গাজা যখন এতিমের শহর

মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আবু বাকের আবেদ

এক মাস আগে গাজার আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে আনা হয় নয় বছর বয়সী রাজান শাবেতকে। মাথায় গুরুতর আঘাত, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হয়েছে। ভেঙে গেছে পা ও হাত। অচেতন অবস্থায় আনা হয় তাকে হাসপাতালে। তার পরিচয় কেউ জানে না। ফলে প্রথম চার দিনের জন্য সে ছিল অজ্ঞাতনামা। আর অজ্ঞাতনামাদের তালিকায় তার নম্বর ছিল ১০১ নম্বর।

৩০ ডিসেম্বর সে জরুরি চিকিৎসা শেষে ছাড়া পেয়েছে। তবে তার ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের কম্পাউন্ডে একটি তাঁবুতে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সেরা এখনো বলতে সাহস পাচ্ছে না, তার মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই।

রাজান হাসপাতালে আসার পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে তার সম্পর্কে জানার চেষ্টায় থাকেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁরা বের করেন যে, সে আর তার পরিবার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হয়েছিল। উত্তর গাজার তুফাহ এলাকা থেকে এই পরিবারের ঠাঁই হয়েছিল সেই শরণার্থীশিবিরে। এখন রাজানই পরিবারটির একমাত্র জীবিত সদস্য।

পঞ্চম দিনে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই রাজান তার মা-বাবাকে খোঁজা শুরু করে। আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. ইব্রাহিম মাত্তার বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম, একটি শিশুর কাছ থেকে। সে জানতে চায়, তার মা বা বাবা কোথায়? অথচ তাঁরা নিহত হয়েছেন। যখন রাজান তার মা-বাবার কথা জানতে চাইল, আমি তখন চুপ মেরে গেলাম।

মাত্তার বলছিলেন, ‘সে বেশ বুদ্ধিমান, দারুণ এবং খুব সুন্দর। সে জানে না তার পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। সে বিশ্বাস করে তারা সবাই ভালো আছে। তার ঠিকঠাক চিকিৎসার জন্য আমরা তাকে সত্যটা বলতে পারি না।

৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বিমান হামলা ও হানাদার বাহিনীর দ্বারা ৮২০০ এরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। আরও অনেকে আহত হয়েছে এবং বেশির ভাগই মারাত্মক আহত।

কেউ কেউ মা-বাবা উভয়কেই হারিয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে গোটা জ্ঞাতি গোষ্ঠীকেই হত্যা করা হয়েছে। এখন যেসব চিকিৎসক তাদের যত্ন নিচ্ছেন তাঁরা জানেন না, এই শিশুদের নিয়ে তাঁরা কী করবেন, তাদের যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

ডা. মাত্তার জানান, বিমান হামলা ও অন্যান্য হামলায় শিকার হয়ে যাদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে তাদের মধ্যে শিশুর অনুপাত বাড়ছে এবং তাদের যত্ন নেওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, ‘রাজান মাঝরাতে চিৎকার করে কান্না করে উঠছিল, যখন অন্য সব চিকিৎসাধীন আহতরা ঘুমিয়েছিল। সে ব্যথানাশক ওষুধ ছাড়া ঘুমাতে পারত না তাই তাকে আমাদের অতিরিক্ত ডোজ ব্যথানাশক দিতে হয়েছিল। তার ব্যথা ভুলিয়ে দিতে রাতের বেলা আমি তাকে গল্প বলে শোনাতাম।’

সব কিছু হারানো এসব শিশুদের প্রচণ্ড ব্যথা থেকে শান্ত রাখার একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে ব্যথানাশক ওষুধ। তবে এটি কোনোভাবে যথার্থ পন্থা নয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ওষুধ পাওয়া যায় না, ফলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্কদের ডোজই তাদের দিতে হচ্ছে। মাত্তার জানালেন, এর ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তিনি।

গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ স্কুল ও হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছে। কারণ তারা মনে করে, তাদের বাড়ি থেকে এখানে অন্তত নিরাপদে থাকতে পারবে। এ ছাড়া বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই।

প্রতিদিন অনেক আহত শিশুর আগমন ঘটছে হাসপাতালগুলোতে। হাসপাতালগুলোই এখন তাদের জন্য প্রকৃত ঘরবাড়ি হয়ে ওঠেছে। কারণ তাদের সঙ্গে মা-বাবা বা পরিবার নেই।

নভেম্বরে দেইর এল-বালাহ এলাকায় একটি বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক পরিবারের ৫৮ সদস্য নিহত হন। সেখানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় পরিবারটির একমাত্র জীবিত সদস্য মাত্র পাঁচ দিন বয়সী শিশু হাসান মেশমেশকে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সে এখন আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে আছে।

হাসপাতালটির একজন নার্স ওয়ারদা আল আওয়াদা বলছিলেন, পুরো নার্স ইউনিট হাসানের দেখভাল করে। সেসব নার্সের মধ্যে ওয়ারদাও একজন। তিনি বলেন, ‘সে যে নিরাপদে আছে, সেটিই আমরা তাকে বুঝতে দিতে চাই। চিকিৎসার ফলে সেও ভালো হয়ে উঠছে।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশেষে শিশুটির দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়কে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছে। সেই আত্মীয় ৫৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ মেশমেশ হাসপাতালে আসেন হাসানকে দেখতে এবং তার যত্ন নিতে সাহায্য করেন।

হাসপাতালটিতে আসা পরিবার হারানো আরেক শিশু হলো মোতাজ আবু-ঈসা, যার বয়স সাত বছর। সম্প্রতি তাকে জরুরি চিকিৎসা সেবা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোমর, পা ও হাত ভাঙা নিয়ে সে বিশ দিন কাটিয়েছে হাসপাতালে।

ইসার বেঁচে থাকা একজন স্বজন মোহাম্মদ আবু ঈসা বলেন, সে তার গোটা পরিবারকে হারিয়েছে। এখন তার দায়িত্ব নেওয়ার মতো আমিই আছি। সে দিনে একবার মাত্র খাবার খেতে পারছে, কিছু রুটি আর টমেটো। সে এখন অপেক্ষা করছে, কখন যুদ্ধ শেষ হবে, তখন সে আরব আমিরাতে তার চাচাদের কাছে চলে যাবে। তার গভীর প্রত্যাশা, অচিরেই এই যুদ্ধের অবসান হবে।

* আবু বাকের আবেদ আলজাজিরার সাংবাদিক। আলজাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে প্রথমআলো’র অনুবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *