ডেকার্তের দার্শনিকতায় গাজালির প্রভাব । মুসা আল হাফিজ

ধর্ম ও দর্শন সময় চিন্তা
শেয়ার করুন

দর্শনশাস্ত্রে রঁনে ডেকার্তের সবচেয়ে বড় অবদান, দর্শনকে বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর করে তুলতে ইউরোপে তিনিই প্রয়াসী হয়েছিলেন সবার আগে। তার পদ্ধতি পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে বহুলাংশে অনুসৃত হয়েছে। আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয় তাকে। দর্শনকে তিনি রচনা করেছেন গণিতের ছাঁচে, তার দর্শন গণিতায়িত। তার দার্শনিক পদ্ধতি প্রাচীন এরিস্টটলীয় দর্শনকে কোনো বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির উদগীরণ ছাড়াই পরিত্যাগ করে। তরুণ বয়সেই তার মনে ছিল একটি অনুসন্ধান, যার লক্ষ্য ছিল মানুষ এবং মহাবিশ্বের স্বরূপ জানা। সে জন্য দরকার ছিল অন্তর্দৃষ্টি। কিন্তু তখনকার ইউরোপীয় দর্শনে বিদ্যমান চিন্তা ও পদ্ধতি এ জন্য যথেষ্ট ছিল না। গভীর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন মধ্যযুগ থেকে ইউরোপে যে জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে তা নির্ভরযোগ্য নয় তেমন। এ জন্যে দরকার ছিল দার্শনিক নতুন পদ্ধতি। তিনি সেই পদ্ধতির প্রস্তাব করেন সবলে। ডেকার্ত দেখান, দর্শন হচ্ছে একটি সামগ্রিক ভাবনাপদ্ধতি যা জ্ঞানকে মূর্ত করে। তার মতে, ‘দর্শন হচ্ছে একটি বৃক্ষের মতো যার মূল হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা, কাণ্ড পদার্থবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের অন্য সব শাখা এই কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা হিসেবে বের হয়। তাদেরকে আবার মূল তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা- চিকিৎসাশাস্ত্র, বলবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র।’

ডেকার্তের হাত ধরে বিকশিত হয় আধুনিক দর্শনে বুদ্ধিবাদ। পরে তা হয় আরো শক্তিশালী ও প্রসারিত। অন্য দিকে ঘটে অভিজ্ঞতাবাদের বিকাশ। ডেকার্তের বিচারে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার উভয়েই এমন, যাদের সন্দেহ করা যায়। ‘স্কেপ্টিসিজম’ বা সংশয়বাদ ছিল ডেকার্তের দার্শনিক পদ্ধতি। যার দাবি, একটি বিষয়কে সত্য বলে স্বীকার করতে হলে তাকে সন্দেহ করার মতো সব বিষয়কে মিথ্যা প্রমাণিত হতে হবে। তার প্রথম কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা ছিল কোনো কিছুর জ্ঞান কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়? তার মতে, যে পর্যন্ত কোনো কিছুকে স্পষ্টভাবে এবং ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে উপলব্ধি না করা হবে, সে পর্যন্ত তাকে সত্য বলে স্বীকার করা যাবে না। বিশ্বকে দেখার যে দর্শন প্রস্তাব করেন তিনি, তা ছিল মধ্যযুগে এরিস্টটলীয় শিষ্যদের বিশ্বধারণা থেকে একেবারে পৃথক। তার দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা ছিল, কিভাবে একজন মানুষ জ্ঞানকে সঠিত প্রমাণ করতে পারে? তার সংশয়ী পদ্ধতির প্রশ্ন ছিল, যে জগতের জ্ঞান আমার আছে, আমি কিভাবে জানব এই জগৎ সত্য? আমার ইন্দ্রিয় কি আমাকে সত্য জ্ঞান দিচ্ছে? তিনি দেখলেন ইন্দ্রিয় তো ভুল বার্তাও দেয়। তাহলে কিভাবে তাকে বিশ্বাস করা যায়? অতএব বিশ্বাস আনতে হলে সন্দেহের সব উপকরণকে আগে বাতিল সাব্যস্ত হতে হবে। যেখানে সন্দেহ থাকতে, সেখানে সত্য নেই। ডেকার্ত মনে করতেন, ‘মানুষই হলো সমস্ত কিছু বিচারের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের বৈশিষ্ট্য তার মস্তিষ্কের অপার সম্ভাবনায়, সে চিন্তা করতে পারে। তিনি সব কিছুকে সন্দেহ করলেও নিজে যে আছেন এবং চিন্তা করছেন, তাকে সন্দেহ করতে পারছিলেন না। অতএব তার উক্তি, ‘কোগিটো এরগো সাম’ বা আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি। এর মানে নিজের কর্তাসত্তার থাকা এবং চিন্তার থাকা পরস্পরের সাথে যুক্ত, যে চিন্তা সংশয় করতে করতে অগ্রসর হয়। এর ফলে তিনি সংশয়ের চেয়ে চিন্তার অস্তিত্বকে দেন প্রধান্য; যা নির্ভরশীল কর্তাসত্তার ওপর। কারণ যতই সংশয় পোষণ করা হোক, সংশয় পোষণের জন্য চিন্তার কর্তাকে থাকতে হয়।

তিনি আধুনিক চিন্তার ভিত্তি রচনা করেন ‘ডিসকোর্স অন মেথড’ (১৬৩৭), এবং ‘দি মেডিটেশনস’ (১৬৪৪) গ্রন্থে। এতে তিনি ব্যাখ্যা করেন পাঁচটি দার্শনিক পথ ও পদ্ধতি। প্রথমত, যুক্তির মহিমা। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির সহজাত নিয়ম কখনো বদলায় না। তৃতীয়ত, দৈশিক বিস্তার ও গতির তত্ত্বই হচ্ছে ভৌত বস্তুর মূল বৈশিষ্ট্য। চতুর্থত, বস্তু বা শরীর আর মন ও আধ্যাত্মের ভিন্নতা। পঞ্চমত, বস্তুর কিছু গুণ সত্য এবং অন্তর্নিহিত। তার থেকে পৃথক হলো ববস্তুর সেসব গুণ, যা মনে হয় বস্তুতে আছে; অথচ তা শুধুই মনের ওপর ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রতিক্রিয়া।

মানুষের চিন্তা ও ধারণাকে তিন ভাগে ভাগ করেন ডেকার্ত। প্রথমত, মানুষ ভাবনা-চিন্তা করে জন্ম দেয় ও সাজায়, এমন সৃষ্ট ধারণা। দ্বিতীয়ত, এমন ধারণা, যার জন্য ভাবনা-চিন্তা করতে হয় না। আগুনে হাত লাগলে গরম লেগেছে, সেটি ভেবে-চিন্তে আবিষ্কার করতে হয় না। বরফ গায়ে লাগলে শৈত্য অনুভূত হয়, সেটির জন্যও চিন্তাভাবনা করা লাগে না। তৃতীয়ত, এমনসব সহজাত ধারণা, যা সৃষ্টিকর্তা স্থির করে দিয়েছেন; যা সহজাত ও অলঙ্ঘনীয়। একে বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। একটি ত্রিকোণ বস্তুকে চতুষ্কোণ বলে ধারণা করলে সেটি ভুল। কারণ তা চতুষ্কোণ হতে পারে না।

তাকে দ্বৈতবাদীও বলা হয়। কারণ তার মতে দুই ধরনের বাস্তবতা বা সারবস্তু রয়েছে। একটি সারবস্তু হচ্ছে চিন্তা বা মন অন্যটি ব্যাপ্তি বা বস্তু। উভয়ে পরস্পরে আলাদা। মন সম্পূর্ণ বিমূর্ত, অপার্থিব ও আধ্যাত্মিক একটি ব্যাপার। সে মস্তিষ্কের দ্বারা চালিত নয়। সে পুরোপুরি সচেতন ও স্থানগত দিক দিয়ে কোনো জায়গা দখল করে না, ফলে এটিকে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করা যায় না। অন্য দিকে বস্তু জায়গা দখল করে এবং একে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা চলে। বস্তুর কোনো চেতনা নেই। ডেকার্তের মতে, দুই সারবস্তুই ঈশ্বর থেকে এসেছে। কিন্তু এ দুই সারবস্তুর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও দেহ-মনের দ্বৈততা সমাধানে তিনি আলোচনা করেছেন একটি গ্রন্থে, কিন্তু ডুয়েলিজম বা দ্বৈতবাদ আর ডেকার্তে হয়ে ওঠে পরস্পরের পরিচায়ক।

ডেকার্তের দার্শনিক উদ্ভাবনের পূর্বসূরিতা ইউরোপে ছিল না যদিও, মুসলিম দুনিয়ায় ইমাম গাজালির চিন্তা ও কর্মে এর স্বাক্ষর লক্ষ করা যায় বহু আগে। তারও কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাস্য বিষয় ছিল প্রথমত, কোনো কিছুর জ্ঞান কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়? দ্বিতীয়ত, কিভাবে সঠিক প্রমাণিত হবে অর্জিত জ্ঞান?

‘তাহাফাতুল -ফালাসিফাহ’ গ্রন্থে গাজালি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মতবাদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং তাদের মতবাদের অসারতা তুলে ধরেন। প্রধানত তিনি এরিস্টটল ও তার অনুসারী দার্শনিকদের মুখোমুখি হন, তাদের মোকাবেলা করেন গুরুতর নানা প্রশ্নে। তার সময়ে বিদ্যমান দার্শনিক আলোচনাধারাকে তিনি সত্য উদঘাটন ও জ্ঞান-জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সমর্থ মনে করেননি। এ জন্য তিনি নতুন দার্শনিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। তিনি দার্শনিক আলোচনা শুরু করেন সংশয়ী মন নিয়ে। তিনি প্রথমে সংশয় করেন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে, কারণ ইন্দ্রিয় আমাদের প্রায়ই ভুল জ্ঞান প্রদান করে যা বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি। এরপর তিনি বুদ্ধিকে সংশয় করতে থাকেন এবং চিন্তা করেন, কিভাবে বা কী মাধ্যমে বুদ্ধির ভুলগুলো জানা যায়। কিভাবে সন্দেহের অন্ধকার সরিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করা যায়? গাজালি স্বাধীন চিন্তা ও বিবেকের সাহায্যে জগৎ ও জীবনকে জানতে চেয়েছেন। তাই তিনি সব কিছুই যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন। যাচাই ছাড়া কারো বক্তব্য কিংবা কোনো ধারণাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না তার মন। নিজের আত্মকথনে তিনি স্পষ্ট করেন, এ সংশয়ী বাস্তবতা ছিল তার স্বভাবজাত। অবশেষে যাপনশীল মরমি অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রকৃত সত্যকে জানতে পেরেছেন।

গাজালির পথ, প্রক্রিয়া ও আলোচনাভঙ্গি দিয়ে ডেকার্তের জীবন ও কর্মে একটি প্রতিচ্ছবি যেন তৈরি করেছিল নিয়তি। যুক্তি প্রসঙ্গ, প্রকৃতির সহজাত নিয়মের অপরিবর্তনশীলতা, বস্তু ও মনের পার্থক্য, বস্তুতে লুকিয়ে থাকা সহজাত গুণ কিংবা দেহ ও আত্মার দ্বৈধতা এবং মানুষের চিন্তা ও ধারণাকে ব্যাখ্যার মতো বিষয় একদা যে মেজাজে ভাবিত করেছিল গাজালির মগ্নচৈতন্যকে, বহু শতক অতিক্রম করে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তা আলোড়িত হয় ফরাসি দার্শনিকের মনোলোকে।

তাহাফুতে গাজালি এরিস্টটলীয় দর্শনের কিছু মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সমালোচনা করেছেন, আবার কিছু নীতি করেছেন গ্রহণ ও প্রয়োগ। এরিস্টটলের সেই সব প্রভাবকে নিরীক্ষণ করেন গাজালি, যা মুসলিম দুনিয়ায় একদল চিন্তাবিদকে আত্মসাৎ করেছিল। গাজালি নিরীক্ষণ ও গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে দর্শনের এলাকায় নতুন পথের প্রস্তাব করেন। ডেকার্তের ডিসকোর্স অন মেথড একই কাজ করেছে। চতুর্দশ শতকে ইউরোপে এরিস্টটলের যে প্রভাব চিন্তা ও দর্শনকে সমাচ্ছন্ন করেছিল, সেগুলোর নিরীক্ষণ ও গ্রহণ-বর্জন এবং নতুন পথের প্রস্তাব করেন ডেকার্তে। গাজালির প্রভাব যেভাবে নতুন যুগের উন্মোচন করেছিল, ডেকার্তের প্রভাবও নিয়ে আসে নতুন যুগ। গাজালির মতো ডেকার্তেও পড়াশোনা করেন আইন নিয়ে, শিক্ষালাভ করেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভ্রমণ করেন দেশের পর দেশ, অধ্যয়ন করেন সমকালীন চিন্তাস্রোতগুলো এবং তার দুর্বলতা নির্দেশ করেন তীব্রভাবে। উভয়ে স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রমাণ ও ব্যাখ্যায় ছিলেন সক্রিয়, সমকালীন ইনকুইজিশন উভয়কে মোকাবেলা করতে হয়েছে প্রথাবাদীদের তরফে। গাজালির গ্রন্থ যেখানে অগ্নিদাহের কবলে পড়েছে, ডেকার্তেকে আগুন থেকে বাঁচতে ও গ্রন্থ বাঁচাতে জীবনভর অপ্রকাশিত রাখতে হয়েছে কিছু রচনা। পদ্ধতির প্রশ্নে উভয়ে সংশয় প্রশ্নকে অবলম্বন করেছেন এবং একই উপায়ে সমাধান করেছেন বিষয়টির। সংশয়ের বিবরণ উভয়েই দিয়েছেন আত্মজৈবনিক ভাষায়।

গাজালির সংশয়বাদী প্রক্রিয়া শুরুতে যেকোনো বিষয়কে অবিশ্বাস করে এবং ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধিকে করে অবিশ্বাস। এরপরে অনাস্থার পথ ধরে সামনে এগিয়ে বাতিল করে সামনে দাঁড়ানো সত্যগুলোকে। গাজালি গাণিতিক জ্ঞানকেও সংশয়ের বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। কারণ হিসেবে ও মানপ্রকাশে ভুল হওয়া একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। স্বপ্নে মধ্যেও ঘটতে পারে অঙ্ক ও গণিতের ব্যাপার, যা অবাস্তব। এই যে অবাস্তবতা, সেটি বাস্তবতায়ও তৈরি হতে পারে। গাণিতিক ভুলে কেউ লিপ্ত হতে পারে অধিকতর বড় কোনো মন্দের কবলে পড়ে। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, গাজালির এসব ব্যাপার ডেকার্তের মধ্যে সরাসরি লক্ষ করা যায়। গাজালি নিজের দার্শনিক উপলব্ধি ও সত্যজ্ঞানের জন্য ইলহাম ও ঐশীপ্রেরণাকে উৎস হিসেবে নির্দেশ করেন। একই কাজ করেন ডেকার্তে। তিনি স্বপ্নযোগে সরাসরি ঈশ্বরের আদেশে দার্শনিক পন্থা ও চিন্তালাভের বিবরণ শোনান। সত্যতালাশে সব অনুসন্ধান শেষে গাজালির শেষ উপসংহার হলো, একমাত্র নিশ্চিত সত্য হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বজ্ঞান। জ্ঞান ও সত্যের প্রশ্নে ডেকার্তেও শেষ অবধি ঈশ্বরের ওপর সর্বোচ্চমাত্রায় নির্ভরশীলতা প্রকাশ করেন। এবং মানুষের নিজস্ব স্বভাব জানার প্রশ্নে তাকেই মুখ্য সত্য হিসেবে উপস্থাপন করেন তিনি। গাজালি দেখান, বিশ্বাস যুক্তির অগম্য, যুক্তির জন্য বিশ্বাস হচ্ছে দুর্বোধ্য। একই সিদ্ধান্ত শোনা যায় ডেকার্তের কণ্ঠেও। গাজালি তার বিভিন্ন গ্রন্থে স্পষ্ট করেছেন, তার গ্রন্থরচনার উদ্দেশ্য মূলত আল্লাহর সত্য এবং মানুষের আধ্যাত্মিক বাস্তবতা ও মুক্তিকে প্রমাণ ও উপস্থাপন। ডিসকোর্স অন মেথড গ্রন্থের ভূমিকায় ডেকার্তে উল্লেখ করেন যে, এই গ্রন্থ প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের ও মানুষের আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা। ১৬৪১ সালে প্রকাশিত ‘মেডিটেশন অব দ্য ফার্স্ট ফিলোজফি’ গ্রন্থের এক-তৃতীয়াংশজুড়ে তিনি নানা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব।

এত সাদৃশ্য সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্য নেই, তা নয়। গাজালি যেখানে বিশ্বের অনন্ততার বিরোধী ছিলেন, ডেকার্তে সেখানে দাবি করেন পৃথিবী লয়হীন। কিন্তু এর প্রমাণপদ্ধতি গাজালির আলোচনাপদ্ধতির অনুসারী। গাজালির জন্ম হয় ১০১১ সালে, ওফাত হয় ১০৫৮ সালে। ডেকার্তের জন্ম হয় ১৫৯৬ সালে, জীবনাবসান হয় ১৬৫০ সালে। তার জন্ম হয় ফ্রান্সের তুরাইন প্রদেশে। জীবন কাটে ইউরোপের নানা অঞ্চলে। গাজালির জন্ম হয় ইরানের খোরাসানের তুস নগরীতে, জীবন কাটে মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে। তাহলে কিভাবে গাজালির চিন্তা ও দর্শনের সাথে ঘটল ডেকার্তের সাক্ষাৎ?

সাক্ষাৎ ঘটেছিল অনুবাদের মাধ্যমে। জীবদ্দশায় গাজালির চিন্তা প্রসারিত হয় মুসলিম স্পেনেও। ১১৪৫ সালের দিকে স্পেনীয় দার্শনিক ডমিনিকাস গুন্ডিসালিনাস (১১১৫-১১৯০), আবরাহাম ইবনে দাউদ (১১১০-১১৮০), জন অব সেভিল (১১০০-১১৮০) প্রমুখ গাজালির গ্রন্থ অনুবাদ করেন ল্যাতিন ভাষায় এবং তা খ্রিষ্টান স্কলাস্টিক দার্শনিকদের প্রণম্য গ্রন্থ হিসেবে বরিত হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি ইত্যাদির জ্ঞানজগতে দ্বাদশ শতক থেকেই গাজালি ছিলেন এক প্রভাবশালী নাম। কর্ডোভার অনুবাদ কেন্দ্র তাকে ল্যাতিন রূপান্তরের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছিল বিদগ্ধ মহলে। বিখ্যাত দার্শনিক মুশে বিন মায়মুন (মৃ. ১২০৪ খ্রি.), মার্কো ডে টলেডো (মৃ. ১২১৬), ফ্রান্সিস ডে আসসিসি (১২২৬), দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ (মৃ. ১২৫০), রেমন মার্টি (১২৮৬), টমাস একুইনাস (মৃ. ১২৭৪), রজার বেকন (মৃ. ১২৯৪ খ্রি.), রেমন লোল (মৃ. ১৩১৬) থেকে নিয়ে পরবর্তী পণ্ডিত-দার্শনিক মহলে গাজালি ছিলেন আলোচিত ও পঠিত। তাদের ওপর নানাভাবে ছিল গাজালির প্রভাব। একুইনাস কিংবা বেকনের রচনায় বারবার গাজালির ঋণ উচ্চারিত, তার গ্রন্থাবলির নাম উল্লিখিত। পরে গাজালির প্রভাব ফ্রান্স-ইতালি ও ব্রিটেনে সম্প্রসারিত হয়েছে আরো।

ডেকার্তের ওপর গাজালির প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন তিউনিসিয়ান ইতিহাসবিদ উসমান আল-কা’ক। তিউনিসিয়ায় দশম ইসলামিক থট ফোরামে তিনি হাজির করেন ডেকার্তের ওপর গাজালির প্রভাবের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ওসমান আল কা’ক ভ্রমণ করেছিলেন প্যারিসে ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সেখানে গাজালির আল মুনকিজের একটি ল্যাতিন অনুবাদ তিনি খুঁজে পান, যাতে ডেকার্তের হাতে লেখা এ মন্তব্য রয়েছে যে, এ গ্রন্থকে আমাদের পদ্ধতিতে যুক্ত করে নেয়া হবে। এ প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেনChristopher Hurtado। তিনি লিখেন Al-Ghazali and Descartes: Correlation or Causation? শীর্ষক অভিসন্দর্ভ। এতে ক্রিস্টোফার দেখান, ডেকার্তের সংশয়ের পদ্ধতি গাজালির সাথে স্পষ্টভাবে একাত্ম। ডেকার্তের কণ্ঠে গাজালির প্রতিধ্বনি শোনা যায় যেসব ক্ষেত্রে, তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ডেকার্তের গাজালির অনুসারী যুক্তি ও সংশয়ের ধরনে। দ্বিতীয়ত, একটি যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে সংশয়ের ব্যবহারে। তৃতীয়ত, এ ভিত্তিকে নিশ্চিত করতে স্রষ্টার দিকে আহ্বানে এবং চতুর্থত, এই দাবিতে যে, এসব চিন্তা-দর্শন অর্জিত হয়েছে ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির দ্বারা নয়, ঐশীপ্রেরণায়।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *