গরিব ।। রোকেয়া খাতুন রুবী

গল্প-উপন্যাস শিল্প-সংস্কৃতি
শেয়ার করুন

শানু এর আগে কোনওদিন পরী দেখেনি। এবার দেখল। মা আগে এসে এ বাড়ি ঘুরে গেছে। ফিরে গিয়ে বারবার একই কথা বলেছে। মেয়ে তো নয় যেন ডানাকাটা পরী! শানুর মনে হয়, মা একটুও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যি তিনটে বোনই পরীর মতো সুন্দর!

শানু এখন থেকে এ বাড়িতে থাকবে। কারণ শানুর বাবা নেই। শানুদের থাকার মতো একটা ভালো ঘর নেই। শানুর মাকে অনেক ওষুধ খেতে হয়। তার জন্য টাকা লাগে। শানুরা দুই বোন এভাবে দু’বাড়িতে কাজ করবে বলে ঢাকায় এসেছে। বাড়িতে মায়ের সঙ্গে ছোট দুই বোন আর একমাত্র ভাইটি রয়ে গেছে।

তিনটে পরীর মতো সুন্দর মেয়েকে দেখে শানুর খুব মন খারাপ লাগে। নিজের কালো লিকলিকে দুটো হাত আর ময়লা জামার দিকে তাকিয়ে তার কান্না পেয়ে যায়। খুব কষ্টে ঢোক গিলে সে কান্না থামায়।

পরীদের মা এসে ঘরে ঢুকতেই আবার অবাক হওয়ার পালা শানুর। কী সুন্দর নীল শাড়ী পরা পরী রানী! ঘাড়টা একটু কাত করে তিনি মিষ্টি করে হাসেন। তারপর ময়নার মা বলে ডাক দিতেই একজন নাদুস-নুদুস তেলতেলে চুলে টানটান করে বাঁধা এলোখোঁপার মহিলা ছুটে আসে।

পরী রানী বলেন, ‘ওকে নিয়ে বাথরুমে যাও। কাপড় পাল্টে দাও।’ তারপর শানুর দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসেন। নাম জিজ্ঞেস করেন। ময়নার মা ততক্ষণে হাওয়া। একটু পরে হাতে জামা-প্যান্ট নিয়ে হাজির। হয়তো তিন পরীর কোনও একজনের পুরনো জামা। জামা থেকে কী সুন্দর চাঁপাফুল চাঁপাফুল ঘ্রাণ আসছে!

গোসল করানোর সময় ময়নার মা বলে, ‘আমাকে খালা বলে ডাকবে। মিথ্যা কথা বলবে না। চুরি করে খাবে না। বাড়ির বাইরে কোথাও একা যাবে না।’

শানু মন দিয়ে ময়নার মায়ের কথা শোনে। এর আগে কোনওদিনও এত সুন্দর সাবান মাখেনি সে। এত সুন্দর গোসলঘরও দেখেনি। গরম ভাতের সঙ্গে মসুর ডাল আর ভুনা মুরগির মাংসতেই পেট ভরে যায় তার। অন্য কিছু আর পাতে নিতে ইচ্ছে করে না।

খাওয়া-দাওয়ার পর ময়নার মা তার ঘরে নিয়ে যায়। অনেক বড় বিছানা। কী সুন্দর চাদর পাতা! মাথার ওপর ফ্যান চলছে। ঘরের এককোণে একটা সাদাকালো টিভিও আছে। টিভি দেখতে খুব ভালো লাগে শানুর। তাদের গ্রামে সাকুল্যে তিনজনের বাড়িতেই টিভি আছে। ঘুরে-ফিরে সেখানেই দেখতে যেত। টিভির মালিকরা কত বকা দিত! রাগ করত। তবু যেত। নাচ গান সিনেমা দেখলেই তার মনটা কেমন ছটফট করে উঠত। তার জন্য মায়ের কাছে কত বকা আর মার খেতে হয়েছে তাকে।

ময়নার মা বলে, ‘ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যাও। বিকেলে আমি ডেকে দেব। বাসে চড়ে কত দূর থেকে এসছে শানু। এখনও শরীরটা মনে হয় ঝাঁকানি খাচ্ছে। পয়সা বাঁচানোর জন্য আব্বাস নানা কম দামের পুরনো বাসে চড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।

আব্বাস নানা পরী রানীদের কেমন যেন আত্মীয়। শানুদের গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী। আব্বাস নানা শানুকে রেখেই চলে গেছেন।

জীবনে প্রথম মাখা দামি সুগন্ধি সাবানের মতো সুন্দর বিছানা পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শানু। বিকেলে ময়নার মা তাকে ডেকে তোলে। মুখ ধুইয়ে খাবার ঘরে নিয়ে যায়। সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্চে। শানুকে একটা মোড়া এনে দিল ময়নার মা। ছোট্ট একটা প্লেটে নাশতা সাজিয়ে দিল।

শানুর সব কিছু কেমন ঘোরের মতো লাগে। মনে হয় সত্যি সত্যি একটা পরীরাজ্যে চলে এসেছে সে। তিন পরীর নাম এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে শানুর। বড় পরীর নাম ফারা। মেজো পরী সারা আর ছোট পরী হেমা। আর শানুকে এ বাড়িতে আনা হয়েছে হেমার খেলার সাথী হওয়ার জন্য।

হেমা এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। ফারা আর সারা বাসায় না থাকলে ও একা হয়ে যায়। বাবা-মা অফিসে চলে গেলে ময়নার মা রান্নাঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আর বড়দের সঙ্গে খেলতে একদম ভালো লাগে না হেমার।

দু’চারদিন যেতেই এ বাড়ির তিন মেয়ের সঙ্গে ভারি ভাব হয়ে যায় শানুর। ওরা শানুকে নিয়ে খেলার মাঠে হইচই করে। টিভিতে একসঙ্গে কার্টুন দেখে। বাড়ির জন্য একটুও মন খারাপ লাগে না শানুর। এ ক’দিনেই চুড়ি, জামা, ফিতে অনেক কিছু জমা হয়ে গেছে শানুর।

রাতের বেলা ময়নার মায়ের সঙ্গে ঘুমোতে গেলে ময়নার মা বুকে টেনে নেয় তাকে। ময়নার মায়ের গায়ে কেমন মা মা গন্ধ। শানুর মনে হয় বাড়িতে যেমন ময়লা-ছেঁড়া বিছানাতে মায়ের বুকের সঙ্গে লেগে থাকত, তেমনই যেন মায়ের বুকেই শুয়ে থাকে।

মা যেমন অন্ধকারে চুলে বিলি কাটতে কাটতে উকুন তুলত আর অন্ধকারেই কেমন যেন কুটুস করে সেটা দুই নখ দিয়ে মেরেও ফেলত, ময়নার মাও ঠিক তেমন করে। তবে ময়নার মা বলেছে, এ বাড়ির কোনও মেয়ের মাথায় উকুন নেই। শানুর মাথায় তাই ওষুধ দিয়ে সব উকুন মেরে ফেলবে সে। নিজের গায়ের কালো রঙট্ নিয়ে ওর খুব দুঃখ। খেলার মাঠের ছেলেমেয়ে সবাই কী সুন্দর। ফর্সা, ঝকঝকে। সারা আর হেমা সাঁই সাঁই করে সাইকেল চালিয়ে সারা মাঠ ঘুরে বেড়ায়। ছোট গোলাপি রঙের সাইকেলগুলোর পেছনে ছুটতে হয় শানুকে। তবে বেশিদিন ওদের পেছনে দৌড়াতে হয় না।

ফারা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে এখন আর সাইকেল চালাতে চায় না। এক বিকেলে শানুকে তার সাইকেলটা দিয়ে দেয় ফারা। হালকা পেস্ট কালারের সাইকেলটাকে পঙ্খিরাজ ঘোড়া মনে হয় শানুর। ক’দিনেই সাইকেল চালাতে শিখে যায় না শুধু, প্রতিযোগিতায় সবার আগে চলে যায় শানু। শানুর চেয়ে বেশি দ্রুত কেউ দৌড়াতে পারে না। মনে হয় বাতাস কেটে তীরের মতো ছুটে যায় সে। শুধু কী তাই! শানু যে গ্রামে থাকতে সাঁতারেও সবাইকে ছাড়িয়ে যেত সে গল্পও তো সবার জানা হয়ে গেছে। আর গাছে চড়া? শানুর জন্য ওটা কোনও ব্যাপারই নয়। সুপারি, বরই, পেয়ারা, জলপাই কোন গাছে না বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে জানে শানু!

এত গুণ যার, সে মেয়ে কি চুপ করে থাকতে পারে? মাঠের সব ছেলেমেয়ের কাছে শানু তাই খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। শানুকে ছাড়া ওদের বিকেলটাই মাটি। শানু কত গল্প জানে। কত রকম খেলা। ভূত-পে্তনির গল্প বলতে বলতে শানু নিজেই ভূতের মতো মুখ বাঁকায়। সবাই ওরে বাবা বলে বাসার দিকে ছুটে যায়। শানু হাসে খিল খিল করে। শানুর কালো মুখে সাদা দাঁতগুলো ঝিকমিকিয়ে ওঠে।

মা মাছগুলো কী করে ছানাপোনা নিয়ে পানিতে ভেসে বেড়ায়, কাদার ভেতর থেকে কী করে টাকিমাছ আর কই, মাগুর, শিং বের করে আনতে হয় সে তো শানুই জানে। শানু জানে, শাপলার ডাঁটা নখ দিয়ে খুঁটে ফাঁক করে কী করে মালার মতো করা যায়। মুরগিগুলো ডিমের ওপর বসে তা দিতে দিতে কী করে ডাকে- শানু অবিকল সে ডাক শোনাতে পারে।

মা এসেছিল শানুকে দেখতে। শানুকে প্রথমে চিনতেই পারেনি। মা তার দুর্বল হাত দিয়ে বারবার শরীরটা ছুঁয়ে দেখেছে। শানুকে সঙ্গে নিতে চেয়েছে। শানু রাজি হয়নি। এ শহর ছেড়ে শানুর কাদাপানিতে যেতে আর ইচ্ছে করে না। যাওয়ার সময় মা চাল ডাল তেল চিনি বস্তা ভরে নিয়ে গেছে। মা যাওয়ার সময় বুকের মাঝখানে কেমন মোচড় টের পেয়েছে শানু। কিন্তু ওইটুকুই। বিকেলের খেলার মাঠের রানী সে। শানু যখন জোরে জোরে বলে, রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম… তখন সবাই শানুর পেছনে কাঁধে হাত রেখে রেলগাড়ি হয়। এই জীবন ছেড়ে শানু যাবে কোথায়?

শানু ছাড়া কোনও মেয়েই গাছে চড়তে জানে না। আশপাশের ফ্লাটে শানুর মতোই আশ্রিত কোনও কোনও ছেলে হয়তো পারে, তাও শানুর মতো নয়। শানুর তাই মনে খুব অহংকার। ফারার দাদিমণি বলেন, গেছোমেয়ে। শানুর কথাটা ভালোই লাগে। দাদির সাদা চুলে মেহেদির লাল রঙ। কাপড়-চোপড় ভীষণ পরিপাটি। মাঠের চারপাশে ছড়ানো সব ফ্ল্যাটের লোকজনের সঙ্গেই দাদিমণির ভাব। সকাল-সন্ধ্যা হাঁটতে গিয়ে কত যে গল্প। ফারার বাবা অনেক বড় অফিসার, সেটা বুঝতে পারে শানু। ফারার মাও। সব ফ্লাটেই বড় বড় অফিসাররা থাকেন, দাদিমণিই বলেছেন। চারপাশের পরিবশ তাই খুব পরিপাটি। সুনসান। কোনও হট্টগোল নেই।

শুধু বিকেলবেলা খেলার মাঠটা ছোট ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে। এই বিকেলটা শানুর খুব প্রত্যাশিত। দুপুরের পর থেকেই শানু বিকেলের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। হেমাকে জামাকাপড় পরিয়ে দেয় সময়ের আগেই।

ইদানিং শানুর মনটা বেশি চঞ্চল হয়ে ওঠে। মাঠের একপাশে বিশাল বরইগাছটায় বরই পাকতে শুরু করেছে। শানু গাছে উঠে বরই পেড়ে দেয় সবাইকে। তবে বেশি দূর ওঠা নিষেধ। একটু উঠেই ডাল ধরে ঝাঁকুনি দিলেই বরই পড়ে টুপটাপ। সবাই খুব মজা করে তা কুড়াতে থাকে। শানুর খুব গর্ব হয়। নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হয়।
কোনওদিন যা হয় না, আজকে তাই হয়। ফারার বাবা-মা দুজনেই দুপুরের খাবার খেয়ে অফিসের জরুরি অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতে শানুকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘আমরা না ফেরা পর্যন্ত মাঠে যেও না।’

শানুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফারার বাব-মা বাইরে যাবে দেখে সে কত খুশি হয়েছে। আজ তাড়াতাড়ি মাঠে গিয়ে অনেক বরই পাড়তে পারবে। বাবা-মায়ের গাড়ি গেটের বাইরে যেতেই শানু হেমাকে জামা পরায়। কেডস পড়ায়। নিজেও সুন্দর একটা জামা পরে। দাদিমণির চোখ পড়ে তাদের ওপর। কঠিন গলায় নিষেধ করেন মাঠে যেতে।

বিছানায় শুয়ে দাদিমণির চোখটি যখন ঘুমে জড়িয়ে আসছিল তখন শানু হেমাকে শিখিয়ে দেয়, দাদিমণির কাছে গিয়ে মাঠে যাওয়ার বায়না ধরার জন্য। ফারা আর সারা ততক্ষণে ঘুমে কাতর হয়ে গেছে। দাদিমণি ঘুমের আমেজ নষ্ট হওয়াতে ভীষণ রেগে যান। খাট থেকে নেমে সোজা শানুর সামনে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলেন, ‘আজ বাইরে যাওয়া নিষেধ।’ তারপর দাদিমণি আবার বিছানায় এলিয়ে পড়েন।

হেমা ততক্ষণে টিভিতে কার্টুন দেখতে শুরু করেছে। শানুর টিভিতে মন নেই। কেন যেন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। বিকেল যে কখন আসবে! দাদিমণি ঘুমিয়ে গেছেন, টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হেমার হাত ধরে আস্তে করে দরজা খুলে একছুটে খেলার মাঠে। কিন্তু খেলার মাঠ তো ফাঁকা। কেউ নেই। কিন্তু ফাঁকা কি আর ফাঁকা থাকে! ওদের মতো দুষ্টু দু’চারজন যারা দুপুরে একদম ঘুমুতে চায় না তারাও এস মাঠে জড়ো হয়।

খেলা ফেলে শানু বরইগাছে উঠে যায় তরতর করে। শানু বরইগাছের ডালে ঝাঁকুনি দিতে দিতে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যেতেই থাকে। কী যে হয়েছে আজকে তার! কেবলই উপরের ডাল ধরতে ইচ্ছে করছে। শানু যত ডাল ঝাঁকায় নিচে ছেলেমেয়েরা তত হাততালি দেয়। শানুর উৎসাহ বেড়ে যায়। ওদের কাছে নিজেকে আরও বিশেষ কিছু দেখানোর নেশায় কী এক সাহস এস যায় তার ভেতর। শানু ডাল ছেড়ে ডালে উঠতে উঠতে অনেক উপরে উঠতেই সবাই জোরে জোরে হাততালি দিতে থাকে। শানুর হমে হয়, সে আর গ্রামের গরিব কালো কুচকুচে শানু নেই। সে এখন পরী হয়ে যাচ্ছে। ফারার মতো। সারার মতো। নিজেকে পরী ভাবতে ভাবতে হয়তো উড়তে ইচ্ছে করে তার। গাছের একটা বড় ডাল থেকে উঁচু আরেকটা ছোট ডালে পা দিতেই শানুর মনে হল সে ধাঁই করে কোথায় যেন উড়ে যাচ্ছে। তবে উপরে নয়, নিচের দিকে। পরীরা কি এভাবেই ওড়ে?

ছোট ডালটা শানুর ভার সইতে পারেনি। শানুর শরীরটা যখন নিচে পাকা চত্বরটার ওপর পড়ল তার মাথা ফেটে রক্ত গড়াতে থাকল। ছেলেমেয়রা ভয়ে পালিয়ে গেল। হেমাও ঘামতে ঘামতে দৌগে সিঁড়ি টপকে বাসায় ফিরে দেখল তখনও সবাই ঘুমুচ্ছে। না বলে বাইরে যাওয়ার ভয়ে দাদিমণি বা বোনদেরও ডাকার সাহস নেই তার। কিন্তু শানুর জন্য যে বুক ফেটে যাচ্ছে তার!

দাদিমণির মতো আরেক দাদিমণিও পাশের ফ্লাট থেকে রোজ বিকেলে খেলার মাঠের ছেলেমেয়েগুলোকে দেখতে থাকেন। আজকেও দুপুরে ঘুন না আসার কারণে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। শানুর পড়ে যাওয়াটা তাই দেখতে পেয়েই বড় ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। ফারার বাবার চেয়েও বড় অফিসার তার এই ছেলেটি। মায়ের মুখে বিষয়টি শোনেই কোনও কথা না বলে ঝটপট শার্ট গায়ে দিয়ে গাড়ির চাবি হাতে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসেন। শানুর রক্তাক্ত শরীরটা নিয়ে সোজা হাসপাতালে ছোটেন তিনি।

কোনওদিন যা হয় না আজকে তাই হয়। ফারার বাবার মনটা কেমন ছটফট করতে থাকে। মিটিংয়ের মাঝখানেই তিনি অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে যাওয়ার আগেই মাঠের জটলা দেখে বুকটা ধক করে ওঠে তার। দৌড়ে একজন এসে তার গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। খবরটা পেয়েই হাসপাতালে ছুটে যান বাব-মা। শানুকে তখন বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। বাবা-মা দুজনেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। পাগলের মতো ডাক্তারদের হাত জড়িয়ে বলেন, ‘শানুকে বাঁচান, শানুকে বাঁচান…।’ খবরটি জানাজানি হতেই ফারাদের আত্মীয়স্বজনে ভরে যায় হাসপাতাল। সবার এককথা, ‘যত টাকা লাগে লাগুক, যত রক্ত লাগে দেব, তবু শানুকে বাচাঁন।’ কিন্তু পরী হতে চাওয়া শানু আর কোনওদিন উড়তে না পারার বেদনা নিয়ে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যায়।

ফারাদের কান্নায় চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। ছোট্ট শানু হাসপাতালের হিমঘরে শুয়ে থাকে।
আব্বাস নানাকে খবর দেওয়া হয়েছে শানুর মা-ভাইকে নিয়ে আসার জন্য। ভোররাতে তারা এসে পৌঁছায়। অসহায়, দুর্বল ক’টা মানব-মানবী। কাঁদারও যেন শক্তি নেই। হাসপাতালে শানুর মুখটা দেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শানুর না। একসময় কান্না থামে। নীরবে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে।

শানুর জন্য অ্যাম্বুলেন্স আসে। শানুকে গ্রামে নিয়ে তার বাবার কবরের পাশে শুইয়ে দেওয়া হবে। শানুকে গাড়িতে তোলা হয়। আব্বাস নানা ওঠেন। শানুর ভাই ওঠে। আরও দ’চারজন লোককে সঙ্গে দেওয়া হয়। শানুর মায়ের হাত ধরে ফারার বাবা কাঁদছেন অঝোর ধারায়। মা দু’হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইছেন।

শানুর মা বলে, ‘সব আল্লার ইচ্ছে বাবা।’ বলেই ডুকরে ওঠে। দাদিমণি একটা টাকাভর্তি পার্স তুলে দেন শানুর মায়ের হাতে। কান্না জড়ানো গলায় বলেন, ‘শানুর মা, আমাদের কোনও দোষ ছিল না, বিশ্বাস করো। তোমাকে সারা জীবন আমার ছেলে যা পারে টাকা-পয়সা পাঠাবে, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও।’

শানুর মায়ের একহাতে টাকাভর্তি পার্স, শানুর জামা-কাপড়ের সঙ্গে শখের জিনিস ভর্তি একটি ব্যাগ আর অন্য হাত ছোট মেয়ের হাতে ধরা। অ্যাম্বুলেন্সের পাদানিতে পা দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় শানুর মা। সবার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। কী বলবে শানুর মা?

ছোট মেয়েটাকে এনে দাদিমণির সামনে দাঁড়ায় শানুর মা তারপর মেয়েটাকে দাদিমণির পায়ের কাছে বসিয়ে বলে, ‘এই মেয়েকে আপনাদের কাছে রেখে দেন।’ চম কে ওঠে সবাই। শানুর চেয়েও ছোট, শানুর চেয়েও লিকলিকে দুর্বল এই ছোট মেয়েটাকে কেমন করে রাখতে চায় শানুর মা? কোন সাহসে শানুর মৃত্যুর পরও তার আরেকটি মেয়েকে রাখতে চায়? ভয় লাগছে না?

বাবা অসহায় গলায় না-না বলে ওঠেন। বাবার কথাগুলো কেমন আর্তনাদের মতো শোনায়। শানুর মা ব্যাকুল গলায় নিচু স্বরে বলে, ‘আমরা যে বড় গরিব গো স্যার। মেয়ে চলে গেছে, আপনারা কি আর আগের মতো দেখতে পারবেন! কিন্তু আমার যে ওই সাহায্যটা বড় দরকার।’

উপস্থিত সবাই কথাহীন দাঁড়িয়ে থাকে। আর লিকলিকে ছোট মেয়েটি দুর্বল দু’হাতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বাবার পায়ের কাছে গিয়ে পা দুটো জড়িয়ে ধরে। শানুর মা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগোয়। ছোট মেয়েটি মায়ের পেছনে দৌড়ে যায় না। চিৎকার করে না। কাঁদে না। এ বয়সেই অভাবের মানে জেনে গেছে সে।

সবাই অবাক চোখে মেয়েটাকে দেখছে। তবে মেয়েকে নয়, তারা টের পেল অভাব নামের কী এক অদৃশ্য কালো ধোঁয়া তাদের সবাইকে ‘গরিব’ বানিয়ে দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *