ডিজিটাল আইন পরিবর্তনের নামে প্রতারণা করা হয়েছে

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নাগরিকদর নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বলে সমােলাচনার মুখে এখন তাতে নামমাত্র পরিবর্তন করে করা হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ)। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন হুবহু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নকল না হলেও অপরাধগুলোর সংজ্ঞা অপরিবর্তিত আছে এবং অধিকাংশ ধারাতেই সাজাও এক।

গতকাল শনিবার সেন্টার ফর গর্ভনেন্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে মুখ্য আলোচক সাংবাদিক ও কলামিস্ট কামাল আহমেদ এমন মন্তব্য করেছেন। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও আমরা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ ও উন্নত বিশ্বে বিদ্যমান ডিজিটাল আইনের বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ব্রিটেনে সরকারি খেতাবপ্রাপ্তদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের দায়ে পাঁচ লাখ পাউন্ড জরিমানার এবং টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশে জবাবদিহিতার অভাবের কথা তিনি বলেন। ইইউ বা ব্রিটেনের আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যত্যয় ঘটার মতো কোন বিষয় না থাকার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

কামাল আহমেদ বলেন, সংক্ষিপ্ত নামকরণ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের আইনের সাথে আমাদের আইনের আর কোন সামঞ্জস্যতা নেই, নাগরিকদের অগ্রাধিকারে তো নয়ই। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনের প্রয়োগ ব্যক্তির জন্য বা পেশার জন্য নয়, সকলের জন্য হওয়া উচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আইনটি সংশোধন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে সরকার যে নতুন আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের এই আইন নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করার লক্ষ্যে সিজিএস এই ওয়েবিনার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রেপ্লিকেশন এর ক্ষেত্রে বড় সমস্যা এ আইনে বিচারের দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রেও তাই। এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্য করা হয়েছে।

সিজিএস এর গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই হলেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এ আইনের প্রয়োগ শিথিল করা হবে বলে সরকার পক্ষের বক্তব্যের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের খুশি করতে কোনো আইন হতে পারে না। তিনি আরে া বলেন, এজেন্সির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তো মত প্রকাশ হতে পারে না, তাছাড়াও বহু সমালোচিত অফিস সিক্রেসি অ্যাক্ট এই নতুন আইনেও আছে। সাইবার সিকিউরিটি আইনে কিছু ধারা সম্পূর্ণ হুবহু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরই ধারা। যুক্তরাজ্যে একটি আইন প্রণয়নের পূর্বে ২০১৮ সাল থেকে নিয়ে প্রথমে গবেষণা হয়েছে, স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা হয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে সাইবার সিকিউরিটি আইন নিয়ে নাগরিকের মতামত দেবার সময় মাত্র ১৪ দিন। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছে বলে, তাড়াহুড়া করে সাইবার সিকিউরিটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা তাই প্রশ্নবিদ্ধ।

নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশে-বিদেশে কুখ্যাতি অর্জন করায় সরকার এর নাম পরিবর্তন করেছে মাত্র। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথেও প্রতারণা করেছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন অবশ্যই প্রয়োজন স্বীকার করে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা উধাও হয়ে যাওয়া, লাখ লাখ নাগরিকের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভার দুই দিন বন্ধ থাকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার কাজ সাংবাদিকদের হলেও অবাধ তথ্য প্রবাহের প্রয়োজন গোটা সমাজের। তাই, এ জাতীয় আলোচনায় কেবল লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীই নন, সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। দেশে ডিএসএস, সিএসএ এর মতো আইন থাকলে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা করা অসম্ভব।

সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে গিয়ে শুরুতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইনে অজামিনযোগ্য ধারা পরিবর্তিত করে জামিনযোগ্য ধারা করা হলেও নাগরিকদের এই সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অতীতে লেখক মুশতাক বহুবার জামিন এর আবেদন করলেও, তাকে আটক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ডিএসএস এবং সিএসএ এর মধ্যে কোনো তফাত নেই। যতোদিন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হবে, জনগণের শাসন না আসবে, ততোদিন কোনো আইনেই সুফল পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর যতোগুলো দেশে ঘৃণ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, নইলে জাতিসংঘ বারবার এটা নিয়ে এভাবে কথা বলতো না।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি মিডিয়া এবং সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক আসিফ বিন আলী বলেন, কোনো আইন তখনই সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় যখন দেশে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে।

গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রোজিনা বেগম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনগুলোর মতো আইনগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশকে প্রকারান্তরে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সেজন্য সরকারের উচিত নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া। ##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *