চলে গেলেন তরুণ স্বপ্নচারী রুহুল হুদা মুবিন

আমেরিকা সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

আমেরিকার মিশিগান ওয়ারেন সিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ রুহুল হুদা মুবিন। শিক্ষা জীবনে দীর্ঘদিন লন্ডন ছিলেন। তখন আমাদের সংবাদ সংস্থা মিডিয়া মহলের টিম মেম্বার হিসেবে নির্ভরতার প্রতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

দূরদৃষ্টি, গতিশীলতা আর সাহসের সমন্বয়ে মুবিন আপন সুষমায় নিজকে সুশোভিত করেছিলেন। মিডিয়া মহলে কর্মকালীন সময়ে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও বিভিন্ন মিডিয়া হাউজে যথাসময়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার সক্ষমতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সংবাদ সংস্থা ‘মিডিয়া মহল’। লন্ডন মুসলিম সেন্টার (এলএমসি) বিজনেস উইংয়ে মিডিয়া মহলের অফিস ছিল। কমিউনিটি মিডিয়া সার্ভিস সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সেখান থেকে।

২০০৩ সালে আমার সম্পাদনায় মিডিয়া মহল থেকে প্রকাশিত হয় ব্রিটেনে বাংলাদেশী ব্যবসা বিষয়ক তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ গাইড ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’। ২০০৪ সালে আরো সমৃদ্ধ কলেবরে ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’ প্রকাশিত হয়।

২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের সকল এশিয়ান রেস্টুরেন্ট নিয়ে আমার সম্পাদিত ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি। এতে রেষ্টুরেন্টের নাম-ঠিকানার পোস্ট কোড এরিয়া ভিত্তিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। এশিয়ান ১৮ হাজার রেষ্টুরেন্টের মধ্যে সাড়ে নয় হাজার অর্থাৎ অর্ধেকের বেশী বাংলাদেশী মালিকানাধীন। ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানীদের সাথে বাংলাদেশী মালকানায় আরো কয়েশ ছিল। সবমিলে প্রায় দশহাজার রেস্টুরেন্ট আমাদের। ইতিপূর্বে এই তালিকা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ছিল। সঠিক হিসেব না থাকায় কমিউনিটি নেতারা অনুমান নির্ভর তথ্য দিতেন। ‘ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি’র মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রমাণ সম্ভব হয়েছে। ব্রিটেনের মূল ধারায় ডকুমেন্ট হিসেবে এখন তা প্রযোজ্য।

২০১০ সালে আমার সবচেয়ে ফ্লাগশিপ প্রকাশনা ছিল ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা-ওআইসি’র ৫৭টি দেশের তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ ডাইরেক্টরি ‘মুসলিম ইন্ডেক্স’। এই ইন্ডেক্স প্রকাশের ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের ২৯ এপ্রিল ওআইসি মহাসচিব প্রফেসর ড. একমেলেদ্দিন ইহসানগ্লর সাথে আমরা মতবিনিময় করেছি। এরপর ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আইডিবি’র কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় স্কলারদের সাথে মতবিনিময় করেছি। লন্ডনে বিভিন্ন দেশের এম্বাসি ও হাইকমিশন তাদের দেশের তথ্য সরবরাহে বিশেষ সহায়তা করেছে। আমাদের এই ডাইরেক্টরিসমূহ আজো বিলেতে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে এক অপরিহার্য অনুসঙ্গ।

নিজস্ব প্রকাশনা এবং টিভি ডকুমেন্টরি তৈরী ছাড়াও রেস্টুরেন্ট সমূহের অত্যাধুনিক মেনু এবং ওয়েবসাইট করে দেওয়ার মাধ্যমে কারি ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা নান্দনিকতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছি।

মিডিয়া মহলের প্রথম প্রকাশনা হিসেবে ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’তে সবচেয়ে বেশি শ্রম ও মেধা দিতে হয়েছে। এতে অনেকে কাজ করেছেন। তাদের সাথে প্রিন্টার্স লাইনে রুহুল হুদার নামও প্রকাশিত হয়েছে। শুধু আমার প্রতি নয়, মিডিয়া মহল ও আমাদের কাস্টমারদের প্রতি অনুপম ভালোবাসার জন্য তাকে একাধিকবার পুরস্কৃত করেছি।

দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস ও বিবিসি সহ মূলধারার গণমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে নিপুণতার সঙ্গে প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে তাকে হাতে কলমে ট্রেনিং দিয়েছি। মুবিন অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে সংবাদ সংস্থার কাজ হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন এবং টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

বিভিন্ন সময়ে আমরা কমিউনিটির মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বাসা জোগাড় করা, চাকরির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজে আমার সহায়ক শক্তি হিসেবে তার ওপর নির্ভর করেছি।

পড়ালেখা, চাকরি ও সমাজসেবায় দৃঢ়তা, অধ্যবসায় ও অঙ্গীকারের মাধ্যমে রুহুল হুদা মুবিন একজন স্বপ্নচারী তরুণ সংগঠক হিসেবে অন্যদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন।

ব্যক্তিগত ভাবে সাদাসিধে জীবনের অধিকারী অথচ বহুমাত্রিক গুণের সমাহারে চৌকস এই তুরণের মৃত্যুর খবরে চোখের জল আটকাতে পারছিনা। স্বচ্ছতা, বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার মাধ্যমে রুহুল হুদা মুবিন আমার অতিপ্রিয় এক মানুষে পরিনত হয়েছিল।

বিলেতে অধ্যয়ন শেষে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাবা-মার কাছে আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও বিভিন্ন সময় যোগাযোগ হয়েছে। মাঝখানে একবার আমাকে দেখতে এসেছিল। তখন তার ছোট ভাই আরেক মেধাবী চৌকস তরুণ শাহিনও সাথে ছিল।

তারও আগে মুুবিন আমার সাথে শিক্ষকতা করেছেন। সিলেটে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও চলমান বাস্তবতা নিয়ে একটি রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে আমি ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষায়তন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমার শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি অবহিত হয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন শহরের জিন্দাবাজার কাজী ম্যানশন মার্কেটের সত্ত্বাধিকারি ও এপেক্স বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কাজী এনাম উদ্দিন আহমদ। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কয়সর জাহান সহ আরো কয়েকজনকে সাথে রাখার অনুরোধ করেন। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের আরো ক’জন বন্ধুও সম্পৃক্ত হন। প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস)।

পরিচালনা পরিষদে আমি (সাঈদ চৌধুরী) রেক্টর ও নির্বাহী প্রধান, কাজী এনাম চেয়ারম্যান এবং কয়সর জাহান ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হই। অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন মিসবাহুল হক চৌধুরী, ডা. আব্দুল হক, মাওলানা আব্দুল হাই, মাওলানা আব্দুল কাদির খান, মো: আজম খান, আবু আহমদ সিদ্দিক খসরু, ডা. শাহরিয়ার হোসাইন চৌধুরী, ডা. এম এ মতিন, সৈয়দ শাহ কামাল, ফারুক আহমদ, মো: শফিক উদ্দিন, জায়েদুর রেজা চৌধুরী, মো: ফজলুর রহমান ও মো: আব্দুস শহীদ। আমরা শহরের হাউজিং এস্টেটে চার তলা বিশিষ্ট ৯৩-৯৪ নং বাসাটি নিয়ে যাত্রা শুরু করি।

এ লক্ষ্য অর্জনে অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলি বিশেষভাবে শিক্ষক ও পরিচালক মাওলানা আব্দুল হাই, শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া, শিক্ষক এনাম চৌধুরী, আমার ছোটভাই এডভোকেট রফিক চৌধুরী সহ একঝাক তরুণ শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। রুহুল হুদা মুবিন মেধাবী তরুণদের অন্যতম ছিলেন। প্রথম বছরেই (১৯৯৭) নার্সারী থেকে জিসিএসই (ও-লেভেল) পর্যন্ত ক্লাস চালু হয় এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলে জিসিএসই পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থিদের সাফল্য সবাইকে চমকে দেয়।

ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস) প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ হাইকমিশনার ডেভিড সি ওয়াকার সহ দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও কুটনীতিকগণ বিবিআইএস পরিদর্শন করেছেন। বিবিসির সাংবাদিক ফ্রান্সেস হরিসন, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জে আর রামানুপ, বাংলাদেশের প্রধান কবি ও কথা সাহিত্যিক আল মাহমুদ, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক ইনস্টিটিউট ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী, বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রেহমান, বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে হয়।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে জাতীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বিবিআইএস এর প্রতিযোগিরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে হারিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ৪র্থ এবং টিম হিসেবে ১৩তম স্থান দখল করে বিপুল প্রশংসা অর্জন করে। প্রতিযোগিতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৪তম এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ১৮তম হয়েছিল। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডাইরেক্টর ও রেক্টর হিসেবে আমার তত্ত্বাবধানে সুদক্ষ শিক্ষক মন্ডলীর প্রচেষ্টার ফলেই এই সাফল্য সম্ভব হয়েছিল। ব্রিটিশ হাই কমিশনার ডেভিড সি ওয়াকার ১৯৯৮ সালের ২৫ জুলাই বিবিআইএস পরিদর্শন করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিবিসি’র বিখ্যাত সাংবাদিক ফ্রান্সেস হ্যারিসন একই সালের ৫ আগস্ট আমার সাক্ষাৎকার সহ বিবিআইএস এর সামগ্রিক কার্যক্রমের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সাথে ছিলেন বিবিসির ঢাকা প্রতিনিধি আকারেজা গালিব, সিলেট প্রতিনিধি ও দৈনিক সিলেটের ডাকের নির্বাহী সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার। তখন মুবিন সেখানে খন্ডকালীণ শিক্ষক ছিলেন।

রুহুল হুদা মুবিন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। শহরের দরগা মহল্লায় বহুল আলোচিত পায়রা ৮৬ অধিবাসী অ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান ও বিশিষ্ট লেখিকা ডাক্তার মালেকা বেগমের প্রথম সন্তান। তাদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার দাওরাই গ্রামে।

ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিবেদিত বাবা-মার আদর্শ সন্তান রুহুল হুদা মুবিন ডেট্রয়েটের সেন্টার ফর দাওয়াহ এন্ড রিসার্চ-সিডিআর মসজিদের সভাপতি ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখান থেকে নিয়মিত অমুসলিমদের মধ্যে মহাগ্রন্থ আল কোরআন ফ্রি বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন দাওয়াতী ফ্ল্যায়ার, লিফলেট, গিফট বক্স ইত্যাদি ফ্রি বিতরণ করা হয়। মুবিন পারিবারিক ভাবে বাংলাদেশেও হাফিজি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর ২০২৩) আমেরিকার সময় সকাল ৯টায় রুহুল হুদা মুবিন চলে গেছেন মহান মাবুদের দরবারে (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না- ইলাইহি রা-জিউ’ন)। রেখে গেছেন বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, একমাত্র পুত্র ও অনেকগুণগ্রাহী।

মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *