তোমরা তো একালের মানুষ। সেকালের আমি আজ তোমাদের একটা গল্প বলব। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার গল্প। এখন তো তোমরা গলির মুখে কোনো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কিম্বা রাস্তার এক পাশের একটি মেশিনে বোতাম টেপ, আর ওখান থেকে কী সুন্দর কচকচে সব নোট বের হয়ে আসে। চাইলে তো টাকা পেয়ে গেলে। আমাদের আমলে কিন্তু ব্যাপারটা এমন ছিল না। নিজের টাকা নিজের তুলতেই জান বের হয়ে যেত। পরের টাকা হলে যে কী হতো কে জানে বাপু!
এবার বলি শোন, আমার একটাই ব্যাঙ্ক ছিল, তাতে ছিল একটাই অ্যাকাউন্ট। আজকাল তো তোমরা অনলাইনে লগ ইন করো, সাবসক্রাইবর করো, এভাবে নতুন নতুন ব্যাঙ্কে তোমাদের কত অ্যাকাউন্ট। আমাদের বাবা ওরকম ছিল না। নাখালপাড়ায় নাবিস্কোর মোড়ে একটা মাত্র ব্যাঙ্ক ছিল। অগ্রণী ব্যাঙ্ক। এখনও আছে কিনা জানি না। ব্যাঙ্কের প্রবেশ মুখে ছিল লোহার কলাপসিবল গেট। পুরোটা টেনে একটু খানি ফাঁক করে রাখা হতো আর অনেক কসরৎ করে ঢুকতে হতো ভেতরে।
গেটের কোনায় হাড় জিরজিরে একজন প্রহরী বসে থাকত। তার হাতে যে বন্দুকখানা ছিল দেখে বোঝাই যেত এর ভেতরে গুলি নেই, গুলি থাকলে ট্রিগার কাজ করে না, আর কাজ করলে লোকটার গুলি করারই প্রশিক্ষণ নেই।
একটা চেকের মধ্যে সবকিছু লিখে নিয়ে যেতাম ব্যাঙ্কে। কাউন্টারে জমা দিতাম। উঁচু একটা ডেস্কের ওপাশে একজন লোক নিচু হয়ে বসে একটার পর একটা চেক নিত।
আমার সামনে ছিল একটা কাঁচের দেওয়াল। তার নিচের দিকে ইঁদুর যেতে পারে ওরকম গোল একটা গর্ত। তার ভেতর দিয়ে চেকটা ঢুকিয়ে দিতাম। তিনি লাল নীল কালি দিয়ে চেকের সামনে পেছনে সই দিতেন। খাতা দেখে স্বাক্ষর মিলিয়ে আমার সই এর পাশে দিতেন টিক চিহ্ন।
তার পর সেটা পাঠিয়ে দিতেন আরেক জনের টেবিলে। তিনি সেটা মিলিয়ে দেখতেন। একটা বিশাল সাইজের জাবদা খাতায় সবকিছু লিখতেন। কে টাকা তুলছে, কবে তুলছে, কত টাকা তুলেছে… এটসেট্রা।
তার পর সেই চেক চলে যেত আরেকজনের কাছে। তার টেবিল ঘুরে আরো একজনের টেবিলে। কতো যে টেবিল ঘুরতো। সেসব দেখতে দেখতে ঘুরপাক খেত আমার মাথাটাও। সবশেষ যেত ম্যানেজারের টেবিলে। সাহেব আবার বসতেন কাঁচঘেরা ঘরে। ওখানে সবাই যেতে পারত না। স্যারের টেবিলে সই হওয়ার পরেও একটা বড় খাতার ভেতরে চেকটা চাপা পড়ে থাকত। আর এই সুযোগে কর্মকর্তারা মেতে উঠতেন বাড়ির গল্পে- কোন ভাবীর বাচ্চা হয়েছে আর গতরাতে কার মাছের তরকারিটা স্বাদের ছিল।
মজার ব্যাপার হল একজন কর্মচারির টেবিল থেকে আরেক কর্মচারির টেবিল কিন্তু দূরে ছিল না। চাইলে তারা নিজেরাই হাত উঠিয়ে চেকটা নিতে পারতেন। কিন্তু নিতেন না। নিলে যে জাত চলে যাবে। বসে থাকতেন পিওনের জন্য। পিওন বই এনে দিলেও পড়ে থাকত টেবিলে। তাড়া দিতাম। বলতাম ভাই একটু দেখেন না, প্লিজ। ভাবখানা এই যেন আমি তার টাকা নিচ্ছি। পিওনকেও পাওয়া যেত না ঠিক মতো। যখনই ডাকতে যেতাম শুনতাম তিনি ব্রেকে গেছেন।
এক ঘণ্টা লেগে যেত টাকা তুলতে। তারপর যখন টাকাটা পেতাম সেটা খুব সন্তর্পনে পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে চোরের মতো বের হয়ে আসতাম। যেন কেউ দেখে না ফেলে!
* মিজানুর রহমান খান সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক। বিবিসিতে কর্মরত, ডয়চে ভেলে ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায়ও কাজ করেছেন।