পশ্চিমা রেনেসাঁর মহানবী সা: অধ্যয়ন । মুসা আল হাফিজ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ঐতিহাসিক অধ্যয়নের একটি ক্ষেত্র হতে পারে ইসলামের বিরোধী এমন বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণিবিভাগ, যারা নবী করিম সা:-কে উপলব্ধি করতে ভুলের দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। ইউরোপীয় ইতিহাসের বিখ্যাত সংস্কারক মার্টিন লুথারও এই ভুলের শিকার হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতকে এই প্রবণতা বিশেষ এক চরিত্র লাভ করে। তখন উসমানীয়দের সাথে ইউরোপীয়দের লড়াই নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। শক্তির ভারসাম্য ধীরে ধীরে পশ্চিমাদের দিকে হেলে পড়ছে। উসমানিদের প্রতি তাদের প্রচণ্ড ভয় ক্রমহ্রাসমান। ১৪ থেকে ১৭ শতক অবধি চলমান ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং ১৫১৭ থেকে ১৬৪৮ অবধি চলমান প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন পরিণতি লাভ করেছে। ইউরোপীয় জনসংখ্যার উপর রোমান ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্য কমে এসেছে। বুদ্ধিজীবীরা তখন স্বাধীনভাবে যেকোনো জিনিসকে প্রশ্ন করতে পারছেন।

ফলে ইউরোপে যুগ যুগ ধরে মহানবী সা: সম্পর্কে চলমান নেতিবাচক প্রচারণাও প্রশ্নের কবলে পড়ল। সময়টি ১৬২০ থেকে ১৭৮০; বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্বিবেচনার যুগ, আলোকায়নের কাল। এরপর ফ্রান্সে জন্ম নিলো নতুন তরঙ্গ, ১৮৮৯-এর ফরাসি বিপ্লব। এ বিপ্লবের প্রাণপুরুষদের একজন ছিলেন হেনরি ডি বোলেন ভিলিয়ার্স (১৬৫৮-১৭২২)। তিনি ছিলেন ফরাসি অভিজাত, সেনা কর্মকর্তা, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। ধর্মতত্ত্বও ছিল তার আগ্রহের বিষয়। তিনি রনে ডেকার্তে ও জন লকের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। তার বিখ্যাত একটি কাজ Histoire des Arabes avec la Vie de Mahomet (1731) যার ইংরেজি অনুবাদ The Life of Mahomet নামে বিখ্যাত। গ্রন্থটিতে তিনি যে সব পশ্চিমা কুসংস্কার প্রত্যাখ্যান করেন, তার মধ্যে আছে- ১. ধর্ম প্রবর্তনে মহানবী সা:-কে পথ প্রদর্শন করেন খ্রিষ্টান এক সহযোগী; ২. তাঁর ধর্ম ও মতাদর্শ অযৌক্তিক; ৩. তিনি মিথ্যা নবী, নবী হওয়ার ভান করতেন মাত্র।

হেনরি দেখান, পশ্চিমা প্রচারণায় এই সব মিথ্যাকে অব্যাহতভাবে উচ্চারণের ফলে এগুলো সত্যের মতো মনে হতে পারে ইউরোপে অনেকের কাছে। এই মিথ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি দাবি করেন- ১. মুহাম্মদ সা: ছিলেন একজন ঐশ্বরিক-অনুপ্রাণিত বার্তাবাহক; ২. খোদাতায়ালা তাকে প্রেরণ করেন রোমান ও পারস্যদের স্বৈরাচারী শাসন থেকে নিকট প্রাচ্যকে মুক্ত করার জন্য; ৩. ভারত থেকে স্পেন পর্যন্ত তাওহিদ বা খোদার অবিভাজ্য একত্বের বার্তা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন; ৪. তাঁর সাফল্য ছিল এমন, যা কেবল খোদার পক্ষ থেকেই আসতে পারে; ৫. মুহম্মদ সা:-এন ধর্ম কেবল সেই সময়ের প্রচলিত বিচারে খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত সমস্ত কিছুকে সরিয়ে দিয়েছে; ৬. তিনি সম্ভবত খ্রিষ্টধর্মের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সমস্ত উপাদানকে গ্রহণ করেছেন। আর যেসব উপাদানকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন, সেগুলো ছিল খ্রিষ্টানদের অপব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত। এ জন্য তার নিন্দা করা অসম্ভব।

হেনরির বইটি ক্যাথলিক দুনিয়ায় ঝড় বইয়ে দেয়। ক্যাথলিক গির্জা গোটা ফ্রান্সে বইটিকে নিষিদ্ধ করে। তার মৃত্যুর পরে বইটিকে টিকিয়ে রাখে প্রোটেস্ট্যান্ট কিছু লেখক। ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ১৭৩০ সালে আমস্টারডাম ও লন্ডনে বইটি প্রকাশিত হয়।

হেনরি ডি বোলেনভিলিয়ার্সের ঐতিহাসিক উপস্থাপনা রেনেসাঁর অন্যান্য চিন্তাবিদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষভাবে প্রভাবিত হন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)। একজন প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও ইতিহাসবিদ ভলতেয়ার ছিলেন রেনেসাঁর প্রভাবশালী ভাষ্যকারো। তিনি প্রতিষ্ঠিত রোমান ক্যাথলিক চার্চের ওপর আক্রমণ করেন। ধর্ম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তার সমর্থন ছিল অকুণ্ঠ। ইসলামের প্রতি তার বৈরিতা ছিল সুস্পষ্ট। হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে তার অন্যায্য নিন্দা মুসলিম দুনিয়ায় ক্ষোভের জন্ম দেয়। তার এ আক্রমণ ছিল চার্চ এবং পোপের ওপর তার আক্রমণের চেয়েও তীব্র, হিংসাত্মক। ১৭৩৬ সালে, তিনি লে ফ্যানাটিজম, ou Mahomet le Prophete (ধর্মান্ধতা, বা নবী মুহাম্মদ) নামে যে নাটক লিখেন, তা প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৭৪১ সালে। এতে তিনি আত্মগৌরব, মিথ্যা, খুন, স্বদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইত্যাদি অপবাদের স্তূপ তৈরি করেন মহানবী সা:-এর বিরুদ্ধে।

দু’টি চিঠিতে নবীজী সম্পর্কে একই মতামত প্রকাশ করেন ভলতেয়ার। একটি চিঠি লিখেন ১৭৪০ সালে প্রুশিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের প্রতি, আরেকটি চিঠি ১৭৪৫ সালে পোপ বেনেডিক্ট চতুর্দশের প্রতি। এরপর ভলতেয়ারের উপলব্ধিতে আসে বিবর্তন। ১৭৪৬ সালের দিকে তিনি পাঠ করেন বোলেনভিলিয়ার্সের ভিয়ে দে মহোমেদ গ্রন্থটি। যা নবীজী সম্পর্কে তার ধারণায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। ভলতেয়ার বুঝতে পারেন, মহামানবের প্রতি কী অন্যায় করেছেন তিনি!

পরবর্তী জীবনে ভলতেয়ার সত্য উচ্চারণে প্রয়াসী হন। বিশেষ করে কাস্টমস অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অব দ্য নেশনসের (১৭৫৬) মতো ঐতিহাসিক লেখাগুলোতে তিনি মহানবী সা: সম্পর্কে বিবৃতি দেন। দেখান, তিনি কত কার্যকর ও সহনশীল নেতা এবং কত সফল বিজয়ী। কিন্তু তিনি কি নবী ছিলেন? ভলতেয়ার বলেন, ‘একজন নেতা হিসেবে আপন সাফল্যের দ্বারা তিনি এতটাই বিচলিত হয়েছিলেন যে, নিজেকে তিনি ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত বলে বিশ্বাস করেছিলেন।’

জাঁ-জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) ছিলেন রেনেসাঁর আরেক ফরাসি দার্শনিক। বিখ্যাত Du contrat social বা সামাজিক চুক্তি (১৭৬২) গ্রন্থে তিনি স্বীকার করেন, প্রতারক বা জাদুকর হিসেবে মুহাম্মদ সা:-কে আখ্যায়িত করা অন্যায়। তিনি ছিলেন একজন প্রশংসনীয় আইনপ্রণেতা, যিনি সফলভাবে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক সামর্থ্যরে সমন্বয় করেছিলেন। [৫]

ফরাসি লেখক ও রাজনীতিবিদ ক্লদ-ইমানুয়েল পাস্তোরেতের (১৭৫৫-১৮৩০) জরোস্টার, কনফুসিয়াস ও মুহাম্মদ প্রকাশিত হয় ১৭৮৭ সালে। এতে তিনি প্রাচ্যের এই ‘মহান পুরুষ’, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের’ কর্মজীবনের মিল ও অমিল ব্যাখ্যা করেন। ‘হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে পশ্চিমের অভিযোগগুলোকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। কুরআনে আল্লাহর একত্বের দৃঢ়তর অভিব্যক্তিগুলোর জন্য ইসলামের প্রশংসা করেন।

তবে ফরাসি দিদ্বিজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) নবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন সবচেয়ে বেশি। নেপোলিয়নকে বলা হয় ফরাসি বিপ্লবের সন্তান। ১৭৯৮ সালের মে মাসে তিনি ফরাসি নৌবাহিনীর ৫৫ হাজার সেনার নেতৃত্বে মিসর ও সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। ১৭৯৮ সালের ১ জুলাই আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশের আগে মিসরীয় জনগণের কাছে তিনি যে বার্তা পাঠান, এর শুরুর কথা হলো-

‘পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহর নামে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই, [এবং] তাঁর প্রভুত্বে কোনো পুত্র বা শরিক নেই।’ আর বার্তাটির শেষ কথা হলো- আমরা কি সেই পোপকে ধ্বংস করিনি [১৭৯৬-৯৭ সালের ইতালীয় অভিযানের সময়] যিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি দিয়েছিলেন? আমরা কি মাল্টার নাইটদের ধ্বংস করিনি, যে ধর্মান্ধরা বিশ্বাস করেছিল, ঈশ্বর তাদের দ্বারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চান?

নেপোলিয়নের এই বার্তা স্বসেবামূলক ও প্রচারমূলক বক্তব্য ছিল। একে অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী প্রতারণাও বলা যেতে পারে। খুব সম্ভবত এটি ছিল নিছক ঠোঁটের পরিষেবা। কিন্তু বহু বছর পরে নেপোলিয়ন যখন সেন্ট হেলেনার প্রত্যন্ত দ্বীপে নির্বাসিত হন, তখন তিনি তার স্মৃতিকথায় হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা লিখেছিলেন। তার স্মৃতিকথার এই অকৃত্রিম অনুচ্ছেদটি লক্ষ করা যেতে পারে :

‘হজরত মুহাম্মদ সা: যখন আব্রাহাম, ইসমাইল, মুসা এবং যিশুখ্রিষ্টের খোদার ধর্ম প্রবর্তন করেন, তখন আরব ছিল মূর্তিপূজারী। আরিয়ান ও অন্যান্য সম্প্রদায় প্রাচ্যের প্রশান্তিকে বিরক্ত করেছিল, তারা পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের প্রকৃতি নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করেছিল। হজরত মুহাম্মদ সা: ঘোষণা করেছিলেন, এক অনন্য ঈশ্বর আছেন, যার পিতা বা পুত্র নেই; ত্রিত্ব নেই, মূর্তিপূজা নেই। তিনি কুরআনের সামনের অংশে লিখেছেন- ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই।’

তিনি অসভ্য, দরিদ্র জনগণকে সত্যদীক্ষা দিয়েছিলেন, যাদের সব কিছুর অভাব ছিল, যারা ছিল নিতান্তই অজ্ঞ। তিনি যদি তাদের আত্মাকে লক্ষ্য করে কিছু বলতেন, তারা শুনত না। তাদের আত্মার কান ছিল না। গ্রিসে প্রাচুর্যের মধ্যে চিন্তার আধ্যাত্মিক আনন্দের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মরুভূমির মাঝখানে, যেখানে আরবের দীর্ঘশ্বাস অবিরাম রোদন করছিল পানির ঝরনার জন্য, একটি খেজুরের ছায়ার জন্য, যে ছায়ায় সে আশ্রয় নেবে জ্বলন্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সূর্যের রশ্মি থেকে। … সেই আরবদের নায়ক হয়ে উঠলেন মুহাম্মদ সা:, একজন রাজপুত্র, যিনি তার চারপাশে দেশবাসীকে জড়ো করেছিলেন। কয়েক বছরে তার মুসলমানরা অর্ধেক পৃথিবী জয় করে নিলো। মুসা ও যিশুর অনুসারীরা বহু শতকে যা করেছিল, তারা এর চেয়ে বেশিসংখ্যক আত্মাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল মিথ্যা দেবতাদের কবল থেকে, … মুহাম্মদ সা: ছিলেন মহান এক মানব।’

ফরাসি বিপ্লবের প্রধান পুরুষরা দূর থেকে, অপরিচিত দৃষ্টি দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন হজরত মুহাম্মদ সা:-কে। তাদের বয়ান ও বয়নে থেকে গেছে ইসলাম উপলব্ধির সেই ভ্রান্তি, যা জন্ম নিয়েছে কেবলই পশ্চিমা উৎস থেকে ইসলাম বুঝার ফলশ্রুতিতে। তাদের কাছে কি ইসলামের সঠিক উপস্থাপনের কোনো প্রয়াস ও কণ্ঠস্বর ছিল? বোলেনভিলিয়ার্স, ভলতেয়ার, রুশো, পাস্তোরেট ও নেপোলিয়ন ইসলামকে দেখেছিলেন রেনেসাঁর চোখ দিয়ে। ভলতেয়ারে যদিও নিন্দার প্রাধান্য রয়েছে, তবুও তিনি বিবর্তিত হয়ে শ্রদ্ধা ঘোষণা করেছেন। পশ্চিমা রেনেসাঁ মহানবী সা:-কে অধ্যয়নে কেবল অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে। বাকি অর্ধেক পথ পাড়ি দিতে না পারার দায় যতটা রেনেসাঁর, ততটা মুসলিমদেরও।

লেখক : কবি, গবেষক 71alhafij@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *