প্রতিনিয়ত চলমান ঘটনা প্রবাহের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২১৬ নং আয়াতে মানুষের জন্য একটি চমৎকার জীবন দর্শন লুকায়িত আছে।
একটি মজার ও শিক্ষণীয় চীনা গল্প আমাকে আয়াতটির তাৎপর্য উপলব্ধি এবং হৃদয়য়ঙ্গম করতে সাহায্য করে। গল্পটি আমাদেরকে ‘হয়তো’ মানসিকতা গ্রহণ করতে এবং জীবনের অনিশ্চয়তার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সহায়ক হবে।
গল্পটিতে যাওয়ার আগে কোরআনের আয়াতটি মনে করিয়ে নেই।
وَعَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَہُوۡا شَیۡئًا وَّہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ۚ وَعَسٰۤی اَنۡ تُحِبُّوۡا شَیۡئًا وَّہُوَ شَرٌّ لَّکُمۡ ؕ وَاللّٰہُ یَعۡلَمُ وَاَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
“এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমরা কোন একটা জিনিসকে মন্দ মনে কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা মঙ্গলজনক। আর এটাও সম্ভব যে, তোমরা একটা জিনিসকে পছন্দ কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা মন্দ। আর (প্রকৃত বিষয় তো) আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।”
এবার গল্পটি বলি। এটা চীনা কৃষকের গল্প। এক সময় এক বৃদ্ধ চীনা কৃষক ছিলেন যার ছিলো একটি মাত্র যুবক ছেলে আর একটি ঘোড়া! ঘোড়াটি ছিলো খুবই সুন্দর এবং কর্মট। ঘোড়াটি কিনে নিতে অনেক বিত্তবানই চেষ্টা করেন। কিন্তু বৃদ্ধ ঘোড়াটি বিক্রি করতে রাজি হন নি। হঠাৎ করে একদিন ঘোড়াটি পালিয়ে যায়।
সেদিন সন্ধ্যায় তার প্রতিবেশীরা সমবেদনা জানাতে এসে বলল, আপনার ঘোড়া পালিয়ে গেছে শুনে আমরা খুবই দুঃখিত। এটা নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক।
কৃষক বললেন, হয়তো! আমি জানিনা এটা দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য!
গ্রামবাসি কৃষকের উত্তর শুনে আশ্চর্য হয়ে বললো, এটা দুর্ভাগ্য না তো আর কি হতে পারে?
পরের দিন ঘোড়াটি সাতটি বন্য ঘোড়া নিয়ে ফিরে এল। এবার সন্ধ্যায় সবাই ফিরে এসে বলল, ওহ! আপনি কি ভাগ্যবান না? আপনার এখন আটটা ঘোড়া আছে, কি সৌভাগ্য !
কৃষক আবার বললেন, হয়তো! তবে আমি জানিনা এটা দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য!
পরের দিন তার ছেলে বন্য ঘোড়ার একটিকে পোষ মানানোর চেষ্টা করে। কিন্ত ঘোড়া চড়ার সময় ঘোড়াটি ছেলেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। যার ফলে তার পা ভেঙ্গে যায়।
প্রতিবেশীরা তখন বলল, ওহ! কি জঘন্য অবস্থা।
কৃষক আবার জবাব দিলেন, হয়তো। আমি জানিনা এটা দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য! আপনারা খুব তাড়াহুড়া করছেন!
কয়েক সপ্তাহ পরে, জাতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যরা শহরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, সমস্ত শারীরিকভাবে সক্ষম যুবকদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করে। কৃষকের ছেলেকে ভর্তি করা হয়নি, কারণ সে আহত।
প্রতিবেশীরা এবার এসে চিৎকার করে বললো, তোমার ছেলে রক্ষা পেয়েছে, কী অসাধারণ ভাগ্য!
আবারো উত্তরে কৃষক জবাব দিলেন, হয়তো তাই, হয়তো না। আমি জানিনা।
এবার বৃদ্ধ কৃষক উপস্থিত সবাইকে ডেকে বসালেন এবং আদর করে বললেন, আপনারা ঘটনা প্রবাহের ধাঁপে ধাঁপে আমাকে বিভিন্নভাবে সহানুভূতি প্রদর্শনে এগিয়ে এসেছেন। আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ!
তবে বিনয়ের সাথে আপনাদেরকে বলতে চাই যে, আল্লাহর কুদরতের কিংবা প্রকৃতির পুরো প্রক্রিয়াটি হল বিশাল রহস্যময় একটি প্রক্রিয়া। এতে যা ঘটে তা ভাল না খারাপ সেটি বলা সত্যিই অসম্ভব।
কারণ, আমরা সাধারণত দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যের পরিণতি কী হবে তা যথার্থভাবে জানিনা। যখন কিছু ঘটে, খুব কম ঘটনাই সত্যিকার অর্থে ভাল না খারাপ, সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যজনক তা বিচার করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে কেবল সময়ই পুরো ঘটনাটি বলে দেয়। তবে আমরা জানিনা এই সময়টি কতটুকু? পাওয়া না পাওয়ার হিসাব তাৎক্ষণিক মিলানো সম্ভবই নয়!
এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে যায় আল্লামা ইকবালের কবিতা- এখানেই শেষ নয় এখানেই শেষ নয় পথ / তোমার সম্মুখে আছে এক অনন্ত জগৎ / ওই নক্ষত্র লোকে নব নব নভে / প্রেমের পরীক্ষা তুমায় আরো দিতে হবে।
একটি বিষয় নিশ্চিত যে জীবন অনিশ্চিত। জীবনে যাই ঘটুক না কেন, আমরা কখনই নিশ্চিত হতে পারব না যে এর পরিণতি ভবিষ্যতে কি হতে পারে। আমাদের কর্মজীবন একটি আবেগপূর্ণ রোলার কোস্টার হয়ে উঠবে, যদি আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতিকে বাইনারি উপায়ে ফ্রেম করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি।
সবকিছু একটি কারণে ঘটে, কিন্তু সেই কারণটি সর্বদা সহজে স্পষ্ট হয় না। আমি প্রায়শই এই ধরণের বাইনারি চিন্তাভাবনার সাথে লড়াই করি এবং আশাবাদী থাকি যে জীবনের আঁকাবাঁকা বুনোনগুলো শেষ পর্যন্ত নকশীর রূপ নেবে!
যে মহান সত্তা আমাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন তিনি আমার আপনার জন্য, জীবনের বাঁকে বাঁকে উপহার গুঁজে রেখেছেন! জীবনের সাধনা হল আপনার উপহার খুঁজে নেয়া আর জীবনের উদ্দেশ্য হলো তা বিলিয়ে দেওয়া।
আসুন ভেবেচিন্তে আমাদের জীবনের রূপরেখা তৈরি করি এবং পরম সত্য, পরম সুন্ধর, পরম স্রষ্টার সান্নিধ্যে পৌঁছার প্রয়াসের মাধ্যমে জীবনকে পূর্ণ করার সাধনা করি।
উপরোক্ত চীনা গল্পটি অ্যালান ওয়াটস’র যিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী দার্শনিক। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বক্তৃতা দিতেন। গল্পটিতে মূলত কোরআনের কথা এবং শিক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে!
চিন্তা-চেতনায় এ শিক্ষা জাগরুক রাখলে জীবন বড় শান্তিময় হতে পারে। অনেক সময়ই মানুষ কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করে ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, কিন্তু কোন কারণে যদি তা ব্যর্থ হয়, মন খারাপ করে হতাশ হয়ে বসে পড়ে।
আবার অনেক সময় কোন একটা বিষয় তার কাছে অপ্রীতিকর মনে হয় এবং তা থেকে বাঁচার জন্য সবরকম চেষ্টা করে, কিন্তু বাস্তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টির সম্মুখীন তাকে হতেই হয়। তখনই সে ভেঙ্গে পড়ে।
আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তোমার প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণ কিসে তা তুমি জান না, আল্লাহ তাআলা জানেন। তুমি যা কামনা করছ বাস্তবে তা তোমার জন্য দুঃখজনকও হতে পারে, আর যা অপছন্দ করছ তা হতে পারে প্রভূত সুফলবাহী।
ফয়সালা আল্লাহ তাআলারই উপর ছেড়ে দেওয়া উত্তম। সর্বান্তকরণে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং নিয়তি অনুযায়ী যা ঘটে তাতে খুশি থাকা উচিত।
* মুসতাক আহমদ ব্যারিস্টার অ্যাট ল, লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে কেবিনেট মেম্বার (জবস্, স্কিলস্ এন্ড গ্রোথ)