তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনেরই ঋণ চায় বাংলাদেশ, ভারতের অবস্থান কি বদলেছে?

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সৌমিত্র শুভ্র বিবিসি নিউজ

চীনের ঋণ নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিশদ সমীক্ষা করতে দেশটি যে পরামর্শ দিয়েছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান।

চীনের কাছ থেকে ঋণ পেতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে সহজ শর্তের ঋণ পেতে চীন সরকারকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদী পাড়ের মানুষের দুঃখ লাঘবে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এজন্য চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় সমীক্ষাও করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেককেই ধারণা করেন, এতোদিন ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সাথে এ প্রকল্প নিয়ে এগুতে পারছিল না বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্রকল্পটির ব্যাপারে আবারো আগ্রহ প্রকাশ করেন।

তবে গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, তিস্তা প্রকল্পে ভারত অর্থায়ন করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দেয়া বক্তব্যে চীনের অর্থায়নের কথা বললেও ভারতের বিষয়ে কিছু বলেননি।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতকে অসন্তুষ্ট করে কিছু করতে চাইবে না বাংলাদেশ। তাহলে, মহাপরিকল্পনা নিয়ে দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক ও অবস্থানে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না সেই প্রশ্ন উঠে আসছে। আরো প্রশ্ন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতের সাথে তিস্তার পানি বণ্টনে সমঝোতার প্রয়োজন কি ফুরিয়ে যাবে?

প্রধানমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, ২০২০ সালের অগাস্টে আট হাজার ২১০ কোটি টাকার পিডিপিপি (প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট প্রোপোজাল) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে জমা দেয়া হয়েছিল। পিডিপিপি’র ব্যাপারে চীন সরকার গত বছরের পাঁচ মার্চ একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠায়।

প্রতিবেদনে “বড় আকারের ভূমি উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং নৌ-চলাচল ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ না থাকা এবং বড় আকারের বিনিয়োগ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে” বলে সংসদকে জানান শেখ হাসিনা। আরও বিশদ সমীক্ষার পরামর্শও দিয়েছে চীন।
শেখ হাসিনা বলেন, “তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।”

কী থাকছে মহাপরিকল্পনায়?

মূলত তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিস্তা মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানালেন নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সদস্য পানি সম্পদ প্রকৌশলী মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান। উদ্দেশ্যগুলো হলো বন্যা পরিস্থিতি প্রশমন, ভাঙন হ্রাস এবং ভূমি উদ্ধার। পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ অংশের উজানে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণ।

মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিস্তা বাংলাদেশ অংশে খরস্রোতা একটি নদী। ব্যারেজের ডাউনে রিভার ট্রেইন (নদী শাসন) করে একে একটি নির্দিষ্ট আকৃতিতে আনার চেষ্টা করা হবে।” তিস্তার বিস্তৃতি কোথাও হয়তো পাঁচ কিলোমিটার আছে, সেটির প্রস্থ কমিয়ে আনা হবে। সেই সাথে ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়ানো হবে। করা হবে রিভেটমেন্ট বা পাড় সংস্কার ও বাধানোর কাজ।

এর ফলে তিস্তার পারে থাকা শত শত একর জমি বা ভূমি পুনরুদ্ধার হবে যা ভূমিহীন মানুষ, কৃষি কিংবা শিল্পায়নের কাজে লাগানো যাবে। অন্যদিকে, বন্যা ও ভাঙন কমানো গেলে অববাহিকার মানুষের দুর্ভোগ কমবে। তবে, এখনো বিষয়টি রূপরেখা পর্যায়ে আছে, বলেন ফিদা আব্দুল্লাহ খান।

‘চুক্তির বিকল্প নয়’

মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সেটি বর্ষা মৌসুমে তিস্তা অববাহিকার মানুষের দুর্ভোগ কমাবে। কিন্তু, শুষ্ক মৌসুমে কী হবে, যখন তিস্তার পানি প্রবাহ অনেক কমে যায়?
নদী বিশেষজ্ঞ ফিদা আব্দুল্লাহ খান বলেন, শুষ্ক মৌসুমের জন্যই পানি বন্টন চুক্তি হওয়া দরকার। “ভারতের সাথে চুক্তি না করলে, শুষ্ক মৌসুমে পানির যে প্রাপ্যতা সেটা নিশ্চিত হবে না। তাই, মহাপরিকল্পনা পানি বন্টন চুক্তির বিকল্প হিসেবে কাজ করবে না,” বলেন মি. খান।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার গঙ্গা চুক্তিও জানুয়ারি থেকে মে এই পাঁচ মাসের শুষ্ক মৌসুমকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে একাধিক গবেষক দাবি করেছেন, চুক্তির প্রতিশ্রুতি “সবসময় রক্ষা করা হয়নি”।

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার মুখে তা আটকে যায়। এরপর ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি আশ্বস্ত করেন যে তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো হবে।

কিন্তু এরপর প্রায় দশ বছর পার হয়ে গেলেও তিস্তা সমস্যার কোন সমাধান এখনো হয়নি।
অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনে তিস্তার পানি প্রয়োজন পড়ে, চুক্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই সময়টায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সহায়তায় ভারতের বিকল্প কিছু ভাবা উচিত।

চীন-ভারতের হিসাব-নিকাশ

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, জুলাই মাসের প্রথমার্ধে চীন সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগে, চলতি মাসের ২১ তারিখে দুই দিনের জন্য তিনি ভারত সফরে যাবেন। অবশ্য নতুন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইতিমধ্যেই একবার ভারত সফর করেছেন শেখ হাসিনা।

ভারতের জিন্দাল ইউনিভার্সিটি অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের একজন অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ড. শ্রীরাধা দত্ত বিবিসি বাংলাকে বলেন, অর্থাৎ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যতই ভালো হোক না কেন, যতদিন পর্যন্ত নদীর পানি বন্টন সমস্যার সমাধান না হয়, সেটা বাংলাদেশের কাছে একটা আঘাতের জায়গা হয়ে থাকবে।

“ইন্ডিয়া থেকে যদি রেসপন্স ভালো না পায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে ওরা চায়নার কাছে যাবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই,” বলছিলেন অধ্যাপক দত্ত। তবে, শেখ হাসিনা সরকার ভারতকে “চটিয়ে” কিছু করবে না বলেই বিশ্বাস তার। বলেন, সে হিসেবে ভারতের “ইতিবাচক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই” বাংলাদেশের এগোনোর কথা।

এমনকি তিনি মনে করেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারত-চীন একসাথে কাজ করতেও বাধা নেই। কিন্তু, “চীন ভারত একদিকে এটা চিন্তা করা এখনো কষ্টকর,” বলছেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “চীন সফরের আগে তো আবার ভারত সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। ভারতও তো অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল।”

এখন ভারত “অসন্তুষ্ট” হয়, এমন কিছু বাংলাদেশ করবে বলে মনে হয় না, বলেন মি. হোসেন। তাই, কোনো চুক্তি হওয়ার আগে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না বলে মন্তব্য তার।

ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবার বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
নির্বাচনের পরেও চীনের রাষ্ট্রদূত তার সেই আগ্রহ চাপা রাখেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে এক বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন।

অন্যদিকে, মে’র দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। তার সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “তিস্তায় আমরা একটি ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা করছি, ভারত সেখানে ফিন্যান্স করতে চায়।”

জানুয়ারিতে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অনুসূয়া বসু রায়চৌধুরী বলেন, তিস্তা প্রকল্পের যে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে সেটি অস্বীকার করা যাবেনা।

তিনি বলেন, ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্ব বহন করে এমন সব প্রকল্প নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীন ‘অতিরিক্ত আগ্রহ’ প্রকাশ করে। চীন চায় তাদের উপস্থিতি জোরালো করতে। তবে, এর সঙ্গে দ্বিমত করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।

তার মতে, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহ এখানে গৌণ এবং তাদের কোন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত নেই। অধ্যাপক আহমেদ বলেন, “তিস্তা নদীতে এটি বাংলাদেশের প্রকল্প, এটি চীনের কোন প্রকল্প নয়। চীন শুধু এখানে অর্থায়ন করতে রাজী হয়েছে। কারণ অন্যরা সে অর্থ দিতে পারছেনা।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *