সেই কতো দিনকার কথা। একুশেই তোমার ভ্রু-পাতার ওপর
দৃষ্টি পড়েছিলো আমার।
একদিন আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো; মেয়েটি
কেমন, খোকা?
‘মন্দ নয়।’
আমি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে পারিনি
সেদিন।
‘ওকে আমাদের ঘরে তুলে আনলে মন্দ হতো না বুঝি।
কি বলিস বাবা?’ আমি মাথা নিচু করে দাঁতে নোখ কাটতাম
মিটিমিটি করে হাসতাম।
মা প্রায়ই একটু ফুরসত পেলেই বলতো, ‘তোর অমত নেই তো বাবা, বল।’
আমি সামান্য হাসির রেখা ছড়িয়ে দিয়ে দহলিজ পার হয়ে
সোজা চলে যেতাম ধানক্ষেতের চরায়। রমণী খানসামার জমির
সবুজ মঞ্জুরীর ওপর হাত বুলাতাম। গমের দানার দিকে
চোখ রাখতাম। মটরশুঁটির ঝাড়ের সাথে খুনসুটি খেলতাম
একেবারে বালকের মতো
আমার বুকের মধ্যে দিয়ে হু হু করে অনেক বাতাস বয়ে যেতো
সে অনেক বাতাস। এম্নি করে
পায় পায় তুমিও হয়ে উঠলে ডাগর, দীর্ঘাঙ্গিনী।
অধুনা তুমিও আকাশ, পাতাল অনেক কিছু ভাবতে পারো
দিব্যি কাটতে পারো অনায়াসে।
আমি যখন তোমার চোখে চোখ রাখি কি বিদ্যুৎ ছড়িয়ে যায়
তোমার চোখের ট্রান্সপারেন্ট কর্ণিয়া যেন
সারা পৃথিবীকে স্বচ্ছ করে তোলে। একটি রেশমি সুতোর ওপর ঝুলতে
থাকে আমার ভবিষ্যৎ। আমি
আর অন্য কোনো রমণীর দিকে তাকাই না এখন
যাকে বলে তাকানোর মতো তাকানো
এখন আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে তোমার অক্ষিকোটরে;
মসজিদের গম্বুজের দিকে যেমন ইমামের চোখ।
তুমি একটি অচেনা অজ পাড়াগাঁর মেয়ে শেকল পরালে পৃথিবীর পায়
আমি ছাড়া আর কেউ শেকল পরতো না হাতে, প্রেয়সী
আমি আর সে শেকল ভাঙতেও পারবো না কোনো দিন।
সভ্যতা কি ভাবে ফলাচ্ছে সোনার ফসল এখানে। সবুজ
প্রান্তরগুলো হয়ে যাচ্ছে ধাতব খামার
ফার্টিলাইজার, সার কারখানার সাদা লবণ হরিৎ মাটিকে
ফালা ফালা করে চিরে চেখে দেখছে।
একদিন সন্ধ্যেবেলা তুমি ঘরে এলে। পৃথিবীর মতো আমিও হয়ে পড়লাম
দারুণ বিষয়ী। আমাদের
দুই পুরুষের বর্গাদার দরবেশ আলি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘খোকামিয়া’ আল্লাহ তোমাকে হায়াত দারাজ করুক।’
সত্যি তুমি বড়ো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে
তুমি আমার উঠোনে পা রাখতেই পাখির বাচ্চার মতো
শিস মেরে ফুটতে লাগলো রুপোলি প্রত্যুষ;
দিন আসে দিন যায়। কিন্তু তোমার ভ্রু— পাতার উন্মীলন
শুধু স্বপ্ন মেলে ধরে, সুমেরু চূড়োর দিকে ছুটে যেতে থাকে
প্রেয়সী, তোমার কটিদেশে হাত রেখে
আমি স্পর্শ করে আসি কাদম্বিনীর মেদুর চাউনি
সেই কতোদিনকার কথা। একুশেই তোমার ভ্রু— পাতার ওপর
দৃষ্টি পড়েছিলো আমার।
বিদ্যাপতির মতো ‘গৃহ আমার গৃহ’
‘দেহ আমার দেহ’— আর
আজ আমার এ আত্মা অনন্তের মতো পরিতৃপ্ত।
