অভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক বিপ্লব নয়; এটি এক নৈতিক হুঁশিয়ারি। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে কেবল তখন, যখন সেটি ন্যায়, নৈতিক অনুমোদন এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের সঙ্গে মিলিত থাকে। যারা জনগণের নৈতিক অংশগ্রহণকে অবজ্ঞা করবে, তাদের শাসন ধ্বংসাত্মক সংকটের মুখোমুখি হবে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নির্দেশ করে- রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক কাঠামো বা বাহ্যিক শক্তির মাধ্যমে পরিচালনা করা যায় না; জনগণের নৈতিক চেতনা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সামাজিক সংহতির সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে। এই একত্রিত নৈতিকশক্তিই নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, জনগণের বিশ্বাস এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক শান্তি
গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে লেখক ও চিন্তক ফিরোজ আহমেদ বলেছেন গণ-অভ্যুত্থান নিজেই অন্তত তিনটি সংস্কার অর্জন করেছে, যার মর্মার্থ হলো: (ক) পুরনো বুদ্ধিজীবীদের প্রাসঙ্গিকতা ভেঙে পড়েছে। (খ) রাজনৈতিক গুণ্ডাতন্ত্র ভস্মীভূত হয়েছে। (গ) মানুষের আশা ও সাহস পুনর্জন্ম হয়েছে।
যদিও গণ-অভ্যুত্থানের আরও বিস্তৃত নৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বিদ্যমান, তবু ফিরোজ আহমেদের এই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, এগুলো অভ্যুত্থানের মর্মচেতনাকে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করার জন্য গভীর রাজনৈতিক ও দার্শনিক পর্যালোচনার দাবি রাখে।
১. পুরনো বুদ্ধিজীবীদের প্রাসঙ্গিকতা হারানো: জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়ই-এটি ছিল এক নৈতিক ভূমিকম্প, যা পুরনো বুদ্ধিজীবিতার ভগ্নাবশেষ উন্মোচন করেছে। রাষ্ট্রের অন্যায়কে আড়াল করে রাখা মুখোশ ছিঁড়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে স্পষ্ট হয়েছে- যে বুদ্ধিজীবিতা জনগণের সত্য, দুঃখ ও সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত নয়, তার পরিণতি অনিবার্য ধ্বংস।
এই অভ্যুত্থান বিশেষভাবে উন্মোচন করেছে আত্মঘাতী বুদ্ধিজীবীসত্তাকে-যারা মুক্তিযুদ্ধের আত্মদানকে অবৈধ ক্ষমতার গিলোটিনে বলি দিয়েছে, ভোটারবিহীন নির্বাচনকে নৈতিকতার মুখোশে বৈধতা দিয়েছে, উন্নয়নকে গণতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে, জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের তত্ত্বে উৎসাহী থেকেছে, মুক্তিযুদ্ধকে ব্যক্তি বা দলের কৃতিত্বে সংকুচিত করেছে, রাষ্ট্রকে লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরের তাত্ত্বিক পাথেয় জুগিয়েছে এবং ক্ষমতাকে বিদেশি শক্তির নিকট অর্পণের তীর্থযাত্রা করেছে।
তাদের এই ভূমিকা নিছক রাজনৈতিক নয়; এটি এক ধরনের নৈতিক আত্মঘাতিতা। এতে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হয়েছে, অন্যদিকে জনগণের নৈতিক চেতনা অবদমিত হয়েছে, আর রাষ্ট্রের শৃঙ্খল আরও মজবুত হয়েছে। ফলে গণ-অভ্যুত্থান তাদের প্রাসঙ্গিকতাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং দার্শনিক অর্থে সমগ্র বুদ্ধিজীবী সত্তাকেই শূন্যতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। গণ-অভ্যুত্থান এই নগ্ন সত্যকে নির্ভীকভাবে সামনে এনেছে।
২. রাজনৈতিক গুণ্ডাতন্ত্রের ধ্বংস: গণ-অভ্যুত্থান এক মহা অগ্নিদাহের মতো ধ্বংস করেছে সেই গুণ্ডাশক্তিকে, যা বছর বছর ধরে রাষ্ট্র ও সমাজ দখল করে রেখেছিল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা এই গুণ্ডাতন্ত্র আর টিকে থাকতে পারেনি-কারণ জনগণের নৈতিক চেতনা, সাহস এবং ঐক্য তার ভিত্তি অটুটভাবে ভেঙে দিয়েছে। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে এটি স্পষ্ট বার্তা দেয়-শাসনের প্রকৃত বৈধতা কোনো অস্ত্রের ভয়, টাকার লোভ বা অসৎ প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল নয়; এটি জনগণের সাহস, নৈতিক অনুমোদন এবং ঐক্যের শক্তির ওপর স্থিত। একবার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে-জবরদস্তি, সন্ত্রাস, অস্ত্র বা অর্থের চাপ কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারে না।
এই সব আত্মপ্রকাশিত দুর্নীতিবাজ-শক্তি গণ-অভ্যুত্থানের অগ্নিশিখায় নিখুঁতভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি এক নৈতিক বিপ্লবের চিহ্ন, যা দেখিয়েছে-রাজনীতি মানে আর ক্ষমতার লোভে লিপ্ত থাকা নয়, বরং জনগণের নৈতিকচেতনা ও সাহসের ওপর দাঁড়ানো। যে রাজনীতি শুধু গুণ্ডাতন্ত্রের দাপট ও ভয় দেখানোর উপর দাঁড়ায়, তার ভবিষ্যৎ অনিবার্যভাবে ধূলিসাৎ এবং ইতিহাসের নৈতিক বিচারের মুখোমুখি হবে।
৩. মানুষের আশা ও সাহসের পুনর্জন্ম: গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে গভীর অর্জন হলো-জনমানসের মধ্যে ভীতি ভেঙে সাহসের জন্ম। এটি কেবল আত্মবিশ্বাস নয়; এটি নৈতিকশক্তির পুনর্জন্ম, যা রাষ্ট্রযন্ত্রের অবৈধ আদেশ, অবৈধ শক্তি, অস্ত্রের প্রয়োগ, মৃত্যু, জেল বা জরিমানা সবকিছুকে অকার্যকর করে দেয়। জনগণ শিখেছে মৃত্যুকে শ্রদ্ধা জানাতে, প্রাণ উৎসর্গকে ন্যায়ের অটল সংকেত হিসেবে ধারণ করতে। এই শিক্ষা রাজনৈতিক আন্দোলনকে শুধু দাবিতে সীমাবদ্ধ রাখে না; বরং রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে রূপান্তরিত করে।
একসময়ে ভয়ের ঘোরে রাস্তায় বেরোতে ভয় পেতো জনগণ, আজ তাদের সাহস সেই ভয়ের সব সীমাকে অতিক্রম করেছে। গণ-অভ্যুত্থান সেই ভয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পুলিশি হামলা বা গণ- আতঙ্ক আর কার্যকর নয়। ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে ঘেরাও, অবরোধ, রাজপথ প্রকম্পিত করার ঐতিহাসিক শক্তি এখন তাদের চেতনায় মিশে গেছে; তারা জানে কীভাবে জনগণের নৈতিক ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি-অবৈধ ক্ষমতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে।
এই সাহস মানে সংঘর্ষকে প্রশ্রয় নয়; বরং এর অর্থ হলো-ভীতি ও দমন আর আগের মতো কার্যকর নয়। যে-রাজনীতি নীতিহীনভাবে বুলেট বা ভয় দেখিয়ে জনগণের দাবি দমন করে, সেই রাজনীতি অনির্ধার্য সংকটে পড়েছে। এক মুহূর্তের অতিরিক্ত কর্তৃত্ব, একটি ভুল সিদ্ধান্ত বা একটি গুলিই শক্তির মসনদ ভেঙে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই এই জাগ্রত সাহস জাতির চেতনায় বিস্তার লাভ করেছে। কোনো ব্যক্তি বা দলীয় কৌশল, সাময়িক দমন চক্র বা অস্ত্রের ব্যবহার-এই শক্তিকে স্তব্ধ করতে পারবে না। যে-সরকার বা শাসক জনগণের নৈতিকশক্তি উপেক্ষা করবে, সে শিগগিরই শিখবে-ক্ষমতার মসনদ কখনো চিরস্থায়ী নয়; জনগণের নৈতিক অনুমোদন ছাড়া কোনো মসনদ টিকে থাকতে পারে না।
সরকারের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অর্জিত বিজয়:
যদিও সরকারের সীমাবদ্ধতা, গণ-অভ্যুত্থানকারী শক্তির অনৈক্য এবং রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা-শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে রূপান্তরিত করতে পারেনি, তবু অভ্যুত্থান অপরিহার্য নৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির নতুন মানচিত্র অঙ্কন করেছে। এটি প্রমাণ করে, ক্ষমতার প্রকৃত বৈধতা-অস্ত্র, অর্থ বা দখলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জনগণের নৈতিক অনুমোদন, সাহস ও ঐক্য একত্রিত হলে কোনো অবৈধ শক্তিই টিকে থাকতে পারে না; এমনকি দীর্ঘদিনের শাসকগোষ্ঠীও গণচেতনার সামনে হার স্বীকার করতে বাধ্য।
অতএব, এই বিজয় কেবল সাময়িক প্রভাব নয়; এটি রাষ্ট্রগঠন ও সমাজে নৈতিক শক্তির পুনঃস্থাপনের চিরস্থায়ী এক উদাহরণ, যা ইতিহাসের কাছে দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা:
শাসক ও ক্ষমতাধারীদের জন্য স্পষ্ট ও গভীর নির্দেশ-যদি তারা জনগণের দাবি, নৈতিকশক্তি এবং ঐক্যকে উপেক্ষা করে, তবে নতুন অভ্যুত্থানের ঢেউ তাদেরও গ্রাস করবে। গণ-অভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক বিপ্লব নয়; এটি এক নৈতিক হুঁশিয়ারি। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে কেবল তখন, যখন সেটি ন্যায়, নৈতিক অনুমোদন এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের সঙ্গে মিলিত থাকে। যারা জনগণের নৈতিক অংশগ্রহণকে অবজ্ঞা করবে, তাদের শাসন ধ্বংসাত্মক সংকটের মুখোমুখি হবে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নির্দেশ করে-রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক কাঠামো বা বাহ্যিক শক্তির মাধ্যমে পরিচালনা করা যায় না; জনগণের নৈতিক চেতনা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সামাজিক সংহতির সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে। এই একত্রিত নৈতিকশক্তিই নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, জনগণের বিশ্বাস এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক শান্তি।
বিজয়কে দীর্ঘস্থায়ী করার করণীয়:
গণ-অভ্যুত্থানের অর্জনগুলোকে স্থায়ী ও অপসারণযোগ্য নয়-এই হিসেবে রূপ দিতে হলে চারটি অপরিহার্য মৌলিক দাবি নিশ্চিত করতে হবে:-
(ক) রাজনীতি কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি জনগণের মর্যাদা, ন্যায়বোধ এবং নৈতিকচেতনার ভিত্তিতে দাঁড়াতে হবে। তবেই সংবিধানের সংস্কার এবং রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে।
(খ) রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও প্রশাসনে ঔপনিবেশিকতা ও গণবিরোধী কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। সর্বস্তরের জনগণ অর্থাৎ বিকশিত সমাজশক্তিকে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অংশীদারিত্ব দিতে হবে।
(গ) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতার জন্য আধুনিক ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন এবং ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
(ঘ) রাষ্ট্র ও সমাজে রাজনৈতিক আচরণ কেবল প্রশাসনিক কাঠামো দ্বারা নয়; নাগরিকদের নৈতিকচেতনা, অংশগ্রহণের সংস্কৃতি এবং নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার জাগরণ ঘটাতে হবে।
এসব বাস্তবায়িত হলে গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন-একটি শক্তিশালী, নৈতিক ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র নির্মাণের অগ্রদূত হিসেবে স্থায়ী রূপ পাবে। পুরনো বুদ্ধিজীবী ও দলের প্রাসঙ্গিকতা হারানো, রাজনৈতিক গুণ্ডাতন্ত্রের ধ্বংস এবং মানুষের আশা ও সাহসের পুনর্জন্ম-শুধু গণ-অভ্যুত্থানের ফলাফল নয়; এগুলো এক নৈতিক ও রাজনৈতিকশক্তির নতুন মানচিত্রের সূচনা।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক faraiæees@gmail.com

