সাঈদ চৌধুরী
তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। ছিলেন সফল অধ্যক্ষ। সিলেটের শিক্ষা বিস্তারের স্বপ্ন পূরণই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। অত্যন্ত সুনামখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, পাঠানটুলা গড়ে তোলার সংগ্রামে তাকে কাছে থেকে দেখেছি। আধুনিক শিক্ষার সিলেবাস ও কর্মপদ্ধতির আলোচনায় ঘন্টার পর ঘন্টা একসাথে কাটিয়েছি। দিনরাত তিনি ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে। এক যুগের অধিককাল সেখানে প্রাণপাত করেছেন। ছোট্ট চারাগাছ থেকে জামেয়া আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
১৯৯৭ সালে সিলেটে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহন করি। আমার শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি অবহিত হয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন শহরের জিন্দাবাজার কাজী ম্যানশনের সত্তাধিকারী ও এপেক্স বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কাজী এনাম উদ্দিন আহমদ। তিনি তার বন্ধু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কয়সর জাহান সহ আরো কয়েকজনকে সাথে রাখার অনুরোধ করেন। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের আরো ক‘জন বন্ধু ও বিশিষ্টজন সম্পৃক্ত হন। প্রতিষ্ঠিত হয় বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস)।
বিবিআইএস রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হাফিজ মাওলানা ক্বারী আব্দুল হালিম কতভাবে আমাকে পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করেছেন। আদর্শ মানুষ গড়ার এই কারিগর খুবই পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। মানুষের সন্তানদের কথা ভাবতেন। ছাত্ররাই তার পুত্রবৎ ছিল। তাদের আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষায় গড়ে তোলার জন্য ছিলেন পাগলপ্রায়। ছাত্রদের তিনি প্রাণাধিক ভালবাসতেন। ছাত্ররাও তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ইসলামী শিক্ষা বিপ্লবের মহানায়ক হিসেবে।
বহুমুখী প্রতিভায় অনন্য মাওলানা আব্দুল হালিম গড়ে তুলেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শাহপরান জামেয়া ইসলামিয়া পীর মহল্লা প্রতিষ্ঠা করেছেন। রশীদিয়া দাখিল মাদরাসা টুকেরবাজার, কৈলাশ শাহনুর দাখিল মাদরাসা গোলাপগঞ্জ সহ বিভিন্ন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরো বহু প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য লোকজন তার পরামর্শ ও সহায়তা নিয়েছেন। এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সিলেট অঞ্চলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসলামী শিক্ষার আলো। তাই সকলের কাছে ‘শিক্ষাবন্ধু’ হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
মাওলানা আব্দুল হালিম খতীব হিসেবেও ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। জালালাবাদ আবাসিক এলাকা মসজিদের ইমাম ছিলেন দীর্ঘদিন। তারপর শেখঘাট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব ছিলেন। সিলেট তাহফীযুল কুরআন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ওলামা মাশায়েখ পরিষদ সিলেটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত সুনামের সাথে। সৎ, ধৈর্যশীল ও কর্মীবান্ধব সভাপতি হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য ছিলেন। তার পুরো জীবন ইসলামের ঐক্য এবং একমাত্র আল্লাহর দ্বীনের জন্যই খরচ করেছেন।
অত্যন্ত দরদ ভরা মন নিয়ে আবেগপূর্ণ ভাষায় তিনি বয়ান উপস্থাপন করতেন। আত্মশুদ্ধির নিবীড় মেহনতের কথা বলতেন। যে আলোচনায় মানুষকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। তাদের জীবনে ঘটে আমূল পরিবর্তন। সঞ্চার হয় রুহানী ও জেসমানী শক্তি।
মাওলানা আব্দুল হালিম অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তির সাথে পরিচিত ছিলেন। তাদের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহায়তা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এ সবের উন্নতির জন্য যেরূপ নিষ্ঠা ও পরিশ্রম প্রদর্শন করেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। ইসলামী সমাজ নির্মানের সকল প্রকার কর্মকান্ডে নেপথ্য শক্তি ও বিচক্ষণ পরামর্শক ছিলেন। মাদরাসা এবং তালিবুলইলমদের খেদমতেই বিসর্জন দিয়েছেন তার সমস্ত উপার্জন।
নম্র, শান্ত ও অসীম ধৈর্যের অধিকারী মাওলানা আব্দুল হালিম সব কাজ করেছেন বেশ নিপুণতার সঙ্গে। ব্যক্তিগত জীবনে মুখলিস এবং সর্বদা প্রফুল্লিত ছিলেন। জীবন যাত্রায় সারল্য অতি সহজেই চোখে পড়তো। তার মতো একজন দূরদর্শী ও সময়সচেতন আলেম সহজে মেলা ভার। কর্মে নিষ্ঠা, আচার ব্যবহারে মাধুর্য, জীবন যাত্রায় সরলতা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আদর্শ থেকে কখনই তিনি বিচ্যুত হননি।
বুধবার (১২ এপ্রিল ২০২৩) রাত ১১টায় সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিক্ষাবন্ধু মাওলানা আব্দুল হালিম ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি স্ত্রী, ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখেগেছেন।
গোলাপগঞ্জের কৃতি সন্তান প্রজ্ঞাবান এই আলেম ও সংগঠকের ইন্তেকালে পরিচিত মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মহান আল্লাহর কাছে তার রুহের মাগফিরাত প্রার্থনা করছি। তিনি যেন তার বান্দাকে জান্নাতের উচ্চ আসন দান করেন।
বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে মরহুমের প্রথম জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন শায়খুল হাদিস মাওলানা ইসহাক আল মাদানী। এরপর বাদ আসর গোলাপগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভাদেশ্বর কৈলাশ আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ২য় জানাযা হয়। সেখানে ইমামতি করেন মরহুমের বড় ছেলে মাওলানা সাদিক মোহাম্মদ ইয়াকুব আযহারী। সিলেটের শীর্ষস্থানীয় আলেম উলামাসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ধর্মপ্রাণ মানুষ জানাযায় অংশ গ্রহন করেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে জানাযার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট রাজনীতিক অধ্যাপক ফজলুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, মাওলানা হাবিবুর রহমান, অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম মাদানী, ক্বারী মাওলানা মতিউর রহমান, পীর মাওলানা আব্দুল জব্বার, শেখঘাট জামে মসজিদের মোতওয়াল্লী শফিক মিয়া প্রমূখ।
বিভিন্ন মহলের শোক: সিলেটের প্রবীণ আলেমে দ্বীন হাফিজ মাওলানা আব্দুল হালিমের ইন্তেকালে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। মরহুমের মাগফেরাত কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তারা।
যৌথ বিবৃতিরত শোক জানিয়েছেন, আনজুমানে খেদমতে কুরআন সিলেটের সভাপতি প্রফেসর মাওলানা সৈয়দ ইকরামুল হক ও সেক্রেটারী হাফিজ মাওলানা মিফতাহুদ্দীন আহমদ, তাহফীজুল কুরআন শিক্ষাবোর্ড সিলেটের সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম আল মাদানী, ওলামা মাশায়েখ পরিষদ সিলেটের সাবেক সভাপতি মাওলানা ইসহাক আল মাদানী ও সেক্রেটারী ড. মাওলানা এ এইচ এম সোলায়মান, জালালাবাদ ইমাম ফাউন্ডেশন সিলেটের সভাপতি ক্বারী মাওলানা মতিউর রহমান ও সেক্রেটারী হাফিজ মাওলানা মাহবুবুর রহমান জালালাবাদী, ইত্তেহাদুল কুররা সিলেটের সভাপতি মুফতী আলী হায়দার ও সেক্রেটারী ক্বারী মাওলানা আলা উদ্দিন, বাংলাদেশ মসজিদ মিশন সিলেটের সভাপতি মাওলানা অলিউর রহমান সিরাজী, হাজী কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব শায়খ সাঈদ নুরুজ্জামান আল মাদানী।
নেতৃবৃন্দ বলেন, অধ্যক্ষ হাফিজ মাওলানা আব্দুল হালিম আমৃত্যু কুরআনের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটবাসী একজন দ্বীনের দায়ি ও অভিভাবকতুল্য আলেমকে হারালো। যা সহজে পূরণ হবার নয়। আল্লাহ পাক মরহুম মাওলানা আব্দুল হালিমকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন ও পরিবারবর্গকে এই শোক সইবার শক্তি দিন। আমীন।