নির্বাচন নিয়ে ভারতের ‘নসিহতে’ বাংলাদেশের তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন?

সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

তানহা তাসনিম বিবিসি

‘সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে ভারতের আহ্বানে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের তরফ থেকে সবশেষ বক্তব্যে দেওয়া ‘নসিহতের’ প্রয়োজন নেই।

“বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, এটা নিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না” উল্লেখ করে এই বিষয়ে দিল্লির ভূমিকাকে সম্পূর্ণ ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে, একইদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়। তিনদিন আগে ১৪ই ডিসেম্বর প্রকাশির আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টির উল্লেখ ছিল।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে অতীতে আয়োজিত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের সময় দেশটির সমর্থনমূলক অবস্থান, শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের মতো অন্তত তিনটি বিষয় এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার পেছনে ফ্যাক্টর হিসেবে থাকতে পারে।

শেষ তিনটি নির্বাচনে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকা

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন আয়োজিত তিনটি নির্বাচনই নানা কারণে বিতর্কিত ছিল। অভিযোগ আছে, এসব নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কখনো প্রত্যক্ষ, আবার কখনো পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।

এক্ষেত্রে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিকে পাশে পেতে দলটির তৎকালীন প্রধান এইচ এম এরশাদকে ‘হাসপাতালে রাখার’ প্রসঙ্গ টেনে আনেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ।

সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিলকে কেন্দ্র করে সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি প্রথমে বর্জনের ঘোষণা দিলেও পরে মি. এরশাদ হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে যায় দলটি।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যোগ দেওয়ার ফলে এটিকে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হিসেবে দাবি করে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচন নিয়ে এ টানাপোড়েনের সময় বাংলাদেশে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। এরশাদের সাথে বৈঠকও করেন তিনি।

“তাকে (এরশাদকে) বিরোধী ভূমিকা থেকে সরানো হয়েছে এবং এক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সশরীরে এখানে এসে ভূমিকা পালন করেছেন। সুজাতা সিং এখানে এসে সরাসরি জাতীয় পার্টিকে বাধ্য করেছে সরকারবিরোধী ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াতে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন আলতাফ পারভেজ।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর আওয়ামী লীগ সরকারকে “ভারত সরাসরি এন্ডোর্স করেছে” এবং ওই সরকারকে “নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সরাসরি সাহায্য করেছে” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ভারতের সমর্থনের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে জোরালো আপত্তি তোলেনি বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

২০২৪ সালের নির্বাচনের পরও ভারতসহ বেশ কিছু দেশ শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাকে অভিনন্দন জানান।

এর কয়েকদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিরোধীরা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে নির্বাচন ভন্ডুল করতে চাইলেও “ভারত পাশে দাঁড়িয়েছিলো”।

সংবাদ সম্মেলনে সেই প্রসঙ্গও টানেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “তারা জানে গত ১৫ বছর ধরে যে সরকার ছিল, সে সরকারের সাথে তাদের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল, তখন কিন্তু প্রহসনমূলক নির্বাচন নিয়ে তারা একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। এখন একটি ভালো নির্বাচনের দিকে আমরা যাচ্ছি, এই মুহূর্তে আমাদেরকে নসিহত করার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা জানি আমরা কী করবো”।

“আমরা একটা ভালো নির্বাচন করবো যেটাতে মানুষ ভোট দিতে পারবে এবং যাদের ভোট দেবে তারাই নির্বাচিত হবে- যেটা এর আগে ১৫ বছরে ঘটেনি”, বলেন তৌহিদ হোসেন।

বিগত সময়ের নির্বাচনে ভারতের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা আর হস্তক্ষেপের পর এই ধরনের মন্তব্যে প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন।

“আজকে যখন অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা হচ্ছে, তখন কেন ভারতের মুখ থেকে এসব কথা বের হয়”, প্রশ্ন তোলেন তিনি।

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন নিয়ে সন্দেহ

গত বছরের পাঁচই অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশ ছাড়েন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশের তরফ থেকে বিচারের জন্য একাধিকবার তাকে ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। সবশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে আবারও তাকে ফেরত চেয়ে দিল্লির কাছে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো সাড়া দেয়নি দেশটি।

বরং ভারতের কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকে। সেখান থেকেই ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে’ দলটি কাজ করে যাচ্ছে বলেও বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বারবার ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের কথা বলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দিকেই ভারত ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

এনিয়ে মিজ মহসিন বলেন, সাধারণ চোখে দেখলে মনে হয়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নেওয়ার কথা বলছে দেশটি।

অন্যদিকে প্রতিহিংসার যে রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, সে জায়গা পরিবর্তন করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন আলতাফ পারভেজ।

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবিষয়ে কথা বললেও এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না যেটা ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। আর তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “অতীতে তাদের সুপারিশ নিরপেক্ষ নির্দলীয় ছিল না”।

“যেহেতু ভারত বলছে, মানুষ ধরেই নিয়েছে আওয়ামী লীগ যাতে অংশগ্রহণ করে সেই লক্ষ্যেই কথাটা বলছে। ফলে ভারত সঠিক-সত্য কথা বললেও মানুষ এটা গ্রহণ করছে না”, বলেন তিনি।

তবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের বিষয়টিকে ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থের’ দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।

“ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের যে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা আছে এবং বাংলাদেশ সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে ধরনের আস্থার জায়গা বিজেপি তৈরি করতে পেরেছিল, সেই জায়গায় ঘাটতি আছে”।

“এই ঘাটতি পূরণের জন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের ইলেকশনে ফিরে আসার এবং আওয়ামী লীগকে যদি রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা যায়, সেটা ভারতের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পলিটিক্যাল মাইলস্টোন (রাজনৈতিক অর্জন) হিসেবে দাঁড়াবে”।

“সুতরাং এই রাজনৈতিক মাইলস্টোনের জন্য হলেও এক ধরনের ইনিশিয়েটিভ (উদ্যোগ) আমরা সবসময়ই দেখতে পাই”, বলেন তিনি।

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ

কেবল নির্বাচনই নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের ‘অযাচিত’ হস্তক্ষেপও তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

বিশেষ করে বাংলাদেশবিরোধী যেসব কথাবার্তা ভারতের রাজনীতি কিংবা গণমাধ্যমে আসে, সেগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো রকমের পদক্ষেপ ভারতে দেখা না যাওয়ায় এই প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে দেখছেন সাহাব এনাম খান।

একইসাথে বাংলাদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘উগ্রবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করার একটা প্রবণতাও ভারতের তরফ থেকে দেখা যায় বলেও মনে করেন তিনি। “সেটাও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিতে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে”।

এছাড়াও বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে খুব একটা আগ্রহী দেখা যায়নি ভারতে।

ফলে গত ১৬ মাসে ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সে জায়গা থেকে ভারতের বারবার নির্বাচন নিয়ে মন্তব্যে বাংলাদেশের তরফ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *