চলে গেলেন ঐতিহ্য-সন্ধানী লেখক ও আইনজীবী সৈয়দ জয়নাল আবেদীন

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

‘মৌলভীবাজারের ইতিহাস ঐতিহ্য‘ গ্রন্থের লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী সৈয়দ জয়নাল আবেদীন চলে গেলেন মহান মাবুদের দরবারে। গত রোববার (২৩ এপ্রিল ২০২৩) সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে শহরের লাইফ লাইন কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ‘ন। ঐদিন বিকেল সাড়ে তিনটায় মৌলভীবাজার শাহ মোস্তফা রোডের টাউন ঈদগাহ মাঠে মরহুমের প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর নিজ গ্রাম কুইসার ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাযা শেষে ওলীয়ে কামেল হাফিজ মাওলানা আব্দুল কাদির চৌধুরী সিংকাপনীর (রঃ) কবরের পাশে দাফন করা হয়।

সৈয়দ জয়নাল আবেদীন আজীবন শিল্প-সাহিত্যের সাধনায় নিবেদিত ছিলেন। নিজ অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে অনেক পট পরিবর্তনের সাক্ষী ছিলেন। অন্তত পাঁচ দশকের অধিককাল নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। অনেক কিছুতে নিজেই সম্পৃক্ত ছিলেন। মৌলভীবাজারের ইতিহাস ঐতিহ্য গ্রন্থটি লেখকের সেই সব অভিজ্ঞতারই দলিল। একজন মননশীল লেখক ও গবেষক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। ধর্মীয় এবং ঐতিহ্য সমৃদ্ধ তার লেখা সমূহে তথ্যের বিপুলতা আর ভাষার সাবলীলতা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে।

সৈয়দ জয়নাল আবেদীন সাধারণ মানুষের কল্যাণে সক্রিয় হন ‍সেই ছেলে বেলা থেকে। বার্ধক্যজনিত অচলাবস্থায়ও অন্যের উপকারের জন্য তার চিন্তা-পেরেশানি ছিল সীমাহীন। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন সফল ও বরেণ্য। জনগন তথা ক্লায়েন্টের প্রতি সর্বদা সহায়ক ছিলেন। অন্য আইনজীবীদেরও সহায়ক হতে প্রলুদ্ধ করেছেন। পেশাজীবী হিসেবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার প্রয়াস চালিয়েছেন।

সৈয়দ জয়নাল আবেদীন একজন ভালো সংগঠক ও সুবক্তা ছিলেন। মৌলভীবাজারের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিকাশে সরব ছিলেন। মহকুমা থেকে মৌলভীবাজারকে জেলায় রুপান্তরের আন্দোলন করে সফল হয়েছেন। বৃহত্তর সিলেট গণদাবী পরিষদ এবং সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

সিলেট ও মৌলভীবাজারে বহুবার সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বৃহত্তর সিলেট তথা জালালাবাদের লোকজ ঐতিহ্যের কথা আলোচনা করতেন। সিলেটী লোক সাহিত্যের শ্রেষ্ট সংগ্রাহক চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্য ভূষণ সম্পর্কে বলতেন। সত্যসন্ধানী গবেষক ও সাবেক সচিব দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় ঋদ্য ছিলেন তিনি। সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রাণপুরুষ আল ইসলাহ সম্পাদক মরহুম মুহম্মদ নুরুল হকেরও স্নেহধন্য ছিলেন।

সিলেটী ইতিহাস-ঐতিহ্যের আজীবন অনুসন্ধিৎসু বিশিষ্ট গবেষক ও রম্যলেখক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও সৈয়দ জয়নাল আবেদীন বেশ শখ্য ছিলেন। একে অপরকে ‘ইতিহাসরত্ন‘ মনে করতেন। সিলেট প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সিলেটের সাংবাদিক সমাজের সত্যিকারের অভিভাবক বোরহান উদ্দিন খানের খুবই আপনজন হিসেবে ঘনিষ্ট ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় কলাম হিংটিংচট সংগ্রহ করে রেখেছেন দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

এই প্রবিণেরা জালালাবাদ অঞ্চলের ইতিহাস ও সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণা করে বিশাল ঐতিহাসিক কাজ করে গেছেন। ইতিহাসের বর্ণনায় তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের জটিল বিষয় বিশেষ নৈপুণ্যের সঙ্গে খুলে দিয়েছেন। পুরানো কাগজপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে অনুসন্ধান করেছেন, সিলেটের সাথে আসাম অঞ্চল এমনকি আরব জাহানের যোগসূত্রের সন্ধান, প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক কীর্তি, শিলালিপি ও নিদর্শনের বিবরণ, সিলেটি নাগরি ভাষা, মুসলমান সমাজের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান, লেখক-সাহিত্যিকদের পরিচিতি ইত্যাদি নির্মোহভাবে দলিল সহকারে তুলে ধরেছেন।

লন্ডনের বিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক-কলামিস্ট কেএম আবুতাহের চৌধুরী মৌলবীবাজার থেকে জানিয়েছেন, বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এডভোকেট সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের নামাজে জানাযা ও দাফন সুষ্টুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

গত ২৩ এপ্রিল রবিবার বিকাল সাড়ে তিনটায় সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয় মৌলভীজারের শাহ মোস্তফা রোডস্থ টাউন ঈদগাহ মাঠে। এতে ইমামতি করেন মরহুমের সন্তান সৈয়দ মুশফিক শাকেরীন। জানাযার নামাজের পূর্বে বক্তব্য রাখেন, মৌলভীবাজার ৩ আসনের এমপি নেছার আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাউর রহমান, বিশিষ্ট আইনজীবি ও লেখক মুজিবুর রহমান মুজিব, ইসলামী ফাউণ্ডেশনের উপ পরিচালক অধ্যক্ষ শাহ নজরুল ইসলাম, সাংবাদিক ডাঃ ছাদিক আহমদ, মরহুমের বড় ছেলে সৈয়দ ইশতিয়াক জাকেরীন, সাংবাদিক মকিছ মনসুর, দেওয়ান মুফতি আব্দুল্লাহ রাজা চৌধুরী ও মরহুমের ছোট ভাই সাংবাদিক কে এম আবুতাহের চৌধুরী।

বক্তারা মৌলভীবাজারের প্রথম নোটারী পাবলিক ও বিশিষ্ট আইনজীবি সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। বক্তারা বলেন, সৈয়দ জয়নাল আবেদীন ইতিহাস চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ, বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল সহ বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার খেদমত করেছেন। দাওয়াতে দ্বীনের কাজেও তিনি অবদান রেখেছেন। মৌলভীবাজার জেলা বাস্তবায়ন আন্দোলন, সিলেট বিভাগ আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠক হিসাবে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। নামাজে জানাযায় মৌলভীবাজারের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সহ সহস্রাধিক লোক উপস্থিত ছিলেন।

দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় মরহুমের নিজ গ্রাম কুইসার ঈদগাহ মাঠে। সেখানে ইমামতি করেন মরহুমের ছোট ভাই কেএম আবুতাহের চৌধুরী। জানাযার পূর্বে মরহুমের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পোষ্ট পত্রিকার অনারারী চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শেখ মোঃ মফিজুর রহমান, মাসিক শাহজালাল পত্রিকার সম্পাদক রুহুল ফারুক, ইন্জিনিয়ার সৈয়দ সাদ আলী, কুইসার মসজিদের ইমাম হাফেজ আলী আহমদ, সাবেক ইমাম মাওলানা আবু জাফর সাদিক খান, সাংবাদিক আজাদুর রহমান আজাদ ও মরহুমের বড় ছেলে সৈয়দ ইশতিয়াক জাকেরীন। পরে সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের লাশ পীর ও ওস্তাদ ওলীয়ে কামেল হাফিজ মাওলানা আব্দুল কাদির চৌধুরী সিংকাপনী (রঃ) এবং মাতা মিসেস তালেমুন্নেছা খানমের (রঃ) কবরের পাশে দাফন করা হয়।

এদিকে সৈয়দ জয়নাল আবেদীনের মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন, সাবেক এমপি সৈয়দা সায়রা মহসিন, বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ ও ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশীজের প্রেসিডেন্ট ড. হাসনাত এম হোসেইন এমবিই, বৃটেনের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এস’র ফাউণ্ডার মাহী ফেরদৌস জলিল, বিশিষ্ট সাংবাদিক মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান, বাংলা পোষ্ট পত্রিকার অনারারী চেয়ারম্যান শেখ মোঃ মফিজুর রহমান, সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাধারন সম্পাদক তাইছির মাহমুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক সময় সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী, বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ও কমিউনিটি নেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী, বিবিসিসি‘র প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রেনু জেপি ও ডাইরেক্টর আতাউর রহমান কুটি, গ্রেটার সিলেট কাউন্সিল ইউকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনছব আলী জেপি, সাবেক সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল ক্বাইউম কয়সর, সিলেট লেখক ফোরামের সভাপতি কবি নাজমুল ইসলাম মকবুল, সাধারন সম্পাদক এডভোকেট জিয়াউর রহিম শাহীন ও কোষাধক্ষ কাজী শফিকুল ইসলাম, ইউকে বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক মুনজের আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন ইউকের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযাদ্ধা এম এ মান্নান, সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযাদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা, সাধারন সম্পাদক খান জামাল নুরুল ইসলাম ও ট্রেজারার আফসার উদ্দিন, টাওয়ার কাউন্সিলের মিডিয়া অফিসার সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান, সাংবাদিক সৈয়দ রুহুল আমিন, প্রকাশক ও গ্রন্থকার বায়েজিদ মাহমুদ ফয়সল, রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস ইউকের সাধারন সম্পাদক কবি শিহাবুজ্জামান কামাল, লেখক ও গবেষক কবি শায়েখ তাজুল ইসলাম প্রমুখ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *