দ্য সিটি অফ ডেড : মৃত্যু কত সুন্দর!

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

“বাল বিখারকে টুটি কবরোঁ পর, জব কোঈ মাহজাবিন রোতি হ্যায়,
মুঝকো আকসার খেয়াল আ’তা হ্যায়, মউত কিতনি হাসিন হোতি হ্যায়!

বাংলা অর্থ: এলোমেলো চুলে কোনো সুন্দরী যখন কবর জড়িয়ে ধরে কাঁদে
তখন আমার বার বার মনে হয়, আহা, মৃত্যু কতই না সুন্দর!

যৌবনে পড়া ওপরের উর্দু কবিতাটি মৃত্যুকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। রাজেশ খান্না ও অমিতাভ বাচচান অভিনীত “আনন্দ” ছায়াছবি দেখে মৃত্যুভীতি চলে গিয়েছিল। অন্যকেও মৃত্যুতে ভীত না হতে নসিহত করি।

মৃত্যু নিয়ে আমি রসিকতা করি। তাতে আমার প্রিয় মানুষেরা অস্বস্তি বোধ করেন। আলোচনার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলেন। কবিতায় মৃত্যুর প্রকাশ এত সুন্দর, যা অন্য কোনো ভাবে ব্যক্ত করা সম্ভবত কঠিন।

কারো মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে যে বাক্যটি উচ্চারণ করি: “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন,” অর্থ্যাৎ “আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই তার কাছে ফিরে যাবো।” আমরা যদি একথা স্বীকার করি, তাহলে মৃত্যুতে ভয় করে লাভ কি? বরং মৃত্যু নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করাই সঙ্গত। আমরা আরো জানি, “কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত।” অর্থ্যাৎ “প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।”

এই অনিবার্যতা স্বীকার করার পরও কেউ আপনজনকে ছেড়ে যেতে চায় না, আপনজনকে হারিয়ে কেউ আনন্দিতও হয় না। তবে হ্যাঁ, অনেক মৃত্যু জটিলতাও সৃষ্টি করে। একটি প্রবাদ আছে: “কেউ যদি মরণের হিক্কা তোলে, তার সন্তানেরা মরণাপন্নের সিন্দুকের চাবির সন্ধান করে।”

আবার অনেকের মৃত্যুতে দেখা যায়, মৃত যখন জীবিত ছিল, তখন কেউ তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, সেও মৃতের পাশে আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। মৃত যদি এই দৃশ্য দেখতে পেত, তাহলে নিশ্চয়ই বলতো:
“লিপট কর মেরি কবর সে, ফুল বরসানে কে বা’দ,
রো পড়া ওহ বেওয়াফা ভি, মুঝ কো দাফনানে কে বাদ!”
বাংলা: কবরের ওপর ফুল ছিটানোর পর আমার কবর আঁকড়ে ধরে,
আমার দাফন করার পর সেই প্রতারকও অশ্রু ঝরাতে থাকে!

সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে বিভিন্ন কবরস্থানের কর্তৃপক্ষের চিঠি আসে। আসলে এ ধরনের চিঠি ৬৫ পার হওয়ার পর থেকে আসতে শুরু করেছে। সেসব চিঠিতে কবরস্থানের কি মনোরম ছবি। সারি সারি কবর। পুরো এলাকা জুড়ে হাজারো বাহারি বৃক্ষ, মওসুমী ফুলের কেয়ারি। হেমন্তে গাছের পাতার রং বদলানোর সৌন্দর্য।

দেখেই মন ভরে যায়। প্রতিটি কবর যে কত যত্মে সংক্ষণ করা হয় তার বিবরণ থাকে চিঠিতে। এমন কবরস্থানের একটি কবরে চিরদিনের জন্যে শুয়ে থাকার কথা ভেবে অভিভূত হই। জীবদ্দশায় তো শুধু এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানা বদল করেছি। এক বাড়ি ছেড়ে আরেক বাড়িতে উঠেছি। কর্মস্থলের পরিবর্তন ঘটেছে। এখানে সেসবের বালাই নেই।

আজকেও একটি কবরস্থানের পক্ষ থেকে চিঠি পেয়েছি। নিউইয়র্কের অদূরে লং আইল্যাণ্ডের ফার্মিংডেল এলাকায় ২,৩০০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত ‘পাইনলন মেমোরিয়াল পার্ক এন্ড আরবোরিটোম’। যদিও এটি একটি কবরস্থান, কিন্তু এর নামে “কবরস্থান” শব্দটি নেই। এটি গ্রেটার নিউিইয়র্ক এলাকার অন্যতম ব্যয়বহুল একটি কবরস্থান, যেখানে সব ধর্মের লোকজনের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরোপুরিই ধর্মনিরপেক্ষ কবরস্থান।

খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী মৃতকে কবরস্থ করার স্থানকে ‘কবরস্থান’ বা ‘গ্রেভইয়ার্ড’ এর পরিবর্তে বলা হয় ‘সেমিটারি’ বা ‘বিশ্রামস্থল’ অথবা ডরমিটরি, যা একেবারেই সাময়িক আবাস। যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থানের স্মরণেই খ্রিস্টান মৃতেরা কবরে সাময়িক সময়ের জন্য কাটায়। অনেকে নিয়মিত তাদের প্রিয়জনের কবরে যায়, ফুল দেয় ও অশ্রু বিসর্জন করে বলে, “তোমাকে আমার প্রয়োজন। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না,” এ ধরনের বিলাপকে যিশুর প্রতিশ্রুতির প্রতি অনাস্থা বিবেচনা করা হয়।

১২১ বছরের প্রাচীন মনোরম ‘পাইনলন মেমোরিয়াল পার্ক এন্ড আরবোরিটোম’ এর বর্ণনা ও ছবিগুলো দেখার পর থেকে মনে হতে থাকে, আহা এখানে যদি একটি স্থায়ী জায়গা জুটতো, নানা ধরনের ফোয়ারা থেকে উত্থিত পানির ধারা, গ্রীস্মের সবুজ শ্যামলিমা, মওসুমী ফুল, হেমন্তের পাতার রং বদলানো উপভোগ করতে আর দূরে কোথাও যেতে হতো না। কি শান্তিময় পরিবেশ!

কিন্তু এখানে শুধু বিত্তবানদের মৃতের পক্ষেই আসা সম্ভব। কবরস্থানের যে জায়গাগুলো মানুষের বেশি পছন্দ, সেগুলো মূল্য অধিক। ২০২০ সালে যেখানে ৭,৪৯৫ ডলার ছিল, তা বেড়ে এখন ১০,৯৯৫ ডলার। কবরের ওপর মৃতের এপিটাফের আকার, পাথর, মার্বেল বা ধাতব হবে কিনা – এসবের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে ৭,০০০ ডলার থেকে ১০,০০০ পর্যন্ত। আরো খরচ আছে। রোববার কবর দিতে হলে অতিরিক্ত ফি ১,৮৭৮ ডলার। শনিবার হলে অতিরিক্ত ৬০০ ডলার। কবরের চারপাশে সিমেন্টের লাইনার দিতে ৭২৮ থেকে ৯০০ ডলার।

চার প্রজন্ম ধরে একটি পরিবারের মালিকানাধীন ‘পাইনলন মেমোরিয়াল পার্কে’ প্রতিটি কবরের মূল্য অনেক। কবরস্থান সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে, বিজ্ঞাপন দিতে তারা বছরে এক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এর প্রেসিডেন্ট জাস্টিন লকের বেতন বছর ৫০০,০০০ ডলার। তার স্ত্রী আলেকজান্ড্রার বেতন ৩০০,০০০।

কবরের যে শেয়ার তা থেকে পরিবারের আরো কিছু সদস্য বছরে ২.২ মিলিয়ন ডলার অর্থ্যাৎ ২২ লাখ ডলার মুনাফ লাভ করেন। কবরস্থানের মোট শেয়ার সংখ্যা ১২৭,৫৮০টি, যার মধ্যে মালিক পরিবারের হাতে শেয়ারের সংখ্যা ৫১,৯৬৪টি। বছরে দু’বার ঘোষণা করা হয় ডিভিডেন্ড বা মুনাফা। ২০১৯ সালে প্রতি শেয়ারে ডিভিডেন্ট ছিল ১৩.৬৫ ডলার, ২০২০ সালে তা উঠে যায় ২৮ ডলারে।

সরকার যদি প্যান্ডামিকের কারণে ভর্তুকি না দিত তাহলে ডিভিডেন্ড দাঁড়াতো ৪৮.৭০ ডলারে। যত মানুষ কবর কিনবে, মালিকদের তত মুনাফা। কোভিডের সময় কবর ব্যবসায়ীরা দু’হাতে মুনাফা করেছে। যত মৃত্যু তাদের তত মুনাফা।

নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতিদিন পড়ে ১৯২ জন লোক মারা যায়। অধিকাংশ কবরস্থান বা সেমিটারি লং আইল্যাণ্ডে। সেখানে কবর দুর্মূল্য। অনেকের সাধ্যের বাইরে। সে কারণে অধিকাংশ বাংলাদেশি মুসলিম মৃতকে কবরস্থ করতে পাশের স্টেট নিউ জার্সিতে নিয়ে যায়। লং আইল্যান্ডের ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালে কবর দেওয়ার গড় খরচ যদি ১২,০০০ ডলার হয়, তাহলে নিউ জার্সিতে কবর দিতে ৫,০০০ ডলারের মধ্যে হয়ে যায়। এর বাইরে ফিউনারেল হোমসের খরচ তো আছেই। অর্থ্যাৎ মৃত্যু রীতিমতো ব্যয়বহুল একটি ব্যাপার।

শেষকথা: সবকিছু সত্ত্বেও মৃত্যুর চেয়ে সত্য ও সুন্দর আর কিছু নেই। জীবনের মৃত্যু হয় না; মৃত্যু হয় দেহের। যতক্ষণ কারো জীবন তার নিজের ও অপরের জন্য কল্যাণকর সৃষ্টিকর্তা ততক্ষণ জীবিত রাখুন। যখন মৃত্যু তার নিজের জন্য কল্যাণকর তখন সৃষ্টিকর্তা তাকে মৃত্যু দান করুন।

এ প্রসঙ্গে অ্যালেন ব্রেনেম্যানের একটি কবিতার কিছু অংশ উল্লেখ করছি:
সে চলে গেছে বলে মনে করো না,
তার সফর কেবল শুরু হয়েছে,
জীবনের কত ধরনের অবয়ব থাকে,
কিন্তু এ মাটির কেবল একটি অবয়ব।
শুধু ভেবে নাও, সে দু:খ ও অশ্রু থেকে
উষ্ণ ও আরামের এক স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছে
যেখানে নেই কোনো দিন এবং বছর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *