাদের রক্ষা করেন।”

পশ্চিম তীরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডঃ আমজাদ বুশকার বলেন, “ফিলিস্তিনি তরুণদের কিছু ইচ্ছে ছিল, সে সংক্রান্ত একটা তালিকাও ছিল। কিছু বিষয়কে তারা অগ্রাধিকার দিত। বাড়ি কেনা বা ডিগ্রি অর্জনের মতো বিষয়গুলি ছিল সেই তালিকায়।”

“কিন্তু আমি মনে করি, সাতই অক্টোবরের পর যে বিষয়গুলোকে তারা অগ্রাধিকার দিত, তা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বদেশের পূর্ণ মুক্তির জন্য আওয়াজ উঠছে- তা সে প্রতিরোধ শান্তিপূর্ণ হোক বা সশস্ত্র।”

ডঃ বুশকার আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি মোট নয় বছর ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছেন। অতীতে তিনি হামাসের ছাত্র শাখার সদস্যও ছিলেন। সাতই অক্টোবরের হামলার পর থেকে তাঁর পরিবারের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শুধুমাত্র ইসরায়েলি সেনাই নয়, সংসদ নির্বাচনে জেতার এক বছর পর ২০০৭ সালে জোর করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে হামাস সদস্যদের ধারাবাহিক ভাবে নিশানা করেছে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীও।

কিন্তু ডঃ বুশকার বলেছিলেন এখন কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর কথায়, “ফাতাহ এবং হামাস দুই জনেই ভাল করে জানে তারা একে অপরের পরিপূরক। আর আমি মনে করি, এই দুই আন্দোলনকে সত্যিই এক হতে দেখব আমরা।”

“প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি বুঝতে পেরেছে, হামাসকে নিশানা করলেও একে নির্মূল করা যাবে না কারণ এটা ফিলিস্তিনি জনগণের মনের গভীরে গেঁথে থাকা একটি মতাদর্শগত আন্দোলন। আর হামাসও এ বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন যে তারা ফাতাহ-র সাহায্য ছাড়া একটা স্বাধীন (ফিলিস্তিনি) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না,” বলছিলেন ডঃ বুশকার।

রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস বাদে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের একাধিক প্রবীণ ব্যক্তিত্ব এখন খোলাখুলি ভাবে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ফ্রন্টের সুবিধার কথা আলোচনা করছেন।

চলতি মাসের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ শাতায়েহ বলেন, গাজায় যে যুদ্ধ চলছে তাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পছন্দসই ফলাফল হবে যদি হামাস পিএ-র নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়।

রামাল্লাহ-র আল-কুদস মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হামাস বিশেষজ্ঞ কোসে হামেদ বলেন, গাজায় বর্তমান পরিস্থিতির ফলে হামাসের সামরিক বাহিনীর ক্ষতি হলেও আন্দোলনের রাজনৈতিক শাখা শক্তিশালী হতে পারে।

তিনি বলেন, “যে কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্দেশ্য হল তাদের সামরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যকলাপের বীজ বপন করা।”

ওই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “হামাসের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা রয়েছে। রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। আমি মনে করি, হামাসের মধ্যে রাজনৈতিক প্রবণতারও স্থান রয়েছে- বিশেষত, এই যুদ্ধের পরে, যখন তাদের প্রতি পুরো বিশ্ব আর সহনশীল থাকবে না।”

ইসরায়েল বলছে, গাজায় তাদের লক্ষ্য হল হামাসকে ধ্বংস করা। শুধু তাই নয়, গাজার যে সরকার আসতে চলেছে তাতে হামাসের বা ফাতাহ-র কোনও ভূমিকা থাকার সম্ভাবনাও ইসরায়েল উড়িয়ে দিয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “যারা সন্ত্রাসবাদ শেখায়, সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন করে তাদের আমি গাজায় প্রবেশ করতে দেব না। গাজা হামাস-স্তান বা ফাতাহ-স্তান হবে না।”

কিছু ফিলিস্তিনির মতে, হামাসের হামলার জন্য গাজাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু অন্যরা বলছেন, ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিতে ইসরায়েলকে বাধ্য করার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীটির নৃশংস কৌশল কিন্তু কাজে দিয়েছে। যদিও তা ৩০ বছর আগে, ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন গঠনের উদ্দেশ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির হওয়া ‘অসলো চুক্তি’র ঠিক বিপরীত।

ফিলিস্তিনি থিংক ট্যাংক প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ (পিএসআর) গত ২২ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে জানা গিয়েছে, তিন মাস আগের তুলনায় পশ্চিম তীরে হামাসের প্রতি সমর্থন তিন গুণ বেড়েছে।

হামাসের সমর্থকরা এখনও সংখ্যালঘু, তবে উত্তরদাতাদের ৭০% বলেছেন যে সশস্ত্র সংগ্রামই হল ইসরায়েলি দখলদারি অবসানের সবচেয়ে ভাল উপায়।

অন্যদিকে হামাসের হামলার পর প্রেসিডেন্ট আব্বাসের প্রতি সমর্থন দ্রুত হ্রাস পেয়েছে বলে ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে। ওই তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম তীরের ৯০ শতাংশেরও বেশি ফিলিস্তিনি তার পদত্যাগ দাবি করেছেন।

আমজাদ বুশকার বলেন, হামাসের হামলার পর থেকে বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনকে তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে।

‘ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং ‘অকর্মণ্য’ হিসাবে বিবেচিত পিএ হামাসের হামলার পর থেকে তার বেসামরিক কর্মচারী বা পুলিশ বাহিনীকে বেতন দিতে পারেনি। কারণ গাজায় যুদ্ধের ফলে রাজস্ব করের বিষয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে।

সম্প্রতি গাজায় আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয় ফিলিস্তিনি বন্দীদের। সে সময় ফিলিস্তিনি নাগরিকে ঠাসা প্রতিটি বাসের আশেপাশে হামাসের পতাকা ওড়ানো এবং স্লোগান দেওয়া ছিল চোখে পড়ার মত। যদিও সেখানে পিএ-র সভাপতি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা কিন্তু অনুপস্থিতই ছিলেন।

গাজায় হামাসের ক্ষমতার কথা ইসরায়েল অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু এই পশ্চিম তীরেও হামাসের প্রভাব ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *