গুমে থাকার যে বর্ণনা দিলেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আযমী

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

দীর্ঘ আট বছর গুম থাকার বর্ণনা দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে এক ভার্চুয়াল ব্রিফিং-এ বলেন, তার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে।

আয়নাঘর থেকে বের হয়ে এই প্রথম বর্ণনা করেন তাকে আটকের দিন কেমন আচরণ করেছিল সাদা পোশাকের বিশেষ বাহিনী। বর্ণনা করেন কীভাবে কাটিয়েছেন আয়নাঘরে।

২০১৬ সালের ২৩শে অগাস্ট নিখোঁজ হন মি. আযমী। সেই দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ওইদিন তিনি তার অসুস্থ মায়ের সাথে ভাত খেতে বসেছিলেন। “সেদিন সরকারের গুণ্ডাবাহিনী আমার বাসায় আসে। তাদের মাঝে যাকে আমার অফিসার বলে মনে হয়েছে, সে আমার সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছে। আমাকে তুই করে কথা বলেছে। চরম দুর্ব্যবহার করেছে,” বলছিলেন তিনি।

মি. আযমী তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা তার জবাব দেয়নি। এমনকি, “মামলা বা ওয়ারেন্ট ছাড়া আমায় গ্রেফতার করতে পারেন না” বলার পরও তারা নির্বিকার ছিল। “তারা খালি বলেছে, (হাতকড়া পড়াতে) হাত দেন। একপর্যায়ে আমি আমার মানসম্মান বাঁচাতে হাত দিয়েছি। নয়তো আমার গায়ে হাত উঠিয়ে দিত। এটাই বাকি ছিল,” তিনি বলেন।

এরপর তারা তার চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে ওঠায়। তারপর একটি মুখোশ পরায়। তারপর দেড় ঘণ্টার মতো পার হয়ে গাড়িটি একটা জায়গায় থামে এবং তারপর তাকে একটা রুমে নিয়ে চোখ হাত খুলে দেওয়া হয়, বলছিলেন তিনি। “ওরা একটা পায়জামা-লুঙ্গি দিল। কাপড় পাল্টে দিতে বললো। আমার বাবার স্যান্ডেল আমার পায়ে ছিল। স্যান্ডেল নিতে গেলে সেটা আমি দেইনি। ওটা আমার বাবার স্মৃতি।”

প্রতিদিন নতুন কায়দায় নির্যাতন চালানো হতো

তিনি জানান, এরপর প্রতিদিন নতুন কায়দায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। মি. আযমী ভেবেছিলেন, তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে। সেজন্য তিনি গাড়িতে বসে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তাকে ক্রসফায়ারের জন্য নিচ্ছে কিনা। “আমার পাশের একজন বললো, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আপনার সাথে কথা বলবে।”

তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিলো, সেখান থেকে টয়লেটে যাওয়ার দূরত্ব ছিল ৫০ কদম। তিনি বলেন, “আমার দু’হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে, মুখোশ পরিয়ে নিয়ে যেত। টয়লেটের ভেতরে গিয়ে চোখ-হাত খুলে দিত। বাইরে থেকে স্টিলের দরজা বন্ধ করে তালা মেরে রাখতো। কাজ শেষ হলে তারা আবার দরজা খুলে দিতো। তারপর চোখ-হাত বেঁধে নিয়ে আবার রুমে নিয়ে আসতো।”

প্রথমদিন ভোররাতের দিকে তিনি ওজু করে এসে তাহাজ্জুদ নামাজ, ফজর নামাজ পড়লেন। সেদিনের স্মৃতি থেকে তিনি বলেন যে নামাজ পড়ে তিনি সারারাত কান্নাকাটি করেছেন। “কারও পায়ের আওয়াজ শুনলেই মনে হত, এই বুঝি আমাকে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাচ্ছে। আমি নামাজ পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে বললাম, এই নামাজ যেন আমার শেষ না নামাজ হয়…আমার লাশ যেন কুকুর বিড়াল না খায়।”

এরপর একটা পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারান ও কতক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরেছে, তা জানেন না। যখন জ্ঞান ফিরেছে, তখন তাকে বলা হয় যে তার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো। তিনি জানান, তাকে যেখানে রাখা হয়, সেখানে দিন-রাত বোঝা যেত না।

“আমি গেল আট বছর সেখানে বন্দি থাকা অবস্থায় পৃথিবীর কোনো আলো দেখিনি, আকাশ দেখিনি, সূর্য দেখিনি। মাঝে মাঝে তারা চোখ এমন ভাবে বাঁধতো, মনে হচ্ছিল আমার চোখের মনি ফেটে যাবে। হাতকড়া পরা থাকতে থাকতে হাতে ঘা হয়ে যেত। আট বছর আমি এক অন্ধকার ঘরে ছিলাম, পৃথিবীর কিছুই আমি দেখতে পাইনি এ সময়।”

গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের দুই দিন পর বাড়ি ফিরেন মি. আযমী। ফিরে এসে তিনি জানতে পেরেছেন, তাকে তুলে নেওয়ার পর “তারা” তার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করেছে এবং তাকেও তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তিনি আরও দাবী করেছেন যে “তারা আমার বাসার যুবতী কাজের মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে।”

যারা তাকে এবং অন্যদেরকে গুম করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করেন তিনি। তার বক্তব্যের শুরুতেই “২৯ হাজার ৭৯৪ ঘণ্টার নির্মম জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সেইসাথে, সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকেও ধন্যবাদ দেন তিনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে ৫০ বছর এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানান, যাতে তারা এই সরকারকের প্রতি সর্বাত্মক সহায়তা অব্যাহত রাখে।

ভারত বিরোধী লেখালেখি এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের সন্তান হওয়ার কারণে গুম করা হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেছেন, ‘দেশে যে বিপ্লব হয়েছে সেটি আমি জানতাম না। আগস্টের ৫ তারিখে রাত সাড়ে দশটার সময় এসে আমাকে বলা হলো আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বললাম, আমিতো ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই যদি দুইটার দিকে আসেন তবে সুবিধা হয়। কয়েকদিন আগেই ডাক্তার দেখে গেছেন, রক্ত পরীক্ষা করলেন। এখন আবার কোথায় নিয়ে যাবেন। পরে আমাকে মুখোশ পরিয়ে আশপাশের আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।’

তিনি বলেন, পরে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে, তার শেষ নাই। আমি বললাম ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতাল তো এতো দূরে না। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেউ কোনো জবাব দিল না। রাস্তা ভাঙাচোরা। আমি জানতে চাইলাম, ঢাকা শহরের কোনো রাস্তা তো এতো ভাঙাচোরা না। আপনারা কি আমাকে কোনো গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? তারা কোনো জবাব দিল না।

পরে আমাকে আরেকটি বন্দি শালায় নিয়ে গেলো। এখন আমি যেটা অনুমান করতে পারি, রাস্তায় ছাত্রজনতা যেভাবে গাড়ি চেক করছিলো এজন্য তারা আমাকে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছেন। পরে তারা বললেন, আপনি এখানে থাকেন। আমি বললাম, আপনারা না আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এটা কোথায় নিয়ে আসলেন? বলা হলো, আপনাকে পরে জানানো হবে।’

ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৬ আগস্ট আমাকে একজন জানালেন, আজ আমাকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। একজন বললেন আপনার কাপড়ের সাইজ বলেন। আমি বললাম, আমি তো গার্মেন্টসের কাপড় পরি না, সাইজ বলতে পারবো না। পরে একটা কাপড় নিয়ে আসা হলো। যেটা আপনারা দেখেছেন মুক্তির পরে প্যান্ট-শার্ট। ওটা দেখলাম ঠিক আছে। বাইরে কি হচ্ছে সে খবরই তো নাই আমার কাছে। পরে সোয়া ৯ টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা রওনা হলো। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা সড়কের পাশে আমাকে নিয়ে তারা ছেড়ে দিলেন। বলা হলো গাড়ি আসবে গাড়িতে উঠে আপনি চলে যাবেন। তখন রাত পৌনে বারোটা বাজে।’

তিনি বলেন, ‘পরে তারা আমাকে টাকা দিলো। আমি জানতে চাইলাম ঢাকায় যাওয়ার ভাড়া কত? তারা বললেন ঠিক জানি না। জানতে চাইলাম এখানে কত টাকা আছে। তারা বললেন পাঁচ হাজার টাকা। আমি বললাম, আমি আপনাদের টাকার মুখাপেক্ষী নই। এখান থেকে ঢাকার ভাড়া যতটুকু ততটুকু টাকা দেন। তারা বললেন আপনি যা করেন করেন, দান করেন, কিছু টাকা আপনাকে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে এক সেকেন্ড কথা বলার আমার রুচি ছিল না। এরপর তারা আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।’

আযমী বলেন, ‘আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। এরপর দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। তখন আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে বাসের মধ্যে উঠি। কিভাবে যে আমি ১০০ মিটারের মতো রাস্তায় দৌঁড়ে বাসে উঠেছি এখনো কল্পনা করতে পারি না। পরে বাসে উঠলাম। আমার স্ত্রী এবং চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বর আমার মনে ছিল। একজনের থেকে ফোন নিয়ে তাদের ফোন করে বললাম। বাস আমাকে টেকনিক্যাল মোড়ে নামিয়ে দিলো। এরপর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ৮ তারিখ ভোরে বাসায় পৌঁছালাম। ’

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা অফিসারের খুনের বদলা চান উল্লেখ করে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, বিগত আমলে যারা তদন্ত করেছে, তারা দায়সারাভাবে তদন্ত করছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন।

কয়েকটি দাবির মধ্যে রয়েছে- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস যেন জনগণের মাঝে তুলে ধরা হয়। জাতীয় সংগীত যেন নতুন করে লেখা হয়। দেশের সংবিধান যেন নতুন ভাবে লেখা হয়। যারা দেশকে নতুনভাবে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাদের যেন সম্মানিত করা হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার আযমী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান কোনো রকম জরিপ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের শহিদের সংখ্যা প্রকাশ করেন। একটা যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেলেন তার কোনো সঠিক সংখ্যা জাতি এখনো জানে না। শহিদের সংখ্যা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার আযমী বলেন, একটা জরিপ হয়েছিল যেখানে ২লাখ ৮৬ হাজার শহিদের সংখ্যা জানা গেলেও শেখ মুজিবুর রহমান ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার আযমী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত যেন নতুন করে লেখা হয়। বর্তমানে যে জাতীয় সংগীত চলছে তা করেছিল ভারত। দুই বাংলাকে একত্রিত করার জন্য করা হয়েছিল এই জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নতুনভাবে হওয়া উচিত। – বিবিসি ও সময় সংবাদদাতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *