ঢেঁকুর তোলা সিনেমার প্রয়োজন নেই | কামরুল হাসান দর্পণ

মতামত সময় টিভি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

অমিতাভ রেজা পরিচালিত ‘রিকশা গার্ল’ সিনেমাটি এখনও মুক্তি পায়নি। তবে আগামী ৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে মুভি থিয়েটার ভিলেজ বাই অ্যাঞ্জেলিকায় প্রিমিয়ার শো হবে। এতে সিনেমার নির্মাতা, প্রযোজক বেশ আনন্দিত। পরিচালক বলেছেন, ‘দেশের বাইরের দর্শকদের কাছে সিনেমাটি পৌঁছে দিতে এবং বাংলাদেশের সিনেমাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে রিকশা গার্ল নিয়ে আমরা বড় বড় সব চলচ্চিত্র উৎসব ও শহরে হাজির হয়েছি।’ কী তাজ্জব কথা! যে সিনেমা মুক্তি পেল না এবং দেশের মানুষ দেখল না, তা বিদেশী দর্শককে (বলা ভালো আমন্ত্রিতদের) দেখানোর জন্য নির্মাতা-প্রযোজক কী ব্যাকুল আর উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন! পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার জন্য নাকি এই শো’র আয়োজন করেছেন। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, বিশ্বমঞ্চটা কি এবং তা কোথায়, কোন এলাকায়? বোধকরি, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন।

সে যাই হোক, আমরা যেমন হলিউড ও বলিউড কিংবা তামিল-তেলেগু সিনেমা মুক্তির আগেই দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি, ঠিক তেমনি আমাদের তথা ঢালিউডের সিনেমার জন্য বিশ্বের এমন কোনো দেশ কি আছে, যে দেশের দর্শক এমন উদগ্রীব হয়ে থাকে? এই যে ‘বিশ্বমঞ্চ’-এর কথা বলা হচ্ছে কিংবা ‘উৎসব সিনেমা’ বানানো হচ্ছে এবং এগুলো নিয়ে যেসব দেশে যাওয়া হয়, সেসব দেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে (সেখানে বসবাসকারি বাংলাদেশী নয়) কি আগ্রহ সৃষ্টি করা যাচ্ছে? কিংবা সেখানের কোনো আমদানিকারক কি বলেছে, আমরা তোমাদের সিনেমা আমদানি করতে চাই। এমন কোনো আমদানি অর্ডার কি পাওয়া যায়?

বলা বাহুল্য, ভারতে ও আমাদের দেশেও কিন্তু আন্তর্জাতিক উৎসব হয়। এসব উৎসবে বিনামূল্যে বিভিন্ন দেশের সিনেমা দেখানো হয়। উৎসবে অংশগ্রহণকারী সিনেমাকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে পুরস্কারও দেয়া হয়। যেসব দেশের সিনেমা পুরস্কৃত হয় তার নির্মাতারাও হয়তো দেশে গিয়ে বলে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেয়েছি। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব উৎসবের সিনেমা কয়জন দর্শক দেখে? যে সিনেমা আমাদের দেশে মুক্তি দেয়া হয়নি, আমরা দেখিনি, দেখে সিনেমাটি কেমন তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ হয়নি, সে সিনেমা বিদেশের উৎসবে দেখিয়ে, প্রিমিয়ার শো করে এসব সিনেমার নির্মাতারা কি আমাদের দর্শকদের অবজ্ঞা করছেন না? নাকি আমাদের দর্শক দেখবে না, কিংবা সিনেমা হল শূন্য থাকবে, এ আশঙ্কায় তারা বিদেশ গিয়ে এর মূল্য বাড়াতে চাইছেন? বলতে চাচ্ছেন, দ্যাখো! তোমরা না দেখলে কি হবে, দেশের বাইরে মানুষ দেখে কত পুরস্কার দেয়!

দুঃখের বিষয়, তারা এ বিষয়টি বুঝতে পারছেন না, দেশের দর্শকের কাছে পরীক্ষা না দিয়ে বাইরে গিয়ে গুটিকয় আমন্ত্রিতদের দেখিয়ে প্রশংসা কুড়িয়ে সিনেমার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন, বদনাম করছেন। কেউ যদি কারো বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায় এবং খানাখাদ্যের আয়োজন করে, তবে সে খাদ্য আমন্ত্রিত অতিথির যদি ভালো নাও লাগে, সে কি বলবে খাবার ভালো হয়নি! ভদ্রতার খাতিরে হলেও ঢেঁকুর তুলে বলবে, আহ, অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার হয়েছে! অতিথির ঢেঁকুর তোলা দেখে নির্মাতা সন্তুষ্ট হলেও সে ঢেঁকুর তৃপ্তির নাকি বমি করার, তা হয়তো লক্ষ্য করে না। ঢেঁকুর তোলা দেখেই লাফিয়ে উঠে বলতে থাকে পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি! সম্মাননা পেয়ে গেছি! চেয়ে দেখে না ওটা অস্কার নয়, নিদেনপক্ষে কান-ও না।এদের কিভাবে বোঝানো যায়, এমন সিনেমা বানান যে সিনেমা দর্শক গোডাউন মার্কা সিনেমা হলে গিয়ে শীষ বাজিয়ে নেচে-গেয়ে দেখবে। বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। তারপর ঐসব ঢেঁকুর তোলা পিএইচডি মার্কা সিনেমা বানালে ভিত্তিটা শক্ত হবে।

নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক আলাপ করে লাভ নেই। সরল সিনেমা বানান, যা দেখার জন্য দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের মতো ২২৫ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে নিদেনপক্ষে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আঘাত করবে। এমন ঘূর্ণিঝড় মার্কা সিনেমা বানান।

এবারের ঈদে এস এ হক অলিকের ‘গলুই’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পাবে। অলিক সিনেমাটি নিয়ে পরীক্ষায় পাস করার জন্য কি যে পরিশ্রম করছেন, তা কল্পনাও করা যায় না। টিজার, ট্রেইলর, গান, প্রমোশন, টি শার্টসহ হেন কোনো পন্থা নেই, যা অবলম্বন করছেন না। আমি তার পরিশ্রম নিজে দেখেছি এবং দেখছি। দর্শক যাতে সিনেমা হলে গিয়ে তাকে পাস মার্ক দেয়, তার জন্য তাকে কি যে পড়াশোনা করতে হচ্ছে! আসলে এ সময়ে চলচ্চিত্রে পাস করা কঠিন থেকে কঠিনতম। তারপরও অলিক এই কঠিনতম পরীক্ষা দেয়ার জন্য যে শ্রম দিচ্ছে, তা বিস্ময়কর। অলিক তো পারতেন সিনেমাটি নিয়ে বিদেশের উৎসবে অংশগ্রহণ ও প্রিমিয়ার করতে। তা না করে তিনি দেশের দর্শকের সামনেই উপস্থিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং তাদের প্রতি আস্থা রেখেছেন।

বরং অলিকের এ সিনেমাটি উৎসবে গেলে বাংলাদেশের সিনেমার মূল ধারাটা উপস্থিত দর্শকরা জানতে পারতো। এতে আমাদের মূল ধারার চলচ্চিত্রের উপকার হতো। অলিক সিনেমার একজন প্রকৃত ছাত্র হিসেবে তা করেননি। কারণ, তিনি আগে নিজের দেশেই পরীক্ষা দিতে চান। তারপর বিদেশ গিয়ে স্কলারশিপ নিতে চান। আসলে সিনেমার ছাত্রদের তো এমনই হওয়া উচিৎ। এমন ছাত্র হওয়া উচিৎ নয়, যারা দেশে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ চলে যায়। তারপর আর দেশের কল্যাণে ফিরে আসে না। তদ্রুপ এমন সিনেমার ছাত্রের প্রয়োজন নেই যারা দেশে পাস করতে পারে না, অথচ বিদেশে গিয়ে আমন্ত্রিতদের ঢেঁকুর তোলার জন্য অস্থির হয়ে উঠে।

লেখক: কামরুল হাসান দর্পণ
সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক
সদস্য সচিব, এডহক কমিটি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *