ফরাসি দার্শনিক মিশেল দে মন্টেনের একটি সুন্দর উক্তি পড়েছিলাম। তিনি একটি প্রবন্ধে লেখেন: “To compose our character is our duty, not to compose books, and to win, not battles and provinces, but order and tranquility in our conduct. Our great and glorious masterpiece is to live appropriately. All other things, ruling, hoarding, building, are only little appendages and props, at most.”
“চরিত্র গঠন করাই আমাদের আসল কর্তব্য, কেবল বই এবং পুস্তক রচনা করা নয়; কিংবা বিজয় অর্জন করা, যুদ্ধক্ষেত্রে বা দেশের পর দেশ জয় করে নয়, বরং আমাদের আচরণের লাগাম টেনে, শৃঙ্খলা ও শান্তি স্থাপন করা। আমাদের মহান ও গৌরবময় শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো যথাযথভাবে জীবনযাপন করা। অন্যান্য সমস্ত কিছু— শাসন করা, সঞ্চয় করা, নির্মাণ করা— কেবল ছোটখাটো উপাঙ্গ এবং অবলম্বন মাত্র।”
মানবজীবনের প্রকৃত সাফল্য ও মহত্ব কোথায় নিহিত, তা নিয়ে যুগে যুগে জ্ঞানী ও মহাপুরুষরা গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল দে মন্টেনের কথা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই অমর বাণী স্মরণ করা যেতে পারে:
“إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلَاقِ” অর্থাৎ, “আমি তো প্রেরিত হয়েছি চারিত্রিক গুনাবলির পূর্ণতা সাধনের জন্য।”
একবার, যখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবাদের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিলেন, তখন তিনি তাদের বলেছিলেন: “আমরা এখন একটি ছোট যুদ্ধ (জিহাদ-এ-আসগর) শেষ করে ফিরছি, তবে আরও বড় একটি যুদ্ধ (জিহাদ-এ-আকবর) আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে।” সাহাবারা অবাক হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো এখনই যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছেন, আর বলছেন আরও বড় একটি যুদ্ধের কথা?” তখন তিনি বললেন, “হ্যাঁ, এটি হল জিহাদ-এ-আকবর, যেটি হচ্ছে নিজের নফস (আত্মা) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যা সবচেয়ে কঠিন।” (হাদিস)
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এখানে বুঝিয়েছেন যে, বাহ্যিক যুদ্ধে অংশ নেওয়া (জিহাদ-এ-আসগর) অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হচ্ছে আত্মসংযম এবং নিজের খারাপ অভ্যাস, গর্ব, অহংকার, স্বার্থপরতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করা (জিহাদ-এ-আকবর)। এটি সত্যিকার অর্থে কঠিন যুদ্ধে পরিণত হয়, কারণ এতে মানুষের নিজের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা এবং নৈতিকভাবে উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় তাদের বাহ্যিক অর্জন, কর্মজীবন, প্রতিভা কিংবা শিল্পসৃষ্টির জন্য। এইসব বিষয় সহজেই মানুষের চোখে ধরা পড়ে এবং এজন্য তারা পুরস্কৃত হন, খ্যাতি পান, সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেন এবং অনেক সময় এটাকেই জীবনের সাফল্য বলে মনে করেন। অথচ প্রকৃত মহত্ব এবং সত্যিকারের গৌরব নিহিত থাকে নিজেকে একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলার মধ্যে।
মানুষের প্রকৃত বড় কাজ হলো নিজেকে ভেতর ও বাহিরে পরিশুদ্ধ করে এমন একজন ব্যক্তিতে পরিণত করা, যিনি নৈতিক গুণাবলি ও সুন্দর চরিত্রের অধিকারী এবং যিনি অন্যদের অনুভূতি ও প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল। একজন সৎ, বিনয়ী, এবং দয়ালু মানুষ যিনি নিজের আত্মিক উন্নতি এবং অন্যদের কল্যাণে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান—এটাই জীবনের প্রকৃত সফলতা। এর পুরস্কার রয়েছে এই পৃথিবীতে এবং অবশ্যই পরকালীন জীবনে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আরেকটি হাদিসে এসেছে:
“মুমিনের আমলনামায় কিয়ামতের দিন উত্তম চরিত্রের চেয়ে ভারী আর কিছুই থাকবে না।” (তিরমিজি)
কিন্তু চরিত্র গঠন একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর জন্য প্রয়োজন অবিচল প্রচেষ্টা, দৃঢ় সংকল্প এবং সর্বোপরি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাহায্য কামনা করা। কেননা, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমরা নিজেরাই নিজেদের চরিত্রকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হব না।
আমাদের উচিত প্রতিদিন নিজেদের আত্মসমালোচনা করা, নৈতিক গুণাবলির বিকাশে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, যেন তিনি আমাদের উত্তম চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং এই পথে অবিচল রাখেন। কারণ একমাত্র উত্তম চরিত্রই মানুষকে সত্যিকারের মহত্ব ও সফলতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারে।
* মুসতাক আহমদ ব্যারিস্টার অ্যাট ল, লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে কেবিনেট মেম্বার (জবস্, এন্টারপ্রাইজ, স্কিলস্ এন্ড গ্রোথ)