জল আর পানির বিতণ্ডা প্রসঙ্গে । মুসা আল হাফিজ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

পাকস্থলিতে গেলে জল ও পানি সমান। কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যে শব্দ দু’টিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। এর ব্যবহার নিয়ে তর্ক ও দ্বন্দ্ব চলমান। কিছু দিন পরপর পুরোনো সেই দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই যেমন হয়েছে পশ্চিম বাংলায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছিল কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে। ২১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবারের সে অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও শিল্পী-সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল প্রচুর। সে অনুষ্ঠানে জল ও পানির প্রচণ্ড ঝাপটা লাগে। যার জের এখনো তীব্রভাবে বয়ে চলছে।

জল ও পানির তর্ক হাজির করে আলোচনা করেন পশ্চিম বাংলার শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। পানিকে তিনি বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়া শব্দ বলে আখ্যায়িত করেন। এর মধ্যে দেখেন সাম্প্রদায়িকতা। এর ব্যবহারে দেখেন ‘বাংলা ভাষার তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য থেকে’ সরে আসা। তিনি বলেন, কোন ভাষা আমাদের ভাষা, সেটি ভাবতে হবে। কারণ দাওয়াত বা পানির মতো শব্দ তার কাছে মনে হয়েছে অপরের শব্দ।

শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাংলা ভাষার তাৎপর্য, বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা সরে আসছি। আমরা দেখছি বহু কারণে, নানান সাম্প্রদায়িক ছাপ বাংলা ভাষায় চলে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘যে শব্দগুলোকে আমরা কখনো বাংলা বলি না, ভাবি না, সেই শব্দ এখন বাংলা ভাষায় ঢুকছে। আমরা কোনোদিন বাংলা ভাষায় পানি ব্যবহার করি না। আমরা কোনোদিন কখনো দাওয়াত দেই না। সুতরাং, ভাবতে হবে কোন ভাষা আমাদের ভাষা।

অনুষ্ঠানটি হচ্ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের শিক্ষা ও স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনের দাবি ও মাতৃভাষা বাংলার চর্চার অধিকতর ব্যাপকতার উপায় অনুসন্ধান হবে এমন আলোচনায়। বাংলা ভাষা সমকালে যে সব সঙ্কট ও আগ্রাসনের সম্মুখীন, সেগুলো থেকে উত্তরণের বিষয়টিও আলোচিত হবে। আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বহু দিক থাকলেও সেখানে শেষ অবধি দাওয়াত আর পানি হয়ে উঠল প্রধান প্রসঙ্গ। কিন্তু ভাষার জন্য জীবনদানকারী আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার , আবুল বরকত, রফিক উদ্দীন প্রমুখ অতিথি আপ্যায়নকে দাওয়াত বলতেন এবং পানিকে পানি বলতেন। তাদের মা-বাবা, পূর্বপুরুষও এমনটিই করতেন। যে বাংলাদেশ, যে ঢাকা এই আন্দোলন সংগঠিত করেছে এবং বিজয় অর্জন করেছে, সেই বাংলাদেশ জল যেমন ব্যবহার করে, পানিও ব্যবহার করে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা ও দাবি হলো এই ব্যবহারের স্বাভাবিকতার সুরক্ষা। বাংলা ভাষা সমকালে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসনের সম্মুখীন হিন্দির তরফে। আর প্রধানত কলকাতা ও পশ্চিম বাংলা সেই আগ্রাসনের তোড়ে যখন ভাসমান, তখন শুভাপ্রসন্নদের কাছে বাংলা ভাষার সুরক্ষার চেয়ে জরুরি হলো পানিকে ঝেটিয়ে বিদায় করা, দাওয়াত বন্ধ করা।

কিন্তু কেন আমাদের জল বলতেই হবে? পানি বললে সমস্যা কোথায়? কেন জল বাঙালি শব্দ হবে আর পানিকে ধরা হবে বাইরে থেকে ঢুকে পড়া শব্দ? এই মনে করার মূলে আছে গুরুতর বিকার। পানি শব্দটি বাংলা ভাষার একেবারে সূচনালগ্ন থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে ভুসুকু পাদের বিখ্যাত এক চর্যায় আছে-
অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়অ ভুসুকু অহেরি ধ্রু

তিন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পানী।
হরিণা হরিণীর নিলঅ ন জানী। ধ্রু।
অর্থাৎ হরিণ নিজের শত্রু হ’ল মাংস-হেতু তারই,
ক্ষণকালের জন্য তারে ছাড়ে না শিকারী।
দুঃখী হরিণ খায় না সে ঘাস, পান করে না পানি,
জানে না যে কোথায় আছে তার হরিণী রানি।
(পাঠোদ্ধার : সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
চর্যার পরে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম হলো বড়– চণ্ডিদাসের আদি মধ্যযুগীয় কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’। সেখানেও আছে পানির ব্যবহার, পানির প্রবাহ, নয়নে পানির অঝোর বরিষণ। কাব্যের সবচেয়ে প্রাণস্পর্শী একটি অংশে কবি লিখেন- ‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।/দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।/তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।/আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।/বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।’

চণ্ডিদাসের কাব্যে বারবার পানির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। ঘনঘন তিনি পানি শব্দের ব্যবহার করেছেন। যদিও খুবই অল্প জায়গায় পানির সাথে জলও হাজির হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’এর যমুনাখণ্ডে দেখা যায়- ‘তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।/উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।’

শুধু শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে কেন, দেবী চণ্ডির মহিমা-গীত হিসেবে রচিত চণ্ডিমঙ্গলে পাচ্ছি পানির ঘাট, পানির ঢেউ! প্রাচীন পাঁচালি কবি মুকুন্দ রাম লিখেন- ‘বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরে/কোন ঘাটে খাবে পাণী/ কাঁখে হেমঝারি মেনকা সুন্দরী/জল সাধে ঘরে ঘরে।’

আসা যাক চৈতন্যমঙ্গলে। চৈতন্যদেবের জীবন ও লীলা-বিষয়ক এ কাব্যসমূহে পানির ব্যবহার রয়েছে। বিখ্যাত পদকর্তা লোচন দাস লিখেন-‘ মুখে নাহি সরে বানী/ দু নয়নে ঝরে পানি…।’

প্রাচীন বাংলার লোক সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো খনার বচন। অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও জীবনাভিজ্ঞানে পূর্ণ এসব বাণীতে রয়েছে পানির ব্যবহার। পানির সাথে মাঝে মধ্যে এসেছে জলও। যেমন- ক. খনা বলে শুন হে স্বামী/শ্রাবণ ভাদরে হবে না পানি। খ. রান্ধি বাড়ি যেবা নারী পুরুষের আগে খায়/ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়।

বাংলার লোক সাহিত্যে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ আরেক উপাদান ডাক। এতেও আছে পানি, আছে জলও। যেমন- ক. থির পানী পাথর সয়; খ. জলেই জল বাধে। প্রবাদ-প্রবচনেও একই বাস্তবতা। যেমন- ক. হাতি ঘোড়া গেল তল/মশা বলে কত জল; খ. ধরি মাছ, না ছুঁই পানি; গ. ধন জন জোয়ানি/কচু পাতার পানি ও ঘ. হালে পানি নেই।

পানি শব্দটি বাংলায় এসেছে প্রাকৃত ভাষার পাণিঅ থেকে, প্রাকৃত ভাষায় শব্দটি আসে পালি ভাষার পানীয় থেকে। অনেকের মতে পালি ভাষায় এর ব্যবহার নিশ্চিত হয় সংস্কৃত পানীয় থেকে। পা এর সাথে কৃৎপ্রত্যয় অনীয় যোগ হয়ে জন্ম নেয় পানীয় শব্দটি। সেখান থেকে পালি ও প্রাকৃত ভাষায় বিবর্তনের মধ্যস্থতায় শব্দটি হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলি, অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষাতেও প্রবেশ করে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, পানীয় শব্দটি মূলত পালি ভাষার। কারণ সংস্কৃত ভাষার চেয়ে পালি ভাষা প্রাচীন ও পালি ভাষার অনেক শব্দ সংস্কৃত ভাষায় ঠাঁই পেয়েছে। পালি ভাষায় ‘পানীয়’ শব্দের অস্তিত্ব রয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় আছে ‘জলম’ আর ‘পানীয়’ শব্দ। এখান থেকে প্রমাণিত যে, পানীয় পালি ভাষার শব্দ এবং জলম সংস্কৃত ভাষার শব্দ।

বাংলা ভাষা জন্মসূত্রে প্রাকৃত ভাষা থেকে যে সব শব্দ অধিকার করে, এর মধ্যে একটি হলো পাণি বা পাণী। শুরুতে পাণী বানানেই লেখা হতো শব্দটিকে। যার স্বাক্ষর আমরা দেখলাম চর্যাপদে। বাংলায় যখন পাণী শব্দের ব্যবহার হচ্ছে, উর্দু ভাষার তখন জন্মও হয়নি। নিরেট অজ্ঞতা থেকে অনেকেই দাবি করেন যেহেতু উর্দু ভাষায় জলকে পানি বলা হয়, ফলে বাঙালি মুসলমানরা জল বুঝানোর জন্য বাংলায় পানি শব্দের আমদানি ঘটান।

উর্দুর জন্ম মূলত দিল্লি ও মিরাটের আশপাশে। ১২০০ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে হিন্দি, ফারসি ও তুর্কির মিশ্রণে যে খাড়িবুলি, রিখতা বা হিন্দুস্তানি ভাষার জন্ম হয়, সেটিই মূলত উর্দু। খাড়িবুলির ভালো নমুনা আছে দিল্লিøর মন্ত্রী, ফারসি ভাষার মহাকবি আমীর খসরুর (১২৫৩-১৩২৫) কাব্যে, হিন্দি কবি কবির দাসের (১৪৪০-১৫১৮) কাব্যে। সেই খাড়িবুলি প্রভাবশালী উর্দু হয়ে বাংলার মুসলমানদের কাছে আসার বহু আগেই পানি শব্দটি বাংলা ভাষার প্রয়োগসচ্ছল একটি সদা ব্যবহৃত শব্দ। এর সাথে না আছে আরবির সম্পর্ক, না ফারসির। আর আরবি বা ফারসির সম্পর্ক থাকলেই কী! ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, জার্মান, কোন ভাষায় নেই আরবি শব্দাবলি? হিন্দি ভাষায় বিপুল আছে আরবি, ফারসি এমনকি তুর্কি শব্দ? আছে বাংলা ভাষায়ও। আরবি ও ফারসির সাথে পরম আত্মীয়তার মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষা তার আত্মগঠনের বহু ঐশ্বর্য লাভ করেছে। আরবি-ফারসির বিপুল অংশগ্রহণে বাংলার যে অগ্রসর রূপায়ন হয়েছিল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ভাষায় সেটিকে বলা যায় যাবনি মিশাল। যা ছিল ঔপনিবেশিক আমলের আগে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা।’ (Lingua Franca)।
তখনকার প্রধান হিন্দু কবিদের কাব্যে এর নমুনা দেখা যাক।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কবিতা-
মানসিংহ পাদসায় হইল যে বাণী।
উচিত যে আরবি পারসি হিন্দুস্তানি।।
পড়িয়াছি যেই মত বর্ণিবারে পারি।
কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি।।
না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।

বিদ্যাপতির কবিতা-
হইআ বান্দার বান্দা নুঙাইয়া শির।
বন্দিব বড় খা গাজী পীর দস্তগীর
একদিলে বন্দিব দরদস্তা পীর।
বড় খাঁ গাজী যেই করিল জাহির।।

কবি বল্লভের কবিতা-
শুনহ বেইমান রাজা বাত কহু তোরে।
রাখ্যাছ গোলাম মেরা কিসের খাতিরে।।
সাত হাজারের মার্তা লইয়াছে ভাড়া।
মহল ভিতরে নাচে সাতশত ন্যাড়া।

রাধাচরণ গোপের কবিতা-
ইলাহি কহেন জীবরিল কর আর কি।
আছামান জমীন ডুবাইছেন রসুলের ঝি
সিতাব করিয়া এখন দুনিয়াকে যাও।
বিবি ফাতেমাকে তুমি যাইঞা সমজাও।।

যদি পলাশীর প্রহসনে স্বাধীনতা না হারাতাম, তাহলে সেই সাধারণ গণভাষাকে অবলম্বন করে বির্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতো পরবর্তীকালের হিন্দু-মুসলমানের ভাষিক প্রগতি। পর্তুগিজ-ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক প্রকল্প বাংলার জনতার চিরায়ত মুখের ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা বানানোর যে জোর চেষ্টা চালায়, তাকেই কলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত রেনেসাঁ প্রমিত ভাষার সম্মান দেয়। আরবি-ফারসি প্রভাবকে খেদানোর সর্বাত্মক চেষ্টা হয়। বিদেশী সংস্কৃতের প্রভাব সর্বাত্মকভাবে চাপানোর কোনো কোশেশ বাদ রাখা হয় না। যদিও বাংলার প্রাথমিক উদগতি সংস্কৃতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফসল ছিল। সে বিদ্রোহ থেকেই প্রাকৃত ও বাংলা ভাষার জন্ম সম্ভব হয়। সংস্কৃতের পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার নামে একদা বাংলা ভাষা ও ভাষীদের ওপর সব ধরনের বৈষম্য, তিরস্কার, তাচ্ছিল্য ও বিতাড়নের কালো রাত চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল! বাংলা বা মানবভাষায় বৈদিক গ্রন্থ পাঠকারীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল রৌরব নরক! যদিও সংস্কৃতের শব্দ বাংলায় আসাটি সাধারণভাবে মন্দ নয়, কোনো ভাষার শব্দের ব্যাপারে এ রায় দেয়া অন্যায়।

কিন্তু সংস্কৃতের প্রাবল্যে বাংলাকে তলিয়ে দেয়ার চেষ্টাটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক। এর আশ্রয়ে বাংলার নববিন্যাসের চেষ্টা যতই হোক, আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষাকে ত্যাগ করেনি। বাংলাও পারেনি জন্মপরবর্তী শৈশব-কৈশোর থেকে চিরপরিচিত সেই শব্দদের ব্যাপকভাবে ত্যাগ করতে। সেই সব শব্দের একটি হচ্ছে দাওয়াত! বাংলা কাব্যে, গানে, কথাশিল্পে আর জনজীবনের অন্তরতলে এর ব্যবহার, প্রভাব ও ভ‚মিকা গভীর ও আত্মজ; চিরচেনা বাগিচার বুলবুলির মতো। ঔপনিবেশপূর্ব হিন্দু সমাজেও অন্যান্য পরিচিত আরবি-ফারসি শব্দের মতো দাওয়াত শব্দটিও ব্যবহৃত হতো দেদার। অনির্বাণ বন্দোপাধ্যায় ‘বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় ধর্ম-সঙ্কট’-এ ঠিকই লিখেছেন- ফারসি ভাষা এতটা আত্মীকরণ করে নিয়েছিল সাধারণ মানুষ যে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষরাও ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করে গ্রন্থ পাঠ করত। শুধু ভাষা ক্ষেত্রেই নয়, মুসলিম শাসনকালে হিন্দু জীবনে পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, নিত্য আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। যেমন মুসলিম সমাজের বোরখা বা পর্দারীতিতে হিন্দুসমাজে ঘোমটা রীতির প্রচলন হয়েছিল। ঘোমটার দৈর্ঘ্য এতটাই ছিল যে, মহিলাদের মুখ দেখাই যেত না। দীর্ঘ ঘোমটা মহিলাদের বলা হতো ‘কলাবউ’। মোগল যুগে ফারসি ভাষা চর্চা প্রসঙ্গে ড. মোহম্মদ এনামুল হক তার ‘মুসলিম বাঙ্গালা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘শাহি ফরমানা ফারসি, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে ফারসি, রাজস্ব বিভাগে ফারসি, শিক্ষা-দীক্ষা ও আলাপ-আলোচনায় ফারসি দেদার চলিতে লাগিল। বিদ্যাবত্তা, চাকরি-বাকরি, এমনকি সভ্যতা-ভব্যতার মাপকাঠিও অচিরেই ফারসি হইয়া উঠিল।’ ফলে পানি ও দাওয়াতের মতো শব্দ নিয়ে এখনকার প্রতিক্রিয়া ঐতিহাসিক সেই সহাবস্থানের বিপরীত ও ঔপনিবেশিক বিভাজনের ফসল। এই সেদিনও বাঙালি হিন্দুরা ছাত্রবৃত্তি, স্কলারশিপ, জলযোগের পয়সা বুঝাতেন ‘জলপানি’ কথাটি দিয়ে। সেটি এখন ‘স্কলারশিপ’ হয়েছে! কিন্তু স্কলারশিপ কি দেশী শব্দ?

জল শব্দটি লক্ষ করা যাক। সংস্কৃত ‘জলম্’ থেকে শব্দটি এসেছে, সোজাসুজি। চর্যাপদে এর ব্যবহারের নিদর্শন মেলে না। বাংলা ভাষায় তৎসম জলের চেয়ে প্রাকৃত ভাষা থেকে আগত পানির ব্যবহার অধিকতর প্রাচীন। যখন থেকে বাংলার লিখিত অবয়ব মিলছে, তখন থেকেই পানির ব্যবহার প্রমাণিত। তারপরও যেহেতু শব্দটি মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ ও মুসলিম জনগোষ্ঠী অধিক মাত্রায় ব্যবহার করে, ফলে শব্দটিকে বানানো হলো সাম্প্রদায়িক, অনুপ্রবেশকারী, অপরের ভাষা!

যদিও ভারতের বহু অঞ্চলে জল বোঝাতে পানি ব্যবহৃত হয় এবং বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী পানি ব্যবহার করতে গিয়ে জলকে অবজ্ঞা করে না। তার দরকার যেমন পানাহার, তেমনি জলতরঙ্গ।

এ বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না বলেই কলকাতায় সেদিনের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘কতগুলো শব্দ রয়েছে, যেগুলো সারা বিশ্বের। যেমন- একটি শব্দ রয়েছে ‘জল’ বা ‘ওয়াটার’। কিন্তু ওয়াটারকে কেউ কেউ ‘পানি’ বলে। এটি আপনাকে মেনে নিতে হবে।’

মমতা আরো বলেন, ‘ওরা অতিথিসেবাকে দাওয়াত বলে। এটি বাংলাদেশের ভাষা। যারা ওপার থেকে এ দেশে এসেছেন, তারা এই ভাষাটিকে গ্রহণ করেছেন। আমি মাতৃভাষাকে চেঞ্জ (বদল) করতে পারি না। যেটি শিখে এসেছে, সেটি চেঞ্জ করবে কীভাবে।’

মমতার বক্তব্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশিত। তিনিও মেনে নিয়েছেন তারা আর আমরা পার্থক্যকে। কিন্তু শুভাপ্রসন্ন এই ‘তারা’র মুখের শব্দকে উচ্ছেদ করতে চান। তবে মমতা চান ‘তারা’ তাদের মতো বলুক।
কিন্তু দিন শেষে মমতার এই অবস্থানও আক্রান্ত হচ্ছে সেখানে। তিনিও নিন্দায় বিদ্ধ হচ্ছেন তীব্রভাবে। শব্দের সাম্প্রদায়িক পরিচয় জোরালো হচ্ছে নতুন মাত্রায়। এ ভিত্তিতে চলছে মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার তোড়জোড়!

লেখক : কবি, গবেষক
71alhafij@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *