নিরবে চলে গেলেন সাংবাদিক আশিক মোহাম্মদ

যুক্তরাজ্য সময় সংবাদ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন
সাঈদ চৌধুরী
দৈনিক সিলেটের ডাকের সাবেক সিনিয়র সাব এডিটর আশিক মোহাম্মদ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখ শুক্রবার ভোর রাতে পূর্ব লন্ডনের বেথনালগ্রীণ এলাকার বাসভবনে ইন্তেকাল করেছন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ’ন।  শনিবার বাদ জোহর ব্রিকলেন জামে মসজিদে তার নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।
সাংবাদিকতা জীবনে আশিক মোহাম্মদ সিলেটের ডাকে সবেচেয়ে বেশি সময় কাজ করেছেন। তখন থেকে ছিলাম ঘনিষ্ঠ। লন্ডন আসার পর মিডিয়াপাড়া থেকে খানিক দূরে ছিলেন। কারণ কখনো খুলে বলেননি। নিজের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে সবসময় এক ধরনের সংকোচতা লক্ষ্য করেছি। কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। শান্ত ও নির্জনতাপ্রিয় ছিলেন। আর ইন্ট্রোভার্ট মানুষ সাধারণত নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। একারনেই কিছু মানুষ তাকে ভুল বুঝেন।
সোশ্যাল প্ল্যাটফরম ম্যাক্স মিডিয়া লন্ডনের স্বত্বাধিকারী অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার যখন সিলেটের ডাকে নির্বাহী সম্পাদক তখন এনামুল হক জুবের ও আশিক মোহাম্মদ ছিলেন তার দুই সিপাহসালার। জাতীয় দৈনিকগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে তারা সিলেটের ডাকের সার্বিক প্রকাশনায় সক্রিয় ছিলেন। তখন অগ্রসর সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন, সমরেন্দ্র বিশ্বাস সমর, মাহবুব রহমান মাহবুব, হাবিবুর রহমান, আহমেদ শামীম, গোপেন দেব, পুলিন রায়, জাবেদ আহমদ, সালেহ আহমদ খান প্রমুখ নিয়ে তাদের শক্তিশালী টিম ছিল।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক এনামুল হক জুবের ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। তার কাজের ধরণ অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। নিজের লেখার পাশাপাশি একঝাঁক তরুণের ভেতর থেকে অসাধারণ সব প্রতিবেদন তিনি আবিষ্কার করতেন। আশিক মোহাম্মদ এক্ষেত্রে নিউজ ডেক্সে সম্বয় ও নিজের রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত দেখা যেত।
১৯৯৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনের প্রিন্স চাল্সের (বর্তমানে কিং চাল্স) সিলেট সফর কালে প্রবাসীর কথা গ্রন্থের লেখক বিশিষ্ট গবেষক নুরুল ইসলামকে নিয়ে সিলেটের ডাকে প্রবাসীদের ইতিহাস তুলে ধরার আয়োজন করি। আমি তখন দৈনিক জালালাবাদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। তবুও সাত্তার ভাই সহ সিলেটের ডাকের সিনিয়র সাংবাদিকগন আমাদের পূর্ণপৃষ্ঠা লেখা ও শুভেচ্ছাবানী প্রকাশ করেছেন।
দৈনিক জালালাবাদে আমরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। সিলেটের ডাকের উন্নত ছাপাখানা ছিল। জালালাবাদে সেটা ছিলনা বলে প্রথমদিকে প্রতিদিন রাতে আমি ডিজাইন নিয়ে ঢাকায় যেতাম আর ভোরে পত্রিকা নিয়ে ফিরতাম। পরে নিজস্ব ছাপার ব্যবস্থা হয়েছে। এমন প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাঝেও আমাদের হার্দিক সম্পর্ক ছিল। মাঝে মধ্যে জালালাবাদে বা ডাক অফিসে আড্ডাও হত।
সিলেটের ডাকের আড্ডায় উপস্থিত সকলে আনন্দ উল্লাসে উৎফুল্ল হলেও আশিক মোহাম্মদ একটা হালকা হাসি দিয়ে সামান্য কথা বলে কোন না কোন কাজে লেগে যেতেন। এতে ধারণা হয়েছিল, আমার প্রতি অন্যদের মত আগ্রহ বা আন্তরিকতা হয়ত তার নেই।
১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে একদিন জালালাবাদ থেকে বেরিয়ে মধুবন মার্কেটের সামনে এসে আশিক মোহাম্মদের সাথে দেখা। বললেন. সুখবর আছে, অফিসে চলেন। নিয়ে গেলেন চারতলায় সিলেটের ডাকে। দেখালেন, ‘সাঈদ চৌধুরীর ছায়াপ্রিয়া উপন্যাস সম্পর্কে দু’টি কথা’ শীরোনামে কে কে পাল স্যারের ( প্রিন্সিপাল কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী) পূর্ণপৃষ্ঠা লেখা যাচ্ছে। আমি দারুণ খুশি হলাম। সেদিন মনে হল আশিক মোহাম্মদ আমার চেয়ে বেশি খুশি।
আসলে কে কে পাল স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠার পর একদিন বাসায় গিয়েছিলাম। তাঁর জীবনের অনেক স্মৃতিময় ঘটনা বললেন। বাংলাদেশ বেতারের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও গবেষক আহমদ-উজ-জামান আমার উপন্যাস ‘ছায়াপ্রিয়া’ নিয়ে দৈনিক জালালাবাদে বহুদিন আগে (২.১১.১৯৯৫) একটি লেখা ছাপেন ‘আমার নোট থেকে’ শীরোনামে তাঁর নিয়মিত কলামে। কে কে পাল স্যার লেখাটির প্রশংসা করেন এবং তাঁকে বইটি দিতে বলেন। আমি ঐদিনই পৌছে দেই। কয়েক দিন পরে সিলেটের ডাকে স্যারের এই লেখাটি ছাপা হয়। এটা আমার জন্য সত্যিই একটা স্মরনীয় ঘটনা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আশিক মোহাম্মদের সাথেও আমার একটি ভুল ধারনার অবসান ঘটল। আর যুক্ত হল সম্পর্কের নতুন মাত্রা।
গত এপ্রিলে অজয় দ্যার আমন্ত্রণে তার বাসায় গিয়েছিলাম। ‘সাঈদ চৌধুরী: একজন প্রিয় মানুষ ও তাঁর সাহিত্যকর্ম’ শিরোনামে আমার সম্পর্কে তিনি লিখেছেন। সেটি নিজে পড়ে শুনালেন। আমার গল্পগ্রন্থ ‘আলোক ঝরনাধারা’ নিয়ে অসাধারণ এই লেখা উপহার দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা পানে আবদ্ধ করেছেন।
আসার সময় বেথনালগ্রীণ ষ্টেশনে আশিক মোহাম্মদের সাথে দেখা ও সংক্ষিপ্ত কথা হয়েছিল। গত শনিবার সন্ধ্যারাতে সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার ও গীতিকার অজয় পাল চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর আজ চলে গেলেন আশিক মোহাম্মদ ।
তিন বছর বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তানের জনক সাংবাদিক আশিক মোহাম্মদ দীর্ঘদিন যাবত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। কয়েক দফা অপারেশন হয়েছে। কিন্তু ঠিকমত সুস্থ হয়ে ওঠেননি। চলে গেছেন মহান মাবুদের দরবারে। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *