জসওয়ান্ত সিং এর গ্রন্থ ব্যবচ্ছেদ – ৪র্থ পর্ব
জসওয়ান্ত সিং বলেছেন যে, জিন্নাহ তাঁর হতাশা সত্ত্বেও ভারত বিভাগের পক্ষে ছিলেন না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা অযোধ্যার সমৃদ্ধ এস্টেট মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব (মোহাম্মদ আমির আহমেদ খান) এর স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, “একটি ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে আমার অবস্থান আমাকে জিন্নাহ’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থায় নিয়ে আসে। তিনি আমার ধারণাগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করেন এবং এ সম্পর্কে মুসলিম লীগের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রকাশ্যে কোনোকিছু প্রকাশ করতে আমাকে নিষেধ করেন। কারণ তাতে জনগণের বিশ্বাস হতে পারে যে, আমার মতামতের সঙ্গে জিন্নাহ’র সংস্রব রয়েছে এবং তিনিই আমাকে এ ধরনের ধারণা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছেন। আমি যেহেতু নিশ্চিত ছিলাম যে আমার ধারণাই সঠিক, সুতরাং আমি জিন্নাহ’র অবস্থানের সঙ্গে কোনো আপস করতে চাইনি। অতএব, আমি জিন্নাহ’র অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং প্রায় দুই বছর পর্যন্ত জিন্নাহ’র কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক এবং অনুষ্ঠানাদি ছাড়া তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো না।”
ভারতকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য প্রতিটি উদ্যোগের ব্যর্থতার পেছনে দায়ী ছিলেন মুখ্যত নেহরু ও প্যাটেল এবং সাধারণভাবে কংগ্রেস। এ ব্যাপারে কংগ্রেসের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য গান্ধীর একক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সময়গুলোতে কংগ্রেস গান্ধীজিকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। ১৯৪৩ সালে গান্ধী যখন কারাগারে আটক ছিলেন, তখন জিন্নাহ দিল্লিতে মুসলিম লীগের উন্মুক্ত অধিবেশনে ঘোষণা করেছিলেন যে, গান্ধী যদি সত্যিই মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে আগ্রহী হন, তাহলে এটিকে তাঁর চেয়ে আর কেউ বেশি স্বাগত জানাবে না।” একথা সত্য যে গান্ধী সবসময় ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং এজন্য অনেকের মতো জসওয়ান্ত সিংও গান্ধীর ঐক্য প্রচেষ্টার উল্লেখ করেছেন এবং একই ভূমিকার জন্য জিন্নাহ’র প্রশংসা করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, “যে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৪ সালে গান্ধী-জিন্নাহ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা মুসলিম লীগের ভেতর ও বাহির থেকে জিন্নাহ’র ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। গান্ধীর সঙ্গে জিন্নাহ’র সমঝোতাকে মুসলিম লীগ “কংগ্রেসের জন্য ভারতের স্বাধীনতার পথ পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে” বলে কটাক্ষ করে। কারণ এ সময় জিন্নাহ তাঁর সহজাত অবস্থান থেকে বের হয়ে গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করে রাজনৈতিক যুদ্ধবিরতির জন্য আবেদন করেছিলেন।
গান্ধী-জিন্নাহ আলোচনা প্রসঙ্গে গান্ধীর ব্যক্তিগত সহকারী পেয়ারেলাল নায়ার লিখেছেন, “আলোচনার মাঝখানে তিনি (জিন্নাহ) বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনি একজন হিন্দু হিসেবে এবং হিন্দু কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছেন।’ আমি বললাম, ‘না, আমি ‘না, আমি এখানে হিন্দু বা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে আসিনি। আমি এখানে এসেছি ব্যক্তিগতভাবে।’ আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরে যাই। —- তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি চুক্তিতে আসা উচিত এবং এরপর সরকারের কাছে গিয়ে তাদের বলা উচিত আমাদের চুক্তির শর্তগুলো মেনে নিতে। আমাদের সমাধান তাদের মেনে নিতে বাধ্য করা উচিত।’ আমি বলেছি যে, ‘আমি কখনও ব্রিটিশের ভারতে বিভাজন চাপিয়ে দিতে বলতে পারি না।’ জসওয়ান্ত সিং তার বইয়ে গান্ধীকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন যে, অখণ্ড ভারত সম্পর্কে গান্ধী ও জিন্নাহ মধ্যে কোনো দ্বিমত ছিল না।
এমনকি লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পাঁচ বছর পরও মুসলিম লীগ দলীয়ভাবে ভারত বিভাগের পক্ষে ছিল না, যার ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসের ভুলাভাই দেশাই এবং মুসলিম লীগের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা লিয়াকত আলী খান ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চুক্তিতে উপনীত হন। যেহেতু গান্ধী প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐকমত্যে পৌছতে না পারলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে নেবে না, অতএব তিনি দেশাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌছতে। দেশাই-লিয়াকত চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর গান্ধী সন্তোষ প্রকাশ করেন। কারণ, এ চুক্তিতে কেন্দ্রে অন্তবর্তী কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব ছিল, যাতে বলা হয়েছিল কেন্দ্রীয় আইন সভায় ২০ শতাংশ আসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর জন্য নির্ধারিত থাকবে এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সমসংখ্যক প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু দেশাই-লিয়াকত চুক্তি ব্যর্থ হয় কংগ্রেস এ চুক্তি মানতে অস্বীকার করায়। গান্ধীর ঘনিষ্ট সহযোগী ও কংগ্রেস নেতা জামনা লাল মেহতা লিখেছেন, “সকল প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর জিন্নাহ’র জন্য একমাত্র পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করা।” তা সত্ত্বেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে যদি কোনো সমতা বজায় থাকতো, তাহলে জিন্নাহ ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে সকল উদ্যোগ সমর্থন করতেন।
জসওয়ান্ত সিং আরও লিখেছেন যে, জিন্নাহ’র বিপরীতে জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রধান অভিনেতা হওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করেছেন। যে কারণে ১৯৪৬ সালের ১৬ মে প্রকাশিত কেবিনেট মিশন পরিকল্পনায় ভারতে ফেডারেল কাঠামো বজায় রাখা, মুসলিম লীগের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান দাবি বাতিল করা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে। কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রায় সকল মহলে প্রশংসিত হলেও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, শীঘ্রই কংগ্রেস কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, বিশেষ করে ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশগুলোর গ্রুপিং এর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কংগ্রেস। মুসলিম লীগ এ প্রস্তাবের কোনো অংশের পরিবর্তন চায়নি। ধারণা করা যায় যে, এর ফলে কংগ্রেসের অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে জিন্নাহ’র সংশয় আরও বৃদ্ধি পায়। তিনি ও মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে আর কোনো সহযোগিতা করার পরিবর্তে কংগ্রেসের প্রবল বিরোধিতায় অনড় অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনো ঐকমত্যে পৌছার সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যায়। কেবিনেট মিশন সমঝোতার আরও প্রচেষ্টা চালালেও তা ব্যর্থ হয়। তবুও গণপরিষদের কার্যপ্রক্রিয়া শুরু এবং জওহরলাল নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠণ করা হয়। মুসলিম লীগ গণপরিষদ অথবা অন্তবর্তী সরকারে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এর সূচনা করে, যা ভারত জুড়ে ব্যাপক সহিংসতার ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
জিন্নাহ’র রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন সরদার প্যাটেল। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘আমরা যদি আমাদের অবস্থানে দৃঢ় থাকি, তাহলে মুসলমানরা সংঘাতে লিপ্ত হবে না।’ অর্থ্যাৎ তিনি মুসলমানদের যেকোনো আন্দোলন দমন করতে বল প্রয়োগ করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৪ মার্চ প্যাটেল তার রাজনৈতিক সহযোগী কানজি দ্বারকাদাসকে এক চিঠিতে তার মনোভাব সম্পর্কে জানান:“ … তবে আমি আপনার মতো নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি না। আগামী জুন মাসের আগেই সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মুসলিম লীগ যদি পাকিস্তানের ওপর জোর দেয়, তাহলে একমাত্র বিকল্প হবে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত করা। গৃহযুদ্ধ ছাড়া তারা সমগ্র পাঞ্জাব বা সমগ্র বাংলা পেতে পারে না।”
এর আগে নেহরু পাঞ্জাবকে তিন ভাগে বিভক্ত করার সুপারিশ করেছিলেন: ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা; শিখ অধ্যুষিত এলাকা; এবং মিশ্র জনগোষ্ঠী অধি্যুষত এলাকা।’ কংগ্রেসের এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখটি দুর্ভাগ্যজনক ছিল, কারণ গান্ধী তখন বিহারে দাঙ্গা-উপদ্রুত এলাকায় পরিস্থিতি শান্ত করার অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন; মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। সরদার প্যাটেল এবং নেহরু উভয়েই জানতেন যে, এই অনুপস্থিত দুই ব্যক্তি তাদের বিভাজন পরিকল্পনার বিরোধিতা করবেন। প্রায় তিন সপ্তাহ পর গান্ধী নেহরুকে একটি চিঠি লিখে এই প্রস্তাব গ্রহণের কারণ জানতে চান। একই সঙ্গে তিনি প্যাটেলকেও লিখেন প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা করার জন্য।
এই প্রস্তাবটি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থান ও কৌশলের মৌলিক পরিবর্তন। মাউন্টব্যাটেন ইতোমধ্যে ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তিনি মূল্যায়ন করেন যে, প্যাটেল পাঞ্জাব বিভাজনের পক্ষে এবং পাঞ্জাবকে তিন ভাগে বিভক্ত করা সম্পর্কিত নেহরুর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। জওহরলাল নেহরুর পাঞ্জাব বিভাগ তথা ভারত বিভাগের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, এর বিরোধিতাও ইতোমধ্যে প্রশমিত হয়েছে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারতে আগমনের এক মাসের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ২০ মার্চ জওহরলাল নেহরু জোরেশোরে ভারত বিভাগের কথা বলতে শুরু করেছিলেন। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি আরএসএস’এর বীর সাভারকর, কংগ্রেসের লালা লাজপত রায় এবং মুসলিম লীগের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ বাস্তবায়নের ধ্বংসাত্মক ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কংগ্রেসের জন্য এটি ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত ছিল যে, একটি সংগঠন, যারা মাত্র ত্রিশ বছর আগে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল, সেই কংগ্রেসই এখন ভারত বিভাগের প্রস্তাব উঠিয়েছে এবং তা সফলভাবে কার্যকর করেছে।
গ্রন্থের শেষদিকে জসওয়ান্ত সিং জিন্নাহ’র ভূমিকা সম্পর্কে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী রাম মনোহর লোহিয়া’র “গিল্টি ম্যান অফ ইন্ডিয়া’স পার্টিশন” গ্রন্থ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “এই নেহরু এবং প্যাটেল গান্ধীজির প্রতি আপত্তিকরভাবে আক্রমণাত্মক ছিলেন। তাদের উভয়ের সঙ্গে আমার বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে, যার কিছু আমি এখন বলতে চাই, যা তখন আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল। যদিও এখন আমি কিছুটা ভালোভাবে বুঝতে পারি, তা হলো, শিষ্য হিসেবে তারা তাদের গুরুর প্রতি অত্যন্ত রুক্ষ আচরণ ছিল। এর মধ্যে কিছুটা মনোরোগ বিষয়ক জটিলতা ছিল। তারা মনে করেছিলেন যে, তাদের হৃদয় কোনোকিছুতে জড়িয়ে পড়েছে এবং যখনই তারা আঁচ করতেন যে, গান্ধীজি তাদের উদ্যোগে বাধা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তারা হিংস্রভাবে ঘেউ ঘেউ করেছেন।”
জসওয়ান্ত সিং আরও উল্লেখ করেছেন যে, কবি ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ড. মুহাম্মদ ইকবালকে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার প্রবর্তক বলে মনে করা হয় এবং বিশ্বাস করা হয় যে তিনি এই আন্দোলনে প্রয়োজনীয় মানসিক উপাদানের যোগান দিয়েছেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি একা তাঁর সেক্রেটারি এবং তার টাইপরাইটারের সাহায্যে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও অন্য কেউ নয়, পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।
* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট