খতিব মাওলানা উবায়দুল হক রহ. : স্মৃতিতে অম্লান

প্রবন্ধ-কলাম সিলেট
শেয়ার করুন

ইমরানা হক (বেবী)

জীবনের চলার পথে বেশ ক’টি বছর পার করে যখন এসেছি, পেছনে ফিরে দেখি শুধু শূন্যতা আর পৃথিবী থেকে অনেক আপনজনের চলে যাওয়ার দুঃখ। এর পরও আল্লাহ দরবারে শুকরিয়া যে, তিনি আমাকে এমন বাবার ঘরে জন্ম দিয়েছেন।

১৯২৮ সালে সিলেটে জেলার জকিগঞ্জ থানার বারঠাকুরীতে জন্ম নিয়েছিলেন যে ছেলে, কালক্রমে তিনি আমার বাবা মরহুম মাওলানা উবায়দুল হক, বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব। ২৪ রমজান, ৬ অক্টোবর, ২০০৭ সালে শনিবার তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বিশ্বাস হচ্ছিল না বাবার এই চলে যাওয়া, বেদনাদায়ক সংবাদের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে, তবে কিছু কিছু মৃত্যু এমন আছে যা ব্যক্তি, জাতি, ও পৃথিবীর শেকড় শুদ্ধ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। আমৃত্যু ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন তা এ দেশের মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। বাবার বর্ণাঢ্য জীবনের কোন দিকটির চেয়ে কোনটি বেশি আলোচ্যের, আমি তা নির্ণয় করতে পারছি না তাই নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব না।

বাবা ১৯৫৪ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ঢাকার সরকারি আলিয়া মাদরাসায় যোগদান করেন। আর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত থেকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি জাতীয় শরিয়াহ কাউন্সিল, ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় মসজিদের খতিবের দায়িত্বের পাশাপাশি বহু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, ইরান, কুয়েত, মরক্কো, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন।

জীবনে তিনি ছিলেন সব মহলে সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র, মরণেও তিনি তা পেয়েছেন। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে বাবার জানাজায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, তথ্য ও আইন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ, ঢাকার তৎকালীন মেয়র, দেশের শীর্ষ আলেম-ওলামা, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি বাবার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে একজন মানুষ ছিলেন, সঙ্কীর্ণতা কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। স্পষ্টবাদিতা ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

তিনি ছিলেন কোমলে-কঠিনে গড়া, প্রচারমুখী বহু কাজে যুক্ত থেকেও তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ, তার মাঝে কোনো অহঙ্কার ছিল না। কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ ছিল পূর্ণ মাত্রায়। বাবার এক ঘনিষ্ঠজনের লেখায় জানতে পারি, কোনো এক হজের সফরে গিয়ে মহান আল্লাহ দরবারে মুনাজাতে তিনি নিজের জন্য ৮০ বছর হায়াত চেয়েছিলেন। মানুষের জীবনে ৮০ বছর বয়স পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সেই মৃত্যুই বাবাকে স্পর্শ করে তার ৮০ বছর বয়সে। কঠিন কোনো অসুখ হয়নি, কিন্তু তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তার সময় শেষ হয়ে আসছে। তাই তো তিনি ৮০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বারঠাকুরীর পৈতৃক সম্পত্তি মাদরাসা ও মসজিদের নামে ওয়াক্ফ করে দেন এবং নিজের বাকি সম্পত্তি ইসলামী আইন অনুসারে দুই স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। বিস্ময়কর এক ঘটনা! বাবার বসার ঘরের দেয়ালে বড় ছকে আঁকা সোনালি ব্যাংকের একটি ক্যালেন্ডার ছিল, যেটিতে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও সফরের বিবরণ নিজ হাতে তিনি লিখে রাখতেন। এমনকি অনেক আগের সব লেখা থাকলেও বাবার ইন্তেকালের পরবর্তী কোনো তারিখ ক্যালেন্ডারের কোথাও ছিল না। তবে ভাববার বিষয়, ২৪ রমজানের মৃত্যুর সাত-আট দিন পরের একটি প্রোগ্রামের তারিখ লেখেন, কিন্তু নিচে কলম দিয়ে বড় করে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে রাখেন!

মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে তার কবরের ব্যাপারে বলেন। প্রথম পছন্দ ছিল সিলেটের হজরত শাহজালাল রহ.-এর পাশে, দ্বিতীয় পছন্দ ছিল আজিমপুরে পীরজি হুজুরের কবরের পাশে। যে স্থানে বাবার দাফন হয়েছে সে স্থানে কোনো কবরের জায়গা থাকার কথা না কিন্তু খবর নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত সেখানে কোনো ব্যক্তিকে দাফন করা হয়নি। পীরজি হুজুরের কবরের তিন-চারটি কবরের পরেই বাবার কবরের ব্যবস্থা করা হয়।

তিনি বিদায় নিয়েছেন রমজান মাসে, সারাদিন রোজা রেখে ইফতারের পর খাঁটি ঈমানদার হিসেবে মৃত্যুর আগের জুমার খুতবায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজকে এত মুসল্লী দেখে মনে হচ্ছে, আজই জুমাতুল বিদা। বাস্তবে এর পরও ঈদের আগে আরেকটি জুমা ছিল। কিন্তু তার জন্য এটিই ছিল দীর্ঘ দুই যুগের বিদায়ী জুমা। কুরআনের ভাষ্যে বোঝা যায়, যখন আল্লার কোনো প্রিয় বান্দার ইন্তেকাল হয় তখন আকাশও ক্রন্দন করে। ওই সময় খরা ছিল, প্রচণ্ড গরমে মানুষ দিশেহারা, কিন্তু সেদিন জানাজার কিছু আগে থেকেই আকাশে মেঘ জমতে থাকে, ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায় পুরো জামাতের ওপর দিয়ে। জানাজা শেষ হওয়া মাত্রই আকাশ ভেঙে পড়ে, এ যেন এক আলেমের বিদায়ের কান্না। তিনি এখন সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন।

বাবা অনেক কাজের ভিড়েও তোমাকে ভুলিনি, তোমাকে স্মরণ করি শব্দহীন রাতে, এটিই আমার একান্ত সময় তোমাকে নিয়ে ভাববার। তুমি চলে যাওয়ার পর প্রতি রাতে তোমার সাথে একাকী কথা বলি, তুমি কি শুনতে পাও? তুমি ছাড়া এ জীবনে চলা খুবই কঠিন। সুবিশাল এই পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মানুষের চলে যাওয়া কারোই কাম্য নয়। আজো তোমার অনুপস্থিতিই সবচেয়ে বেশি অনুভব করি।

এখন তোমার জন্য দোয়া করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই, তাই দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, আর আমাদের ধৈর্য ও সবুর দেন, আমিন।

লেখিকা : মরহুম খতিবের মেয়ে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *