সংস্কৃতি কি? প্রশ্নটি নিতান্ত সহজ। জবাবটি কি সহজ! না। জবাবটি খুব সহজ নয়। কারণ আমাদের সমাজ সংস্কৃতি বলতে সামান্য বিনোদনকেই বোঝে! গান-গজল আর অভিনয়কে বোঝে। বাস্তবে তাই কি! না বাস্তবে তা নয়। তবে বাস্তবে কি! সে কথাই বলি খল্লুমখোলা করে-
সংস্কৃতি হলো বিশ্বাসের প্রকাশ্য রূপ। সংস্কৃতি জীবন যাপনের পরিশীলিত পদ্ধতি। জীবনের প্রতিটি কাজ সম্পাদন করার নিয়ম। সংস্কৃতি হলো- রুচির প্রকাশ। প্রতিটি কাজের নান্দনিক রূপটিই সংস্কৃতি! প্রতিটি কাজে নৈতিক চেতনাই সংস্কৃতি! প্রতিটি বিষয়ে সুস্থ ধারাটিই সংস্কৃতি!
একজন ব্যক্তি কেমন করে জীবন যাপন করবেন! কেমন করে কথা বলবেন! কেমন করে আচরণ করবেন। কেমন করে পোশাক পরবেন। কেমন করে ঘুমাবেন। ঘুম থেকে উঠবেন। খাবেন। চলবেন। পয়-পরিস্কার থাকবেন – এসবই সংস্কৃতি।
কেমন হবে প্রার্থনার পদ্ধতি। মহান রবের প্রতি বিশ্বাসের ধরণ কেমন হবে! এটিও সংস্কৃতির ঘেরাটোপে আবদ্ধ। এক বাক্যে বলতে হলে বলবো- একজন মানুষের জীবনের সকল আয়োজনের সকল কাজের পদ্ধতি এবং নিয়মই সংস্কৃতি! কিংবা সকল কাজের ধরণই সংস্কৃতি!
খুব কি জটিল মনে হয়! না জটিল নয়! এটিই সরল। এটিই সহজ! এটিই সত্যি। এটিই বাস্তবতা। এটিই মূল! হয়তো আপনি প্রশ্ন করবেন- এতোদিন সংস্কৃতি বলতে বুঝলাম গান আবৃত্তি নাটক অভিনয় চলচ্চিত্র এবং বিনোদনকে। আপনি কিনা বলছেন- জীবনের সবকিছুই সংস্কৃতির শেকলে বন্দী। সবকিছুই সংস্কৃতির অঙ্গ!
জি হাঁ ঠিকটিই ধরেছেন। জীবনের ছোট থেকে বড় সবকিছু সংস্কৃতির অন্তর্গত। ডান বাম সামনের পেছনের সবই সংস্কৃতির সীমানাভূক্ত। কোনোকিছুই সংস্কৃতির রাজত্বের বাইরে নেই। কোনো কিছুই নেই সংস্কৃতির শাসন মুক্ত।
সংস্কৃতি থেকে সরে থাকার কোনো পথ নেই। যেটুকু সরে যায়, সেটুকুই অসুন্দর! যেটুকু দূরে থাকে সেটুকুই অনিয়ম! সুতরাং নিয়মের অধীন হওয়াই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি থেকে মুক্ত থাকার উপায় থাকে না। থাকবে না। থাকার উপায়ও নেই। কেমন করে থাকবে! কেননা সকল দিকের সকল কিছুর প্রকাশ সংস্কৃতির রঙ নিয়েই হয়।
সুতরাং এটি বুঝতে অসুবিধা নেই- সংস্কৃতি শুধু বিনোদনকেই বোঝায় না। বরং বিনোদনেরও সংস্কৃতি আছে। কি চোখ কপালে উঠলো বুঝি! উঠলে ওঠুক। তবু্ও বুঝতে হবে সংস্কৃতির পরিধি। সংস্কৃতির রূপটি আমাদের কাছে পরিস্কার নিশ্চয়। যদি জীবন যাপনের পদ্ধতিই হয় সংস্কৃতি এবং যদি জীবনকে গুছিয়ে নেবার নিয়মই হয় সংস্কৃতি! তবে বিনোদন তো জীবনেরই অংশ! তো বিনোদনের উপকরণও সংস্কৃতি। এবং বিনোদনের পদ্ধতিও সংস্কৃতিরই অংশ।
এখানে বলতেই পারেন, আরে এতো আজব কথা! এমন কথাতো আর শুনিনি! তাহলে গানেরও সংস্কৃতি আছে! নাটকেরও ! অভিনয়ের সংস্কৃতিও মানতে হবে! নিশ্চয় মানতে হবে! হ্যা শুনতে বিস্ময়েরই বটে। কিন্তু সত্যি এটিই। বিস্ময়টি কেটে গেলেই বুঝবেন সংস্কৃতি কেনো জীবনের সমস্ত সীমানাজুড়ে জাগ্রত!
যদি আমরা সংস্কৃতির বিশাল পরিধির দিকে তাকাই দেখবো- আস্ত জীবনই সংস্কৃতির রসে মজে আছে। যেহেতু আমরা জেনেছি- কাজের পদ্ধতিই সংস্কৃতি! এবং সেই কাজের পেছনে বিশ্বাসই সংস্কৃতি! খুব কি কঠিন করে বললাম। ঠিক আছে আরও সহজ করেই বলি। ধরুন একটি গান গাওয়া হলো। গানটি নিজে বিনোদন। কিন্তু গাওয়া হলো কী ধরনের সেটি বেছে নেয়াটা হলো সংস্কৃতি! গানটি কি জীবনের জন্য সুন্দর! সুস্থ। নাকি ধুমধাড়াক্কা! ঝাকানাকা হবে! গানটি কি চরিত্র সুন্দর করবে। নাকি নষ্ট করবে। জীবন গড়ার কাজ করবে নাকি জীবন ভাঙার কাজ করবে। জীবনে আশা জাগাবে নাকি হতাশ করে তুলবে।
দেশের গান যদি হয়,সেকি দেশকে ভালোবাসতে শেখাবে নাকি ঘৃণা শেখাবে। দেশ গড়ার কাজ করবে, নাকি দেশ বিক্রির চোট্রামি জাগাবে! ভাবতে হবে এ-সব। হামদ কিংবা না’ত এর কথা ধরা যাক। এখানেও বাছাই পদ্ধতি আছে। হামদ হলে সেটি শেরক মুক্ত কিনা! ঈমান ধ্বংসের কিছু আছে কিনা। বিশ্বাস কোথাও দুর্বল হয়ে উঠবে কিনা! এমন জিজ্ঞাসাগুলোর সমাধান খুব জরুরি। এসব জিজ্ঞাসার সমাধানই সংস্কৃতি।
একটি আদর্শ জীবনই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের জন্য সংস্কৃতিবান হতে হয়! জীবনের প্রত্যেকটি বাঁকে সংস্কৃতির সৌন্দর্য উজ্জ্বল না হলে জীবনও উজ্জ্বল হয় না। হবে না। এখন প্রশ্ন হলো- জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে উত্তম সংস্কৃতির রঙ মাখতে হলে এমন একজন মানুষ দরকার যাকে সন্দেহাতীত অনুকরণ অনুসরণ করা যায়।
এখানেও প্রশ্ন দাড়িয়ে যায়- এমন ব্যক্তিত্ব কি একজনও আছে পৃথিবীতে! যাকে জীবনের খুটিনাটি সকল বিষয়ে অনুসরণ করা চলে! সব বিষয়ে দ্বিধাহীন মান্য করা চলে! এর জবাবে বলতে হবে- আছে আছে! নিশ্চয় এবং নিশ্চিত আছে! একজনই আছেন। শুধুমাত্র একজন।
কে তিনি? তিনি রাহমানের হাবীব। তিনি জগতের সর্বোত্তম সৃষ্টি! তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ স.। তাঁর জীবনের অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বড় প্রতিটি কাজ বিস্ময়কর নান্দনিক! জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সুন্দরের অসাধারণ উপমা। তাঁর কথা এবং কাজের মিলমিশ এতই উঁচু সুন্দর যা আর কোনো মানুষের জীবনে নেই। তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজ পরিশীলিত! প্রতিটি কাজ রুচিসম্মত! প্রতিটি কাজ মানবিক। প্রতিটি কাজই মনুষ্যত্বের নিখাঁদ শিল্পে উত্তীর্ণ।
জীবনের সকল দিক সুন্দরের অসাধারণ বৈশিষ্টে সম্পাদন করেছেন তিনি। তাই তাঁর উপমা কেবলই তিনি। এখানে একটি দাবী উত্থাপিত হতেই পারে। দাবীটি হলো- সেই মহা মানবের সংস্কৃতির উদাহরণ চাই। একদম যুক্তিসঙ্গত দাবী। উদাহরণ তো লাগবেই। দিতেই হবে। মজার বিষয় হলো তাঁর গোটা জীবনের সকল কাজই তো উদাহরণ! সকল কাজই উপমা। ঘুম ভেঙে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সারাদিনের প্রতিটি কাজের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর সংস্কৃতি! তবুও গভীর দৃষ্টিতে বোঝার জন্য সহজ উদাহরণ উল্লেখ করবো।
ঘুমের বিষয়টিই ধরি। কেমন ছিলো রাসুল স. এর ঘুমের সংস্কৃতি? সেকথাই বলছি! তিনি ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিতেন। শুরুতে অজু করতেন। সুন্দর করে চুল আঁচড়াতেন। চোখে কালো সুরমা দিতেন। ঘুমের পোশাক পরিধান করতেন। বিছানাটি ঝাড়ু দিয়ে নিতেন। পরিস্কার বিছানায় শুয়ে পড়তেন। শুতেন মহান আল্লাহর নামে। ডান কাত হয়ে। ডান হাতের তালুতে মাথা রাখতেন। তারপর কোরআনের কিছু সুরা, আয়াত তেলাওয়াত করতেন। আয়াতুল কুরসি পড়তেন। পড়তেন আরও আরও কিছু দোয়া। এভাবে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন তিনি।
আহা কি প্রশান্ত আত্মার অধিকারী একজন মানুষ! কী নিশ্চিন্ত জীবনের একজন। কী সুখী তিনি। জগতের সকল ভার মহান রবের ওপর ন্যাস্ত করে ঘুমিয়ে পড়তেন তিনি। তাঁর ঘুম ছিলো দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম ওষুধ। ঘুমিয়ে সতেজ হয়ে উঠে যেতেন গভীর রজনীতে।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতেও দোয়া পড়তেন। উঠেও পড়তেন। মেসওয়াক করতেন। উত্তমভাবে অজু করতেন। অজুর পরও দোয়া করতেন। তারপর পরতেন উত্তম পোশাক। খুশবু লাগাতেন। তারপর দাঁড়িয়ে যেতেন মহান রবের সম্মুখে। রাতের নামাজ আদায় করতেন। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতো সে নামাজ। রুকুতে থাকতেন অনেক সময়। তারপর একটি পরিতৃপ্ত আত্মা নুয়ে পড়তো সেজদায়। আহা সেজদা কত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতো। কী সুন্দর ছিলো সেই সেজদা! কী নিবেদন ছিলো সেজদায়। কলিজা উপুড় করে নিজেকে সোপর্দ করতেন তিনি। বিশ্ব জগতের সবার একসাথে সেজদার চেয়ে দামী সেই সেজদা!
এইতো তাঁর ঘুম ও রাতের সংস্কৃতি! এভাবে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আছে তাঁর সংস্কৃতির স্বচ্ছ রূপ। রাসুল স. এর সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ দিক হলো- একজন বিশ্বাসীর চিন্তা, কথা ও কাজকে এক রেখায় দাড় করিয়ে দেয়া। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি যা চিন্তা করবেন তা-ই বলবেন। যা বলবেন- তা-ই করবেন। এইযে চিন্তা কথা এবং কাজের সমন্বিত রূপ এটিই রাসুল স এর সংস্কৃতির সর্বোত্তম উপমা।
তাঁর চিন্তা ছিলো স্বচ্ছ এবং স্বচ্ছল। উদাত্ত এবং উদার। নিকটের এবং দূরের। আজকের এবং ভবিষ্যতের। একজন এবং সকলের।
তাঁর কথাও তেমনই। তাঁর কথার মতো কথা হয়নি জগতে। হবেও না আর। যেমন কথা কাজও তেমনই। কথার বরখেলাপ একটিও নেই তাঁর গোটা জীবনে। কথার বিপরীত কাজও নেই একটিও। এটিই তো তাঁর সংস্কৃতি।
তাঁর প্রতিটি কাজ পরিশীলিত।। মানবিক। এবং মানুষের সহজাত। বাস্তবতার সাথে আন্তরিক প্রতিটি কাজ। একদমই আরোপিত নয় কোনো কাজ। রাসুল স. এর সংস্কৃতি মানুষের সামগ্রিক জীবনের সৌন্দর্যের একমাত্র উদাহরণ! যা মান্য করা যায় সন্দেহাতীত। মান্য করতেও হয় দ্বিধাহীন।
সত্যি এটিই- তাঁর সংস্কৃতি উন্নত মানুষের সংস্কৃতি! তাঁর সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি! তাঁর সংস্কৃতি জগতের সর্বোত্তম সংস্কৃতি!
দুনিয়ায় কোনো মানুষ পরিশীলিত সুন্দর হতে হলে তাঁকেই একমাত্র আদর্শ জ্ঞান করতে হবে। তাঁকেই গ্রহণ করতে হবে জীবনের সামগ্রিকতায়। সুতরাং জগতে তিনিই সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁর সংস্কৃতিই দুনিয়ার সর্বোত্তম সংস্কৃতি!
* জাকির আবু জাফর কবি, গীতিকার ও আবৃত্তিকার। সাহিত্য সম্পাদক দৈনিক নয়াদিগন্ত।