নিবন্ধন সংক্রান্ত আপিল মামলার রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতের সংবাদ সম্মেলন

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সুপ্রিম কোর্টে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন সংক্রান্ত আপিল মামলায় প্রদত্ত রায়ের প্রতিবাদে ২১ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এতে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমীর আবদুর রহমান মুসা প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জামায়াতে ইসলামী ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন লাভ করেছিল। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে নিবন্ধনের বিরুদ্ধে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। এই রিটটি শুনানির জন্য তালিকায় আসে। তখন দুই জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে নিবন্ধন মামলার শুনানি শুরু হলে বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মামলাটির সঙ্গে সাংবিধানিক বিষয় জড়িত বিধায় বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করার জন্য প্রধান বিচারপতির নিকট আবেদন করেন। প্রধান বিচারপতি মামলাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে জামায়াতের নিবন্ধন মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টের ৩ জন বিচারপতির সমন্বয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন। উক্ত বেঞ্চে দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্ট রিটের নিষ্পত্তি করে রায় প্রদান করেন। একজন বিচারপতি জামায়াতের নিবন্ধন বহাল রাখেন। অপর দুইজন বিচারপতি জামায়াতের নিবন্ধনটি আইনগত এখতিয়ার বহির্ভূত ও বেআইনি বলে রায় প্রদান করেন। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দুই মাসের মধ্যে আপিলের সার-সংক্ষেপ জমা দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। ‘ডিফল্টার’ হলে জামায়াতের আপিল খারিজ হয়ে যাবে বলেও উল্লেখ করা হয়। জামায়াত নির্দিষ্ট সময়ের ৭ দিন পূর্বে আদালতে সার-সংক্ষেপ জমা দেয়।

মামলার নতুন প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জামায়াত নেতা বলেন, গত ১০ জুন ইঞ্জিনিয়ার ইনষ্টিটিউশনে জামায়াতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে, যারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের জন্য হাইকোর্টে রিট করেছিল, তারাই জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতার উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ও জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে দুটো পিটিশন দায়ের করে। ওই পিটিশন দু’টি শুনানির জন্য বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে আদালত ১৯ নভেম্বর আপিল মামলা ও পিটিশন শুনানির দিন ধার্য করেন। হরতাল ও রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে জামায়াতের আইনজীবীগণ শুনানির জন্য সময় আবেদন করেন। আপিল বিভাগ সিনিয়র আইনজীবীর এ্যাজর্নমেন্ট পিটিশন রিজেক্ট করে আপিল মামলাটি ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ ঘোষণা করেন। সেই সাথে জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতার উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন ও আদালত অবমাননার আবেদন উভয় পিটিশনটি আপিল বিভাগ খারিজ করে দেন। নিবন্ধন মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে জামায়াতে ইসলামী। আপিলকারী হিসেবে বক্তব্য শোনার সুযোগ না দিয়ে মামলাটি ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ করে দেয়ায় জামায়াতে ইসলামী ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য না শুনে তার দায়ের করা আপিল ডিসমিস করা ন্যায় বিচারের মানদণ্ড কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের জনগণ এ রায়ে বিস্মিত এবং হতবাক। পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য ইতোমধ্যেই আইনজীবীগণকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জামায়তের আইনজীবীগণ সংবিধান, আইন ও নজির অনুযায়ী পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতি নিকটে। সকল রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ও নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য আন্দোলন চলছে। বন্ধু দেশসমূহ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব এবং জাতিসংঘ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জোর তাগিদ দিয়ে আসছে। একটি নির্বাচন মুখী দল হিসেবে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ভোটার রয়েছে। নির্বাচনের পূর্বে আপিল বিভাগের প্রদত্ত রায়টি দেশের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ভোটারের ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। জনগণের রাজনৈতিক ও ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত আপিল খারিজের মাধ্যমে জামায়াতকে নির্বাচনে দলীয়ভাবে ও দলীয় প্রতীকে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ করার অধিকার আছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে। জামায়াতের মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ করার ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বাধা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। জামায়াতে ইসলামী দেশের মানুষের কল্যাণে ন্যায় বিচার, আইনের শাসন, মানবাধিকার, জনগণের ন্যায্য ভোটাধিকার, দুর্নীতি-দুঃশাসন মুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার আন্দোলন এবং সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।

জামায়াত ঘোষিত কর্মসূচিসমূহ শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনের সর্বস্তরের জনশক্তি, সুধীমহল ও দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে ভারপ্রাপ্ত আমীর বলেন-  বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের সর্ব বৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর থেকে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জামায়াত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও ২০০১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা দেশবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় আন্দোলনে বিশ্বাসী। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে। কোনো ধরনের অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক ও মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মসূচিতে জামায়াত অভ্যস্ত নয়। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা শক্তিশালী ও মজবুত করার লক্ষ্যে জামায়াত সর্বদাই নির্বাচনমুখী তৎপরতা চালিয়ে আসছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য জামায়াত সর্বপ্রথম কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার ধারণা জাতির সামনে উপস্থাপন করে। এই ধারণাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর ভিত্তিতে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান আরো বলেন, বাংলাদেশের বিগত ১১টি জাতীয় সংসদের মধ্যে অধিকাংশ সংসদে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াতের বিপুল সংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হয়ে জনগণের সেবা করছেন। তিনি উল্লেখ্ করেন, জামায়াতে ইসলামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৮৬ সালে ১০টি, ১৯৯১ সালে ১৮টি ও ২ জন মহিলাসহ ২০টি, ১৯৯৬ সালে ৩টি, ২০০১ সালে ১৭টি ও ৩টি মহিলা আসনসহ ২০টি এবং ২০০৮ সালে ২টি আসনে বিজয় অর্জন করে। ২০০১-২০০৬ সময়ে জামায়াতের দুইজন মন্ত্রী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে সততা, স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও জামায়াতের দুইজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ন্যূনতম অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি। জামায়াত নেতৃবৃন্দের এই সততা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জামায়াত কঠোর অবস্থান তুলে ধরে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর বলেন, চরমপন্থা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জামায়াতের অবস্থান দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার। ২০০৫ সালে জঙ্গিবাদের উত্থান হলে জামায়াত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। জঙ্গিবাদ বিরোধী অবস্থান নেয়ার কারণে জামায়াত নেতা বিশিষ্ট সাংবাদিক শেখ বেলাল উদ্দিনকে খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করার কারণে ঝালকাঠীর পিপি ও জামায়াত নেতা এ্যাডভোকেট হায়দার আলীকে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের হামলায় জামায়াতের ৬ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান, আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী।

দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জামায়াত সবসময়ই সোচ্চার দাবি করে জামায়াত নেতা বলেন- গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় জামায়াত আপসহীন ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জামায়াতের ভূমিকা আপসহীন। বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী প্রতিবেশী দেশের ভূমিকার বিরুদ্ধে জামায়াত সর্বদাই সোচ্চার। টিপাইমুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা ও সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে জামায়াতের সতর্ক ও প্রতিবাদী অবস্থান সর্বজন বিদিত। জামায়াত সর্বদাই জনগণের পাশে থেকে সেবা করার চেষ্টা করেছে। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা, করোনাকালে চিকিৎসা সেবাসহ আর্থিক সহায়তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে জামায়াত জনগণের পাশে থেকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছে। আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলন চলমান থাকবে এবং জামায়াতের লক্ষ লক্ষ কর্মী ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াতি তৎপরতা অব্যাহত রাখবে ইনশআল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *