জ্ঞানের ইসলামীকরণ : একটি অবলোকন । মুসা আল হাফিজ

ধর্ম ও দর্শন প্রবন্ধ-কলাম
শেয়ার করুন

ইসলামে জ্ঞান হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট প্রত্যয়, যার মাধ্যমে তৈরি হয় আল্লাহ সম্পর্কে অবগতি; মানুষ ও মানুষের পৃথিবী সম্পর্কে অবগতি; যার মাধ্যমে তৈরি হয় দায়িত্বশীল জীবনের বাস্তবতা ও বাস্তব দক্ষতা। জ্ঞান জানিয়ে দেয় এখানকার জীবন, তার উৎস ও পরিণতি, আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, তার নির্দেশনা ও জীবনে এর প্রতিফলনের সহজাত প্রকৌশল। ওহিয়ে মাতলু (আল কুরআন) ও ওহিয়ে গায়রে মাতলু (আল হাদিস) সত্য-সুন্দর ও সফলতার যে পন্থানির্দেশ করে, তার ভিত্তিতে মানবিক বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞানপ্রাজ্ঞ ঐকমত্য, অভিজ্ঞতা, যুক্তিশীলতা ও অন্যান্য জ্ঞানীয় উপায়-উপকরণের অবলম্বনের মধ্য দিয়ে ইসলামে জ্ঞানবৃক্ষ শেকড় গাড়ে, ডালপালা প্রসারিত করে। যার মধ্যে ইহকাল-পরকাল সমস্বরে একীভূত, একই লক্ষ্যের পবিত্রতায় বিন্যস্ত। এ জ্ঞানের পরিসরে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলো এক দিকে যেমন আল্লাহর পরিচিতির উপকরণ, তেমনি সে জীবনকে সহজ-সুগম ও সাবলীল করার অমোঘ উপাদান। সামাজিক-মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানগুলো, তার প্রয়োগ, উপযোগ, দক্ষতাবৃদ্ধি ও ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা ইসলামী জ্ঞান পরিসরের আওতাধীন প্রসঙ্গ।

ফলে জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রসঙ্গটি দুই দিক থেকে আলোচিত। জ্ঞানমাত্রই ইসলামী, এমন প্রস্তাবনা আমরা শুনেছি এবং এ প্রস্তাবনার দাবি হলো, জ্ঞানের ইসলামীকরণ নয়, বরং দরকার হলো জ্ঞানে দক্ষতার বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ। জ্ঞান যেখানে, সেখানে রয়েছে ইসলাম। জ্ঞান ও ইসলাম সমান্তরাল।

কিন্তু জ্ঞানের ইসলামীকরণের সুস্পষ্ট অর্থ রয়েছে এবং তা জ্ঞানের নতুন সংজ্ঞায়ন ও তথ্যগুলোকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানায়। সে আহ্বান জানায় পাশ্চাত্য জ্ঞানভাষ্যের একাধিপত্যের প্রেক্ষাপটে ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তাভাষ্যের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিষ্ঠায়; ইসলামী জ্ঞানদৃষ্টির পুনর্গঠন ও পুনঃপ্রতিস্থাপনে। জ্ঞানের ইসলামীকরণ মূলত জ্ঞান ও শিক্ষার মর্মমূলে ইসলামী মূল্যমানগুলোর প্রতিষ্ঠাকামী। মানবপ্রকৃতি জ্ঞান অর্জনের প্রশ্নে ইসলামী ধ্যান-ধারণার সংস্থাপনে প্রয়াসী।

জ্ঞানের ইসলামীকরণের স্বরূপ কী? এ মূলত এক ধরনের বৌদ্ধিক ও চৈন্তিক প্রক্রিয়া ও তৎপরতা, এমন এক কর্মধারা, যা এক দিকে চেতনাগত মূল্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অন্য দিকে পদ্ধতিগত শৃঙ্খলায় বিন্যস্ত। সে ব্যাখ্যা করে জ্ঞানের ইসলামী উৎসের মূল্যায়নের আবেদন কী? সে উপস্থাপন করে জ্ঞানের বিন্যাস ও বিভাজনে ইসলামী ভাবধারার প্রতিফলন কেমন? সে প্রমাণ করে প্রচলিত উপকারী জ্ঞানের সাথে কুরআন ও সুন্নাহকেন্দ্রিক জ্ঞানের নিরীক্ষার উপায় ও উপকার কী? এ কর্মধারার আওতায় রয়েছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামের তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন, ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে চিন্তনপদ্ধতি অনুসরণ, সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতের অধ্যয়ন ও এতে ইসলামের আবেদন তুলে ধরা, নতুন নতুন সমস্যায় যোগ্যতম মাধ্যমে যথাযথ ইজতিহাদের মতো বিষয়! এ নিছক কতিপয় সংযোজনের প্রক্রিয়া নয়। কুরআনের কিছু আয়াত ও নির্বাচিত কিছু হাদিসের সংযোজনের মাধ্যমেই তা নিশ্চিত হয়ে যাবে না। এ হচ্ছে খোদাবর্জিত যে জ্ঞানতত্ত্ব, তার আমূল পরিবর্তন-প্রক্রিয়া।

এ হচ্ছে ইসলামের আলোকে জ্ঞানের নববিন্যাস ও স্তরায়ন। পশ্চিমা অনুসিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্ত ও তত্ত্বগুলোর পুনর্মূল্যায়ন ও ইসলামী জ্ঞানদৃষ্টির দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞ এখানে রয়েছে। যেসব বিভ্রান্তি জ্ঞানের নামে মানব মনে, মস্তিষ্কে ও জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে, সেগুলোর ভ্রান্তিনির্দেশ এবং সেখানে সত্যজ্ঞানের নবপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ কর্মপরিক্রমা এখানে রয়েছে। জ্ঞানের ইসলামীকরণের মৌলিক মনোযোগ হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টি এবং দুনিয়া ও দ্বীনের সমন্বয়সাধন।

পশ্চিমা দুনিয়ায় ধর্ম বাদ দিয়ে জ্ঞানের যে দর্শন বিদ্যমান, যার প্রতিষ্ঠা এখন বিশ্বজুড়ে, সেই জ্ঞানদর্শন মূলত স্রষ্টাকে অস্বীকার, অবজ্ঞা বা অবহেলা করে তৈরি করে জ্ঞানদৃষ্টি এবং ব্যাখ্যা করে জীবন ও জগত। ইসলাম এর বিপরীতে স্রষ্টার অভিমুখকে রাখে কেন্দ্রে এবং এরই আলোকে মানবপ্রকৃতি ও জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানকে তিন ভাগে ব্যাখ্যা করেন সৈয়দ আলী আশরাফ। এ বিভাজনের যৌক্তিকতা নিহিত আছে মানুষের সাথে আল্লাহর, মানুষের সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যে। অতএব মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্কবিষয়ক যে জ্ঞান, তা আসে মূলত আল্লাহর তরফে, একে আমরা বলি ধর্মবিজ্ঞান (উলুমুদ্দিন)। সেই জ্ঞান থেকেই বিকশিত হয় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভিত্তিক মানবিক বিজ্ঞান (উলুমুল ইনসানিয়াহ) এবং মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক ভিত্তিক প্রকৃতিবিজ্ঞান (উলুমুত তাবয়িয়্যাহ)।

পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির নির্দেশে প্রকৃতিজয় এবং মানববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার উচ্চকণ্ঠ প্রবক্তা। কিন্তু ইসলাম চায় আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে প্রকৃতির ওপর মানব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বিশেষত মানুষের ব্যবহারিক জীবনকে সহজ-সুগম ও আত্মনির্ভরশীল করার জন্য বিজ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার জারি থাকবে। অন্য দিকে মানসিক প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উন্নত নৈতিক মান নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু আবিষ্কার ও প্রযুক্তির কল্যাণী ব্যবহার এবং নৈতিক মানের প্রয়োজনীয় মাত্রা খোদার সাথে সম্পর্কের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে যুক্ত, যার অনুপস্থিতি জীবনকে বিষিয়ে তোলে, বিপন্ন করে। সে জন্য বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে তথা প্রযুক্তি ও নৈতিকতার মধ্যে সুষম সমন্বয় জ্ঞানের ইসলামীকরণের দাবি। একটি জীবনে আনে গতি, অপরটি নিশ্চিত করে প্রশান্তি। দক্ষতা ও সক্ষমতা এবং সততা ও পবিত্রতা একীভূত হলেই জীবন হয় গতিমান, সুখকর, কল্যাণঅভিমুখী। সুন্দর ও উন্নত জীবনের জন্য প্রয়োজন বিশ্বাসের প্রগাঢ়তা ও বুদ্ধিবাদের প্রত্যয়।

জ্ঞানের ইসলামীকরণের প্রকল্প ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর অন্যতম প্রস্তাবক ড. ইসমাইল রাযী আল ফারুকী বলেন, জ্ঞানের ইসলামীকরণের মানে হলো, তথ্যাদির কার্যকারণ ও সম্পর্ক নিয়ে পুনর্বার চিন্তাভাবনা করতে হবে, উপসংহারগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্দেশ্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং তা এমনভাবে করতে হবে, যাতে বিষয়গুলোর দর্শনকে সমৃদ্ধ করে এবং ইসলামের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এ লক্ষ্যে সত্যের ঐক্য, জ্ঞানের ঐক্য, মানবতার ঐক্য, জীবনের ঐক্য, সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, মানুষের প্রতি সৃষ্টির আনুগত্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য- এ চিন্তাধারার আলোকে পশ্চিমা ধারণাগুলোকে অবশ্যই সংশোধন করতে হবে এবং বাস্তবতাকে উপলব্ধি ও বিন্যস্ত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। তদ্রূপ পশ্চিমা মূল্যবোধের স্থলে ইসলামী মূল্যবোধকে পুনঃস্থাপন করা উচিত এবং সে অনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যার্জনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।

অতএব, জ্ঞানের ইসলামীকরণ দাবি করে, যেসব মূল্যবোধের সত্যতা ও কল্যাণকারিতা স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষায় সেগুলোর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এমন মানদণ্ড প্রয়োজন, যা শাশ্বত, চিরায়ত ও ফলপ্রসূ। এসব মূল্যবোধ ও মানদণ্ডের ভিত্তি মূলত ওহিজাত। ওহি মানুষকে কখনোই যান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক ধারণায় বন্দী হতে দেয় না। মানুষ যেহেতু রক্ত-মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটি বান্ডিল নয়, তার যেহেতু রয়েছে আত্মিক বৈশিষ্ট্য, একে তাই বিকশিত করতে হবে। শিক্ষায় দেহ ও মনের পাশাপাশি আত্মিক বিকাশের আয়োজন ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। রুহানি প্রকৃতি ও মানবস্বভাবের সুষম বিকাশের উদ্যোগ থাকতে হবে। জ্ঞানের যেসব বিষয় শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে, তার সব ক’টিতে ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। সেসব অন্তর্দৃষ্টির যথাযথ ও জ্ঞানপ্রাজ্ঞ উপস্থাপনে জ্ঞানীয় বিষয়কে সমৃদ্ধ, পূর্ণ ও সত্যনিষ্ঠ করতে হবে।

জ্ঞানের ইসলামীকরণ যেসব লক্ষ্যমাত্রা দ্বারা উদ্দীপিত, তার মূল্য আজকের বাস্তবতায় যেমন ব্যাপক, তেমনি স্থায়ী বিচারে এর গুরুত্ব অনন্য। বস্তুত জ্ঞানের ইসলামীকরণ কী চায়, তা ব্যাখ্যা করতে হলে কতিপয় দিক লক্ষণীয়। যেমন- ১. মানবসত্তা ও জ্ঞানের অবিমিশ্র যে যৌথতা আল কুরআনে প্রমাণিত, তার প্রতিষ্ঠা। ২. আল্লাহ ও মানুষ, মানুষ ও মানুষ এবং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্কের যথাযথ ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান স্পষ্ট করা। মানবজাতির অধিকাংশ যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে এর অনুপস্থিতি। যার ফলে পৃথিবীতে সঙ্কটের শেষ নেই। ৩. মুসলিম চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির সংস্কার ও মুসলিম মানসের ইসলামনির্দেশিত পুনর্গঠন। ৪. জ্ঞান ও জ্ঞানীয় শাস্ত্রগুলো প্রধানত সত্যকে তালাশ করে। কিন্তু ওহিকে বর্জন করে সত্য অবধি আমরা খুব কমই যেতে পারি। জ্ঞানের ইসলামীকরণ সত্য তালাশকে ওহির দ্বারা পথ দেখাতে চায়। যেখানে জ্ঞানের অন্যান্য উপকরণ হবে সহায়ক। ৫. বস্তু ও আত্মার যৌথতা এবং মিলিত বিকাশ নিশ্চিত করা। বস্তুগত বাস্তবতা উপেক্ষা করলে যেমন বৈরাগ্য ও ইউটোপিয়ার অবাস্তবতা চাপিয়ে দেয়া হয়, তেমনি আত্মার বিকাশ অবজ্ঞা করলে মানুষ হয়ে ওঠে রোবট। শিক্ষা কেবল একে রঙিন ও চকচকে করে মাত্র। উভয় অবস্থাই বিপজ্জনক। ইসলাম ভারসাম্যের দর্শন উপস্থাপন করে। জ্ঞানের ইসলামীকরণ সেই দর্শনের প্রতিষ্ঠাকামী। ৬. শিক্ষার কল্যাণী প্রয়োগের জন্য জরুরি হলো চিন্তা ও মননে স্বচ্ছতা ও উন্নত নৈতিকতা। মানবকল্যাণের প্রগাঢ় বোধ। যার অভাবে আজকের দুনিয়ায় উন্নত প্রযুক্তি ও আবিষ্কারের অপব্যবহার মানববিশ্বের জন্য অভিশাপ ডেকে এনেছে। জ্ঞানের ইসলামীকরণ ঈমাননির্দেশিত প্রবল নৈতিকতাকে জ্ঞান ও চিন্তায় প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। ৭. কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত মুসলিম জীবনের পুনর্গঠন। যেখানে অবধারিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। মুসলিম সমাজের অশান্তি ও বিভক্তি দূরীকরণ, ইসলামনির্দেশিত সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন। হীনম্মন্যতা, অনাস্থা, পরাজিত মানসিকতা এবং সামগ্রিক অবক্ষয়ের দিকগুলোর মোকাবেলা। ৮. মানবীয় সম্ভাবনাগুলোর বিকাশ ও এর আনুকূল্য নিশ্চিত করা। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনাগুলোর পাশাপাশি আধ্যাত্মিক, নৈতিক সম্ভাবনা ও সামর্থ্যগুলোর যথোচিত বিকাশে মানবমেধা ও মানবসত্তার প্রকৃত উন্নয়ন; মানবসম্পদের উন্নয়ন। ৯. চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে নবুয়তের শিক্ষা ও উত্তরাধিকারের প্রতিস্থাপন। ১০. ইসলামনির্দেশিত জীবনদৃষ্টির জ্ঞানদক্ষ উপস্থাপন ও বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামের কল্যাণকারিতা যথোচিতমাত্রায় নিশ্চিত করা।

জ্ঞান ইসলামীকরণের যে প্রক্রিয়া ও আন্দোলন, একে অনেকেই আধুনিক প্রচেষ্টা ভেবে ভুল করেন। এর সূচনা সৃষ্টির সূচনা থেকে। যখন মহান আল্লাহ আদম আ:-কে সৃষ্টি করেন, এরপর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ধারা শুরু হয়, জ্ঞানদান ও জ্ঞানগ্রহণের ইসলামী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। নবীদের ধারাবাহিক সাধনার শেষ ও পূর্ণতম স্তর হলো মহানবী সা:-এর শিক্ষা ও আদর্শ যা জ্ঞানের ইসলামী প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণতা নিশ্চিত করে। তার পর সেই জ্ঞানধারা নানা স্তর ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে অগ্রসর হয়েছে। ড. ইসমাইল রাযী আল ফারুকী বিশেষভাবে এর আটটি স্তর নির্দেশ করেছেন। সর্বশেষ স্তরে আছে আধুনিক কাল, যখন জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রত্যয়টি সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত হয়। পাশ্চাত্যায়নের বিপরীতে ইসলামায়ন কথাটির ব্যবহার করেন ড. সায়্যিদ মুহাম্মদ নকীব আল আত্তাস; ১৯৬৭ সালে। এরপর ১৯৭৭ সালে Secular-Secularization-Secularism শিরোনাম- প্রবন্ধে Islamization of knowledge প্রত্যয় ব্যবহার করেন।

১৯৭৭ সালে মক্কায় শিক্ষা সম্মেলনে জ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব ও জ্ঞানপ্রক্রিয়ার ইসলামীকরণের জোরালো প্রস্তাব করা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের মধ্যে ৬টি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, (International Institute of Islamic Thout) সংক্ষেপে IIIT এবং ড. সৈয়দ আলী আশরাফের নেতৃত্বে মক্কাভিত্তিক ‘শিক্ষা ইসলামীকরণ আন্দোলন’ জ্ঞান ও শিক্ষার ইসলামীকরণ নিয়ে দুই ধারায় কিন্তু একই লক্ষ্যে কর্মযজ্ঞ শুরু করে।

মানব প্রকৃতি ও জ্ঞান আহরণ সম্পর্কিত ইসলামী ধ্যান-ধারণার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনে সচেষ্ট হন আলী আশরাফ। উম্মাহর চিন্তাধারা ও জ্ঞানতত্ত্বের সংস্কার এবং এর আলোকে সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর ইসলামীকরণে গুরুত্ব দেন ড. ফারুকী। প্রথমটি প্রাতিষ্ঠানিকতাকে দেয় প্রাধান্য। দ্বিতীয়টি সামাজিক প্রস্তুতির ওপর দেয় জোর। ড. আলী আশরাফ প্রধানত আধ্যাত্মিকতার অভিমুখী হলেও ড. রাযীর প্রধান মনোযোগ ছিল সামাজিক বিজ্ঞানে, মানবসমাজের বহির্দিকে। ১৯৮৭ সালের দিকে ড. রাযী ও আলী আশরাফ যৌথভাবে কাজের প্রশ্নে একমত হন এবং উভয় চিন্তায় ঘটে সমন্বয়।

এরপর প্রফেসর ড. আবদুল হামিদ আবু সোলায়মান এবং ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানীর মতো গবেষকরা জ্ঞানের ইসলামীকরণ আন্দোলনকে এগিয়ে নেন এবং নতুন অন্তর্দৃষ্টি সংযোজন করেন।

জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যেমন সনাতন ও ঐতিহ্যবাহী পন্থা রয়েছে, তেমনি আধুনিক বাস্তবতাবিচারী পন্থা-প্রক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এ ধারার অগ্রগতি ও পুষ্টিবিধানে প্রয়োজন ব্যাপকতরো প্রভাবশালী প্রয়াস। এ জন্য বহুমাত্রিক সুপারিশ রয়েছে বিদগ্ধ মহলের। এ ক্ষেত্রে ড. ইসমাইল রাযী ফারুকী কয়েকটি ধাপ নির্দেশ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে-
প্রথম ধাপ : আধুনিক জ্ঞান আয়ত্তে আনা ও শ্রেণিবিন্যাসকরণ।
দ্বিতীয় ধাপ : জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নানামাত্রিক জরিপ।
তৃতীয় ধাপ: ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন ও আয়ত্তে আনা।
চতুর্থ ধাপ : সমকালীন সমস্যার প্রেক্ষিতে অতীতের মনীষীদের ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়ন ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে তাদের গবেষণাকর্মের বিশ্লেষণ এবং জীবন ও চিন্তার অন্যান্য বিভাগের সাথে সমসাময়িক সমস্যার সম্পর্ক চিহ্নিতকরণ।
পঞ্চম ধাপ : বর্তমান জ্ঞান শাখাগুলোর সাথে ইসলামের সুনির্দিষ্ট সাযুজ্য স্থাপন।
ষষ্ঠ ধাপ: আধুনিক জ্ঞানের বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা।
সপ্তম ধাপ : ইসলামী জ্ঞানের উৎস পর্যালোচনা: ঔৎকর্ষ।
অষ্টম ধাপ : উম্মাহর প্রধান সমস্যাবলি ও এর প্রতিবিধান জরিপ করা।
দশম ধাপ: জ্ঞান ও চিন্তার প্রতিটি বিষয়ে ইসলামী বয়ানের সৃজনশীল বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ।
একাদশ ধাপ : ইসলামী কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের পুনর্বিন্যাস ও পাঠ্যপুস্তক রচনা।
দ্বাদশ ধাপ : ইসলামী জ্ঞানের প্রসার, দা’ওয়াহ ও এর অনুকূলে সামাজিক ও বৃহত্তর সক্রিয় মতামত গঠন।

প্রতিটি ধাপই ব্যাপকতর বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে এবং সেখানে কাজও বহুস্তর। এ কাজের ধারায় যেমন সমন্বয়ী শিক্ষায়তন গড়ে তোলা জরুরি, তেমনি জরুরি দক্ষ শিক্ষক ও গবেষণাগার। শিক্ষায়তনে শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই ঐহিক, পারলৌকিক, প্রাকৃতিক এবং সামাজিক জ্ঞানবিজ্ঞানকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গ্রহণ-বর্জন করতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা সরবরাহ করতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলে যেসব ধর্মবিরোধী ভাবধারা রয়েছে, তার স্থলে ইসলামী ভাবধারাভিত্তিক শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।

কিন্তু বিদ্যায়তন এ পথে একটি পদক্ষেপমাত্র। জ্ঞানের ইসলামীকরণের রয়েছে সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, শাসনতান্ত্রিক নানা দিক ও মাত্রা। এর এক প্রান্তে আছে সমাজমনের প্রস্তুতি, আরেক প্রান্তে আছে জ্ঞানীয় ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবায়নপ্রয়াস। এক্ষণে সাহিত্য, শিল্পকলা, সমাজবিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞানকে ইসলামের দৃষ্টি থেকে আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তার বোধ সঞ্চারিত করতে হবে ব্যাপকভাবে। যার জন্য গণসম্পৃক্ততার সব ফলদায়ক মাধ্যমকে সর্বোচ্চমাত্রায় উত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি এর বাস্তবায়নপথে প্রয়োজনীয় গবেষক, গবেষণা-উপকরণ, পাঠসামগ্রী ও জ্ঞানীয় দক্ষতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক সক্ষমতার পথেও অগ্রসর হতে হবে।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *