আফজাল হোসেন তানভীরইউএনবি
২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন। তাদের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা হল টিউটর ও প্রভোস্টদের একটি প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন, যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, কুখ্যাত গণরুম (জনাকীর্ণ কমন লিভিং রুম) ও গেস্টরুম সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা এবং হলগুলোতে পূর্ণ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার কথা বলা হয়।
দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফসল এসব দাবি। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ এবং শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ দাবি করে তারা, যেখানে কোনো রাজনৈতিক চাপ থাকবে না। নির্যাতনের শিকার একাধিক প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী গণরুম ও গেস্টরুম সিস্টেমের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন। তারা বলেন, কীভাবে এসব ব্যবস্থা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে দীর্ঘস্থায়ী অসহনীয় করে তুলেছিল।
দিনের দুঃস্বপ্ন
বঙ্গবন্ধু হলের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমন ইসলাম গণরুমকে ‘ভয়ঙ্কর অভিশাপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নবীন শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গ্রামীণ এলাকা থেকে আসেন। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রবেশ করেন তারা। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই তারা দেখতে পেতেন তাদের থাকার কক্ষগুলো অতিরিক্ত জনাকীর্ণ। ইমন জানান, ছয় থেকে আটজনের জন্য নির্ধারিত একটি কক্ষে ৪০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। ‘প্রতি রাতে ঘুমানোর জন্য জায়গা নিশ্চিত করতে একজনের সঙ্গে আরেকজনের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হতো। ঘর ভরে গেলে একমাত্র বিকল্প ছিল মসজিদ, কিন্তু সেখানেও অনেক সময় ঠাসাঠাসি অবস্থা থাকত।
গ্রীষ্মের মাসগুলোতে গণরুমে বাস করা অসহনীয় যন্ত্রণা বলে উল্লেখ করেন তিনি। ঘরের বাতাসে ছিল অ্যালার্জির উপাদান, আর দেওয়ালগুলো ছিল পোকামাকড়ে ভরা—অতিরিক্ত বাসিন্দাদের কারণে এসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। মাত্র কয়েক মাস পরে ইমনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, তিনি বিকল্প বাসস্থানের জন্য হল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া কক্ষে ফিরে এসেছেন। সংস্কারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে আশাবাদী তিনি।
রাজনৈতিক চাপে পরিণত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’
ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আমিরুল করিম রাজনৈতিক জবরদস্তির কারণে হলগুলোতে অবিরাম চাপের মুখে পড়েন। তিনি বলেন, স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু হলের রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে সেসব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হতে দেখেন। ‘প্রথম রাত ছিল উৎসবের মতো, কিন্তু দ্বিতীয় রাতেই পরিস্থিতি অন্ধকারের দিকে মোড় নেয়। আমাদের উপর অপ্রয়োজনীয় নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং সতর্ক করা হয়- থাকতে হলে চোখ বন্ধ করে ছাত্রলীগকে সমর্থন করতে হবে।’
গণরুমে ঢুকতে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু বৈধ আসনের অধিকারই হারায়নি, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমির গণরুমের পরিবেশকে একটি ‘রাজনৈতিক নির্যাতন ক্যাম্পের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেখানে এমনকি স্বাভাবিক গতিবিধি এবং কথাবার্তাও পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের বার বার ভয় দেখিয়ে তাদের কোণঠাসা করে রাখা হতো বলে জানান তিনি। আমির বলেন, ‘এমন অনেক রাত ছিল গণরুমে জায়গা খুঁজে না পেয়ে মসজিদে ঘুমাতে হয়েছিল। এই ক্রমাগত মানসিক চাপ আমার পড়াশোনায় প্রভাব ফেলেছিল। কোনোমতে পরীক্ষাগুলোতে পাস করতে পেরেছি।’ কোভিড-১৯ ছিল তার জন্য সাময়িক মুক্তি। কিন্তু ২০২১ সালের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে দেখলেন গণরুমের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
করিডোরে অন্তহীন রাত
স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মুজাম্মেল হক কোনো কক্ষ বরাদ্দ পাননি। এ কারণে হলে ‘আজ এখানে তো কাল সেখানে’ এমন অবস্থায় থাকতে হয়েছে অনেক দিন। মূলত নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা মুজাম্মেল ২০১৯ সালে ঢাবিতে এলেও তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কক্ষ বরাদ্দ পাননি। বছরের পর বছর ধরে, তিনি করিডোর ও মসজিদে থেকেছেন। অবশেষে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হলের করিডোরে থাকতে শুরু করেছিলেন। শীতকালে, তারা ঠান্ডা বাতাস আটকানোর জন্য পোস্টার এবং ব্যানার ঝুলিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে কিছুটা উষ্ণতা ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। তবে, এর প্রভাব ছিল খুবই সীমিত এবং এমন পরিস্থিতিতে বসবাসের কারণে তার স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মাও অসুস্থ। এখন আমি নিজেও অসুস্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময় আমি এই জীবন কখনো কল্পনা করিনি।
গণরুমহীন ভবিষ্যৎ?
কবি জসীম উদ্দীন হলের তামজিদ হোসেন তার গণরুমের অভিজ্ঞতাকে ‘জীবনের সবচেয়ে খারাপ অধ্যায়’ বলে মনে করেন। তিনি বর্ণনা দেন, চারজনের জন্য বরাদ্দের একটি কক্ষে ৩৫ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে থাকতেন। ‘এপ্রিল-মে মাসের গরম অসহনীয়। অনেক সময় আমরা একদম ঘুমাতেও পারতাম না, আর কিছু রাতে মসজিদে গিয়ে ঘুমাতে হতো।’ গণরুম প্রথার আরেক রূপ গেস্টরুমও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তামজিদ বিষয়টিকে একটি ‘রিমান্ড রুম’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেখানে ছাত্রলীগ প্রায়ই তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদ করত। বিদ্রোহী ছাত্রদের প্রায়শই লক্ষ্যবস্তু করা হতো, কিছু বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হতো। অনেক রাতে এমন হয়েছে যে, গেস্টরুমের নির্যাতন এড়াতে ভিসি চত্বরের কাছে বাইরে ঘুমাতেন তামজিদ ও তার বন্ধু মাওলা।
গণরুমের ছায়া কেবল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উপরই পড়েনি। জোরপূর্বক আনুগত্য, চরিত্র হনন এবং আকস্মিক উচ্ছেদের ভূত দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং তার ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদেরও তাড়া করে বেড়াত; বিশেষত যাদের ছাত্রলীগ নেতারা আনুগত্যহীনতার সন্দেহ করেছিলেন। বানোয়াট অভিযোগ ছিল সাধারণ কৌশল, যা ‘বিদ্রোহী’ শিক্ষার্থীদের মেনে চলার জন্য চাপ দিতে বা তাদের হল থেকে পুরোপুরি বের করে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো সই করে মেনে নিয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা আশাবাদী যে গণরুম ও গেওস্টরুম সংস্কৃতি সমস্যাগ্রস্ত অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই শুধু থাকবে। তারা এমন একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেন যেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা একজন শিক্ষার্থীর জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে না এবং যেখানে আসা নবীনরা নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারে। একই সঙ্গে তাদের পড়াশোনা এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নের দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।