ধানখেতে দাঁড়িয়ে ‘রিভিউ আবেদন’, প্রার্থী পরিবর্তনে কতটা সাড়া দেবে বিএনপি

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

রাকিব হাসনাত বিবিসি

বাংলাদেশের ফেনীর একটি সংসদীয় আসনে দলের পক্ষ থেকে প্রার্থীর নাম ঘোষণার পর সেটি পুনর্বিবেচনার জন্য ক্রিকেটীয় স্টাইলে ‘রিভিউ’ আবেদন করে আলোচনায় এসেছেন ফেনীর একজন বিএনপি নেতা। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ ধানখেতে দাঁড়িয়ে মাথায় হ্যাট পরিহিত ওই নেতা ক্রিকেটের আম্পায়ারদের মতো করে রিভিউ আবেদন করছেন।

জেলা বিএনপির ওই নেতার নাম আলাল উদ্দিন আলাল এবং তিনি ফেনী জেলা বিএনপির সদস্যসচিব। বিএনপির রাজনীতিতে ফেনী জেলা দলীয় চেয়ারপার্সন ‘খালেদা জিয়ার জেলা’ হিসেবে পরিচিত। মি. আলাল নিজেই তার ‘রিভিউ আবেদনের’ ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।

“আমি জেনারেশন জেড এর দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে অহিংস পন্থায় মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য দলের হাইকমান্ডের কাছে রিভিউ আবেদন করেছি,” বলছিলেন তিনি। অবশ্য মি. আলাল তার ভাষায় ‘অহিংস পন্থায় রিভিউ’ আবেদনের কথা বললেও দলের মনোনয়ন তালিকা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস প্রতিবাদ হয়েছে এবং কিছু জায়গায় দলের স্থানীয় নেতাকর্মী ও সমর্থদের মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়েছে।

ঢাকায় দলের নেতারা জানিয়েছেন, মাঠ পর্যায়ে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কিংবা বিরোধিতার কথা চিন্তা করেই প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সময় দল থেকে জানানো হয়েছে যে ওই তালিকায় ‘যে কোনো সময় পরিবর্তন’ আসতে পারে।

দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু অবশ্য বলেছেন, প্রার্থিতা নিয়ে কোথাও কোনো সমস্যা হলে আলোচনার মাধ্যমেই তার সমাধান করা হবে। “মহাসচিব কিন্তু বলেছেন যে এটি সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা। এতেও পরিবর্তন আসতে পারে। কোথাও সমস্যা হলে আলোচনায় সমাধান হবে, না হলে দল যথাযথ ব্যবস্থা নেবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সাব্বীর আহমেদ বলছেন, এখন পর্যন্ত মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির ভেতরে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সেটি তার মতে ‘একটি বড় রাজনৈতিক দলের জন্য স্বাভাবিক’ বলেই মনে করেন তিনি।

আলাল উদ্দিনের রিভিউ আবেদন

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত তেসরা নভেম্বর ঢাকায় দলের স্থায়ী কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে আগামী নির্বাচনের জন্য মোট ২৩৭ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামের তালিকা ঘোষণা করেন। পরে মাদারীপুরের একটি আসনে মনোনয়ন স্থগিত করা হয়েছে।

ঘোষিত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী ফেনীর তিনটি সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন–– দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া (ফেনী-১), জয়নাল আবদীন (ফেনী-২) এবং আব্দুল আউয়াল মিন্টু (ফেনী-৩)। এর মধ্যে খালেদা জিয়া ও জয়নাল আবদীন আগেও বেশ কয়েকবার এই দুই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জয়নাল আবদীন ছাড়াও আরও অন্তত ছয়জন ফেনী-২ আসনের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন আলাল উদ্দিন আলালও। এদের মধ্য থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করার আগে তাদের সবাইকে নিয়ে ভার্চুয়ালি আলোচনা করেছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পরে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর ওই দিনই সন্ধ্যা ৭টা ১৮ মিনিটে জেলা বিএনপির সদস্য আলাল উদ্দিন আলাল ফেসবুকে ‘দলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত’ এমন পোস্ট দেন।

ওই তালিকা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন পাননি এমন কিছু নেতার অনুসারীরা সহিংসতায় জড়িয়েছে। আবার কারও কারও অনুসারীরা মিছিল, সমাবেশ কিংবা সড়ক অবরোধ করে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তালিকা ঘোষণার ছয় দিন পর ভিন্নধর্মী এক আবেদন করে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন ফেনীর আলাল উদ্দিন আলাল।

ক্রিকেটের রিভিউ আবেদন (আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদনকে ক্রিকেটে রিভিউ আবেদন বলা হয়) স্টাইলে সামাজিক মাধ্যমে ছবি পোস্ট করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেনারেশন জেড প্রজন্মকে মাথায় রেখেই তিনি এভাবে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন।

“এক সময় ক্রিকেট খেলতাম, আর এখন জেনারেশন জেডরা আলোচনায়। সে কারণেই প্রচলিত পন্থার প্রতিবাদ পরিহার করে এভাবে প্রতিবাদ করলাম। আমি চাই আমাকে মনোনয়ন না দিলেও নতুন প্রজন্মের কাউকে দেওয়া হোক,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. আলাল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলের সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিয়েছেন কিন্তু তিনি চান সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা হোক।

প্রতিবাদ মতবিরোধ বিভিন্ন জেলায়

তেসরা নভেম্বর মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই বেশ কিছু জেলায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন অংশ। ওই দিনই দলটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী মনোনয়ন না দেওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আলোচনায় এসেছিলেন তার সমর্থকরা।

মাদারীপুর-১ আসনে মনোনয়ন না পাওয়া এক প্রার্থীর সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছে। এসময় সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ওই আসনে শুরুতে জামান কামাল নুরুদ্দিন মোল্লাকে মনোনয়ন দিয়ে পরে স্থগিত করেছে বিএনপি।

কুমিল্লা-১০ আসনে মনোনয়ন পাননি এমন একজন বিএনপি নেতার সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে গত বুধবার। এ সময় তারা ওই আসনে আব্দুল গফুর ভুঁইয়ার নাম ঘোষণার প্রতিবাদ করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্লোগান দিয়েছেন।

বুধবার ঢাকা-১২ আসনে সাইফুল আলম নীরবকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ওই এলাকার আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারের সমর্থকরা।

মেহেরপুরে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আমজাদ হোসেনের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দলের আরেকটি অংশ। তারা দলের আরেকজন নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত, যিনি দলের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

গাজীপুর-৩ আসনে বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দলের সহস্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চুর নাম ঘোষণা করেছে। তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে দলের আরেকজন নেতার অনুসারীরা।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সরোয়ার আলমগীরের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছে ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আজিম উল্লাহ বাহারের অনুসারীরা। মি. বাহার ২০১৮ সালে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন।

ওদিকে চাঁদপুর-৪ আসনে বিএনপি নেতা এম এ হান্নানের অনুসারীরা কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। বিএনপি দলীয় নেতা হারুনুর রশীদকে ওই আসনে প্রার্থী করেছে।

দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যদিও বলছেন এ ধরনের বিরোধিতা বা প্রতিক্রিয়া খুব বেশি জায়গায় হয়নি। “বিএনপি একটি বড় দল। প্রতিটি আসনে একাধিক যোগ্য নেতা আছেন। যেখানে সমস্যা হয়েছে সেখানে আলোচনার মাধ্যম সংকট নিরসন করা হবে। সবাইকে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। না হলে দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে,” বলছিলেন তিনি।

বিশ্লেষক সাব্বীর আহমেদ বলছেন, যেটুকু সমস্যা হয়েছে তার সমাধান বিএনপির জন্য কঠিন হবে না বলেই তিনি মনে করেন। “যারা মনোনয়ন পায়নি তারা হয়তো সামনে অন্য কিছু পাওয়ার চেষ্টা করবে। আবার দলের জন্য যাদের ত্যাগ আছে তাদেরকে মূল্যায়নের অঙ্গীকার তো দলটির দিক থেকে আছেই। তাই এটা বিএনপির জন্য সমস্যার কোনো বিষয় হবে বলে মনে হয় না,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *