জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা শুধু একটি নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের সামনে এসে দাঁড়াইনি; দাঁড়িয়েছি জাতির নৈতিক ও গণতান্ত্রিক শপথের মুখোমুখি। তাদের আত্মত্যাগ কেবল একটি স্বৈরশাসনের পতন ঘটায়নি, বরং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অটল দাবিকে জাগ্রত করেছে। এই দাবিকে বারবার ইতিহাসের নানা বাঁকে দমন করা হয়েছে, কিন্তু কখনো নিঃশেষ হয়নি। এই দাবি কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি একটি নৈতিক প্রতিশ্রুতি, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং মর্যাদার সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ। এই মহান উদ্দেশ্যেই প্রণীত হয়েছে জাতীয় সনদ, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ভিত্তি। এখন প্রশ্ন-এই সনদকে আইনি বৈধতা দেয়ার জন্য প্রস্তাবিত গণভোট কি জনগণের নৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটাবে, নাকি কেবল আরেকটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হবে?
ঐক্য ও অভিপ্রায়ের শক্তি
গণভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ রায় নিলে জাতীয় সনদ কেবল একটি রাজনৈতিক দলিল থাকবে না, বরং তা জনতার রায় ও শহীদদের আত্মত্যাগের বৈধতায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষ যখন একটি অভিন্ন সনদে একমত হয়, তখন তা নিছক কাগজে-কলমের ঐক্য নয়, বরং জাতির জন্য এক বিরল ঐতিহাসিক সুযোগ।
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী শক্তিগুলোর এই ঐকমত্য সুদৃঢ় হলে- দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলা করে শাসনব্যবস্থা রূপান্তরের ঐতিহাসিক এক সুযোগ তৈরি হবে। ফ্যাসিবাদকে রুখতে এটা হবে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এমন একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য অভিনন্দন, যা জনগণের অভিপ্রায়কে সামনে নিয়ে এসেছে। গণভোট অনুষ্ঠানের বাস্তবতা বিরাজমান থাকলে এই ঐকমত্য আরও শক্তিশালী হবে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণের পথে জাতি এগিয়ে যাবে।
তবে, এই ঐক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর কৌশলগত বিভাজন। গণভোট কবে এবং কীভাবে হবে-এই প্রশ্নে ভিন্নমত রয়েছে। একপক্ষ চাইছে জাতীয় নির্বাচনের দিনেই আলাদা ব্যালটে গণভোট, যা সময় ও খরচ সাশ্রয়ী। অন্যপক্ষ মনে করে- অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালে-এর আইনিভিত্তি স্থাপন করা জরুরি, যাতে গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তটি কোনোভাবেই বিলম্বিত না হয়। মতপার্থক্য শুধু সময়সূচির প্রশ্নে নয়; প্রশাসনিক সক্ষমতা, ভোটার সচেতনতা এবং ফলাফলের বৈধতা-সবকিছুর সঙ্গেই তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ?রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় বিভাজন ও অনৈক্যের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, জাতীয় সনদ এবং শাসনব্যবস্থাকে হস্তান্তর না করে রূপান্তর করার নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করলে তা হবে খুবই প্রশংসনীয়। এই নৈতিক অবস্থানই গণভোটকে কেবল একটি কৌশল থেকে জনগণের অভিপ্রায় পূরণের প্রতিশ্রুতির দিকে চালিত করতে পারে।
গণভোটের তাত্ত্বিক ও আইনিভিত্তি
গণভোট হলো-সরাসরি গণতন্ত্রের একটি শক্তিশালী রূপ, যার মাধ্যমে জনগণ সরাসরি নীতি বা আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। তবে, এখানে একটি বড় সংকট রয়েছে। আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থা হলো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। যদি, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় সংসদের সিদ্ধান্তের বিপরীত হয়, তাহলে এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে এক ধরনের সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। এই সংকটকে আমরা ‘গণতান্ত্রিক বৈধতার দ্বৈততা’ (Duality of Democratic Legitimacy) হিসেবে অভিহিত করতে পারি। তাই সরাসরি জনরায় ও প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব নিরসন না হলে, গণভোট গণতন্ত্রকে শক্তিশালী না করে বরং অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। গণভোটের ফলাফল সাংবিধানিকভাবে কী করে সুরক্ষিত থাকবে-তা সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করা অপরিহার্য। এই আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো সম্পূর্ণ স্বচ্ছ না হলে, গণভোট জনগণের আকাঙ্ক্ষার নৈতিক প্রতিশ্রুতি না হয়ে, নিছক রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার খেলায় পরিণত হবে। ফলাফলকে আইনি বাধ্যবাধকতা এবং সুস্পষ্ট সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে পারলেই কেবল গণভোটের নৈতিক বৈধতা নিশ্চিত হবে।
রাজনৈতিক দলের নৈতিক চুক্তি
জাতীয় সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে, যা নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এই চুক্তি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা দৃঢ় করবে এবং সুশাসনের ভিত্তি গড়ে তুলবে। এটি, চুক্তিকে শুধু একটি নথিবদ্ধ প্রতিশ্রুতিতে নয়, বাস্তব পরিবর্তনে রূপান্তরিত করবে।
জনগণের সচেতনতা
গণভোটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনগণের সচেতনতা। জনগণকে অবগত করতে হবে-সনদের সারবস্তু কী, গণভোটের প্রশ্ন কী এবং এর ফলাফল কী প্রভাব ফেলবে। বিভ্রান্ত বা অজ্ঞ ভোট গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করতে পারে না। গণভোট সফল করতে হলে রাষ্ট্রকে একটি বিস্তৃত জনসচেতনতামূলক অভিযানে নামতেই হবে। বিশেষ করে, অতীতে গণভোটকে সামরিক শাসনের বৈধতা দেয়ার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এতে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। বর্তমান গণভোটের প্রস্তাবকে সেই অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা করে জনগণের কাছে এর নৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
সূচনার শুরু, সমাপ্তি নয়: জুলাই সনদ ও প্রস্তাবিত গণভোট শহীদদের আত্মত্যাগের উত্তরাধিকার বহন করে। তাদের রক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়-রাষ্ট্রযন্ত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষার রূপান্তর না ঘটলে, সত্যিকার অর্থে জনগণের অভিপ্রায় পূরণের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই, এই গণভোট কোনো সমাপ্তি নয়; এটি কেবল সূচনার শুরু। গণতন্ত্র, ন্যায় ও মর্যাদার পথে দীর্ঘ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। তবে, এটি তখনই কেবল সফল হবে, যখন সকল রাজনৈতিকপক্ষ একে নিছক একটি কৌশল হিসেবে না দেখে, জাতির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবে দেখবে এবং একটি নৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে গ্রহণ করবে।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক faraizees@gmail.com