গরীবের বন্ধু ছিলেন ডা. মাহমুদুর রহমান নীলু

প্রবন্ধ-কলাম বাংলাদেশ
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তন চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান নীলু গত বছর (৭ মে ২০২১) ইন্তেকাল করেন। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডনে এক স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

কোভিড–১৯ তথা করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে বাংলাদেশ সহ বিশ্বজুড়ে যখন আতঙ্ক, চারদিকে উৎকণ্ঠা আর অসহায়ত্বের চিত্র, এমন দুঃসময়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে যারা নিজেদের মেলে ধরছেন, নিজের জীবন বাজি রেখে স্বেচ্ছায় অন্যের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, আর মানুষ যাদের পরামর্শ পরম আস্থায় চোখ বুজে গ্রহন করতেন, এমন একজন মানবিক চিকিৎক ছিলেন ডা. মাহমুদুর রহমান।

গরীবের বন্ধু ছিলেন ডা. মাহমুদ। রোগী সেবাই ছিল তার কাছে এবাদত। নিজে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্যদের সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করে চলে গেলেন মহান মাবুদের দরবারে। তার মত মানব হিতৈষী ব্যক্তিত্ব আজকাল খুবই বিরল।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যখন ছিলেন, প্রায়ই তার সাথে দেখা হত। আমি তখন সিলেট থেকে জাতীয় সংবাদপত্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। শিক্ষা ও চিকিৎসা আমার রিপোর্টের একটি প্রধান বিষয় ছিল। রোগীরা কেন সরকারি হাসপাতাল বিমুখ হচ্ছে, তা নিয়ে বহু সরেজমিন প্রতিবেদন করেছি। তখন তিনি আমাকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি বিশ্লেষণ করেছেন। প্রতিকারের জন্য তাদের প্রাণান্ত প্রয়াসের কথাও বেরিয়ে এসেছে।

ডা. মাহমুদ পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ডিউটি শেষ হলেই যারা বাসায় বিশ্রামে কিম্বা প্রাইভেট চেম্বারে বাড়তি রোজগারের জন্য ছুটে চলেন, ডা. মাহমুদ ছিলেন তাদের প্রতিপক্ষ। তিনি সরকারি দায়িত্বের পরও অনেক সময় হাসপাতালে বিচরণ করতেন। পরিচিত এমনকি অপরিচিত অসহায় রোগীদের সহায়তায় প্রাণপাত করেছেন।

এক সময় তিনি সিলেট মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ডিরেক্টর ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে রোগীদের সরকারী হাসপাতালে যাবার জন্য উৎসাহিত করতেন। তাহলে প্রাইভেট হাসপাতালে যুক্ত হলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, কিছু মানুষ দ্রুত সেবা পেতে চায় বলে প্রাইভেট ব্যবস্থা। বিত্তবান মানুষ প্রাইভেট চিকিৎসায় এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটা তাদের মানসিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছু নয়। মূলত সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসক ও চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে, যা অনেক বেসরকারি হাসপাতালে কল্পনাও করা যায়না।

প্রখর মেধাবী ও প্রচন্ড উদ্যমী ডা. মাহমুদ সব সময় ইতিবাচক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন। তিনি বলতেন সমাজের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষের চিন্তা-চেতনা নেতিবাচক হওয়ার কারণে সমাজ তাদের থেকে উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মতে, শূন্যবাদী (NIHILIST) ও নৈরাশ্যবাদীদের (PESSIMISTIC) একপেশে জীবনদৃষ্টি এর জন্য দায়ী। স্রষ্টায় বিশ্বাস না থাকলে এমনটি হয়। তিনি মনে করেন, আল্লাহর ওপর ভরসা এবং অল্প পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারা মানবজীবনের অন্যতম বড় সফলতা।
ডা. মাহমুদ আমার আত্মীয়, তালতো ভাই। আমার ভাই আমেরিকা প্রবাসী মাওলানা ফায়্যাজ আহমদ চৌধুরী তার ভগ্নিপতি। তার বোন কবি হালিমা আক্তার আমার ভ্রাতৃবধু। আত্মীয়তার সুবাদে প্রায় তিন যুগ ধরে তাকে খুবই কাছে থেকে দেখে আসছি। একজন সদা হাস্যোজ্জ্বল ও নির্লোভ প্রকৃতির মানুষ তিনি। হাসি-খুশি ও মিষ্টভাষী মানুষটি অমিত তারুণ্য শক্তির অধিকারী ছিলেন।

লন্ডনে আসার পর এখানকার চিকিৎসকের সদাচরণ, দায়িত্বশীলতা এবং নিয়মিত অধ্যয়ন দেখে ডা. মাহমুদের কথা মনে পড়ে। অত্যন্ত প্রচার বিমুখ এই মানুষটি এক অসাধারণ গুণের অধিকারি ছিলেন। তার চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্মৃতি আজ বার বার মনে পড়ছে।

ডা. মাহমুদ বন্ধুবান্ধব সহ পরিচিত মহলের ভাল-মন্দ, সমস্যা, অসুবিধায় নিরবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। ভাল চিকিৎসক হয়ত অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু তার মত মানব দরদী জনগনের সেবক বরেন্য ও নন্দিত চিকিৎসক সহজে মেলা ভার।

সিলেট শহরের সুবিদবাজার নূরানী আবাসিক এলাকা নিবাসী ডা. মাহমুদের পৈত্রিক নিবাস সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায় গঙ্গাজল। বাবার কর্মস্থল ফেঞ্চুগঞ্জে বড় হয়েছেন তিনি। তার বাবা বিশিষ্ট সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মরহুম আব্দুল জব্বার ফেঞ্চুগঞ্জে পোস্টমাস্টার ছিলেন।

শিক্ষা জীবনে ডা. মাহমুদ ফেঞ্চুগঞ্জ কাসিম আলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে এসএসসি, সিলেট এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে এইচএসসি, সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে এমবিবিএস এবং বিএসএমএমইউ থেকে PHYSICAL THERAPY & SPORTS MEDICINE বিষয়ে এফসিপিএস (FCPS) করেন।
তিনি ইমিগ্রেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহন করেছিলেন। তবে পেশাগত কারণে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেননি। তার স্ত্রী অধ্যাপক শাহনাজ মাহমুদ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

ডা. মাহমুদের জানাযার নামাজ হযরত শাহজালাল (রহ:) দরগা মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট নগরীর উল্লেখযোগ্য চিকিৎসক এবং আলেম-ওলামা সহ বিভিন্ন স্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ জানাযায় অংশগ্রহন করেন। পরে দরগাহ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।


লেখক: সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *