চলে গেলেন প্রজ্ঞাবান সাধক আল্লামা মুহিবুল হক

সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

আল্লামা মুহিবুল হক ছিলেন অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানের ও আমলের গভীরতা অপরিমেয়। এমন জ্ঞানবিদগ্ধ ইসলামী ব্যক্তিত্বের উচ্চতা পরিমাপ করা সহজ নয়। তাঁর বিদায়ে সিলেট তথা বাংলাদেশের ইসলামী ময়দানে বিরাট শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

১৭ মে বুধবার সন্ধ্যায় সিলেটের দরগাহ মাদ্রাসায় (জামিয়া কাসিমুল উলুম দরগাহে হজরত শাহজালাল রহ.) কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় সাড়ে ৭টায় হাসপাতালেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়াইন্না-ইলাহি রা-জিউ’ন।

আল্লামা মুহিবুল হক ছিলেন বড় মাপের তাত্ত্বিক ও আলেমে রব্বানী। ইলমের ময়দানে জীবনব্যাপী নিমগ্ন ছিলেন। জ্ঞান সাধনার মধ্যদিয়ে সিলেটের দরগাহ মাদ্রাসায় অর্ধশত বছর শিক্ষকতা করেছেন। মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হিসেবে এই সময়ে হাজারো আলেম গড়ে তুলেছেন। এছাড়া দেশ-বিদেশে বহু আধুনিক শিক্ষিত মানুষের রূহানী শিক্ষক ছিলেন। উন্নত চিন্তা ও মনন সৃষ্টিতে বরেণ্য নাবিকের ভূমিকা পালন করেছেন।

আল্লামা মুহিবুল হক সম্মিলিত কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আল হাইয়াতুল উলয়ার নির্বাহী সদস্য এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য হিসেবে বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন। তিনি আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশের (শিক্ষাবোর্ড) সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অত্যন্ত কঠিন সময়ে আল্লামা মুহিবুল হক সিলেট জেলার সভাপতি হিসেবে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি খাদিমুল কুরআন পরিষদের সভাপতি, সিলেট জেলা উলামা কমিটির চেয়ারম্যান, সিলেট জেলা ফতোয়া বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

গাছবাড়ী হুজুর নামে পরিচিত আল্লামা মুহিবুল হক সালফে সালেহিনের মতামত অগ্রাধিকার দিয়ে সকল বিষয়ের আলোচনা ও অভিমত ব্যক্ত করতেন। মাদ্রাসা অঙ্গনে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছেন। রাজনীতিতে আলেমদের শাণিত করতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

ইখতেলাফ তথা মতভেদ ও মতপার্থক্যের বিরোধ মিমাংসায় উদারতার নীতি অবলম্বন করেছেন। জীবনে সব সময় সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে দৃঢ় ছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সঠিক সিদ্ধান্তটি যথা সময়ে নিতেন।

প্রখর মেধাশক্তি সম্পন্ন নিরলস জ্ঞানতাপস আল্লামা মুহিবুল হকের সাথে যখনই কথা বলার সুযোগ হয়েছে. অনেক কিছু অর্জন করেছি। তার মজলিশ থেকে মাঝখানে চলে যাওয়া সম্ভব হয়নি কখনো। বর্ণনা শেষ হলেই কেবল বিদায় নিয়েছি। একান্ত আলোচনায় ইজতিহাদ ও যুক্তির প্রাচুর্য যুগপৎভাবে ফুটে উঠেছে।

একবার ‘ফিতনা‘ বিষয়ে গভীর আলোচনা হয়েছিল। বড় সহজ করে বলেছিলেন, শেষ যুগটা ফিতনার যুগ। এটা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যৎবাণী। আমরা শেষ যুগেই দিনাতিপাত করছি।

আলেমদের মধ্যে ফিতনার ব্যাপকতা উল্লেখ করে বলেছিলেন, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং অহংকারে অনেকে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছে। প্রজ্ঞা ও আখেরাতের জবাবদিহিতার বোধ জাগ্রত না হলে এই গোলক ধাঁধা থেকে বাঁচা সম্ভব নয়।

জোর জবরদস্তি এবং ভয় ভীতি বা শাসন করে নয়, প্রজ্ঞা দিয়ে বাস্তব জীবনে জটিলতা বা সংঘাত এড়ানো সম্ভব বলেই তিনি মনে করতেন।

১৯৪৫ সালের ৬ ডিসেম্বর সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের ফখরোচটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আল্লামা মুহিবুল হক। খ্যাতিমান আলেম আল্লামা ইসহাক রহ.এর সুযোগ্য সন্তান তিনি।

শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই আল্লামা মুহিবুল হক মেধা তালিকায় ছিলেন। মাযাহিরুল উলূম আকুনি মাদ্রাসা, জামেয়া দারুল উলূম কানাইঘাট এবং জামেয়া হুসাইনিয়া আরাবিয়া রানাপিং মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিসে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

হজরত নবী করিম (সা.) এর আচরিত জীবন প্রণালি আল্লামা মুহিবুল হকের মধ্যে ভাস্বর হয়ে আছে। আমাদের মাঝে এই বিজ্ঞ আলেমের প্রজ্ঞাদীপ্ত গভীর চেতনার উন্মেষ ঘটুক- এই কামনা করি।

মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *