কুরআনের প্রধান বিষয় হচ্ছে মানুষ । ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

ধর্ম ও দর্শন প্রবন্ধ-কলাম
শেয়ার করুন

মহান আল্লাহর কিতাব আল কুরআনের মতো আর কোনও গ্রন্থ মানুষের ঘরে ঘরে নেই। কুরআন যে পড়া হয় না এমনও নয়। পড়া হয়। এমনকি মুখস্থও করা হয়। এক হিসাব মতে পৃথিবীতে কুরআনের হাফিজ রয়েছেন প্রায় সাত কোটি। প্রতিদিন হাফিজের সংখ্যা বাড়ছে। কাজেই কুরআন মানুষ পড়েন না, এমন ধারণা ঠিক নয়। পড়েন। তবে সে-অনুপাতে আমল করেন না।

হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় আল্লাহর নবী (স) এর কাছে প্রথম যে ওহি নাযিল হয় তা ছিল: ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক অর্থাৎ পড় তোমার স্রষ্টার নামে। তার মানে কুরআনের প্রথম কথাই হচ্ছে “পড়”। পড় বা পাঠ কর। কুরআনের এ কথা থেকেই বোঝা যায় লেখাপড়ার প্রতি ইসলামের গুরুত্ব কতটা। অথচ পৃথিবীর কোনও কোনও ধর্মগ্রন্থ বিশেষ শ্রেণির মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের পড়া বা পাঠ নিষিদ্ধ। ওই শ্রেণি ছাড়া কেউ পড়লে বা শুনলে কঠোর শাস্তির কথাও বলা হয়েছে।

কুরআন এমন একখানি আসমানি কিতাব যাতে বিন্দু-বিস্বর্গ তথা জের-জবর পর্যন্ত কোনও ভুল নেই। বিভ্রান্তি নেই। প্রায় দেড় হাজার বছর অবধি হাজার হাজার কোটি কোটি এর কপি ছাপা হয়েছে। কোনও কপিতে অমিল নেই। ভুল নেই।

এ কিতাবের শুরুতেই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, জালিকাল কিতাব, লা রাইবা ফিহি; হুদাল্লিল মুত্তাকিন। অর্থ: এটি এমন কিতাব যাতে কোনওপ্রকার ভুলভ্রান্তি নেই। এ হচ্ছে মুত্তাকিদের জন্য জীবনযাপনের বিধান।

পৃথিবীর যেখানেই কুরআন ছাপা হোক না কেন, এর সবকপি এক রকম হবে অনিবার্যরূপে। ব্যতিক্রম হবার কোনও উপায় নেই। এখন অবশ্য সৌদি কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রেসে অতি যতেœ কুরআন ছেপে পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছেন। সত্যি বলতে কী এও এক আল্লাহর কুদরত।

কুরআন এমন একখানি কিতাব যার কোটি কোটি হাফিজ রয়েছেন। এমনকি ছয়-সাত বছরের শিশুও সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করে ফেলতে পারে। পৃথিবীতে আর কোনও গ্রন্থের হাফিজ রয়েছে কি? নেই। এমনকি কুরআন ব্যতীত বাকি যেসব আসমানি কিতাব ছিল সেগুলোরও হাফিজ নেই। এ ছাড়া সেগুলো বিক্ষিপ্ত, বিকৃত এবং প্রক্ষিপ্ত।

কুরআনের পাঠন-পঠন চলছে পৃথিবীর অনেক দেশে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এমনকি অনেক অমুসলিমও স্বেচ্ছায় এর পাঠগ্রহণ করছেন। কেউ কেউ এর ত্রুটি খুঁজতে এসে আল্লাহর কুদরতে কালেমা পড়ে জীবনের দর্শনই পালটে ফেলছেন অবলীলায়। কী এমন মোহ লুকানো রয়েছে আল্লাহর কুরআনে!

কুরআনের পঠন-পাঠন আমাদের দেশেও আছে। মক্তব থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কুরআন পড়ানো হয়। তবে এর বিধান মেনে চলবার প্রবণতা খুব কম। সালাত-সিয়াম ইসলামের অপরিহার্য বিধান হলেও এর ব্যাপকতা আরও বিস্তৃত। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর নির্দেশনা রয়েছে কুরআনে।কুরআনের ছাপা কপির অস্তিত্ব এখন থাকলেও কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, মোবাইল, সিডি সবকিছুজুড়ে এখন কুরআনের আধিপত্য। আর কিছুদিন পর কাগজে মুদ্রিত কুরআনের প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে যাবে।

যাই হোক, ছাপা কুরআন যেমন এখন মুসলিমদের ঘরে ঘরে আছে। তেমনই এর সফটওয়্যার কপিও প্রায় মুসলিমের ঘরে ঘরে স্থান করে নিয়েছে। তবে ছাপা কুরআন যেমন ঘরের তাকে মুসলিমরা ফেলে রেখেছে, তেমন কুরআনের সফটওয়্যার কপি, সিডি এসবও যে অব্যবহৃত রেখে দেবে না তা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে?

কাগজে ছাপা কুরআনের কপি মুসলিমরা কীভাবে তাকে রেখে দেন, বছরের পর বছর সেটা নেড়েচেড়েও দেখেন না তার একটা উদাহরণ পেশ করতে চাই। সেটা হচ্ছে:

একটা গ্রামের একটি মসজিদে এক যোগ্য ইমাম নিযুক্ত করা হলো। গ্রামবাসীরা নির্ধারণ করে যে, পবিত্র রমাযান মাসে ইমাম সাহেব একেকদিন একেক বাসায় ইফতার করবেন।

সেই হিসাবে একদিন একটি বাসায় ইফতারের দাওয়াতে ইমাম সাহেব অপেক্ষায় ছিলেন।

পরিবারটি দরিদ্র ছিল। ভেতরের ঘরে স্বামী-স্ত্রী ইফতারের খাবার তৈরি করছিলেন।

ইফতার সেরে ইমাম সাহেব চলে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারেন যে, তাঁদের ঘরে কিছু টাকা ছিল যা পাওয়া যাচ্ছে না।

ইমাম সাহেব যেখানে বসে ছিলেন ঠিক তার পাশেই টাকাগুলো ছিল।

ইমাম ছাড়া বাসায় আর কেউ আসেনি।

“ইমাম সাহেব টাকা চুরি করেছেন!” এমন কথা ভাবতেই তাঁরা উভয়ে লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পড়েন!

খুব স্বাভাবিকভাবে এ ঘটনার পর থেকে তাঁরা ইমাম সাহেবকে অপছন্দ করা শুরু করেন। টাকা চুরির ঘটনা তাঁরা কাউকে বলতেও পারছিলেন না।

এরপর থেকে ভদ্রলোক ইমাম সাহেবকে এড়িয়ে চলতেন। সালাম দিতেন না। মসজিদে গেলেও দূরে সালাত আদায় করে চলে যেতেন।

তাঁদের অন্তরে ইমাম সাহেবের প্রতি জন্মেছিল তীব্র ঘেন্না।

এভাবে চলতে চলতে প্রায় এক বছর কেটে যায়।

আবার রমাযান মাস ফিরে আসে।

গতবারের মতো আবারও সিদ্ধান্ত হয় যে, ইমাম সাহেব একেকটি বাসায় একেক দিন ইফতারগ্রহণ করবেন।

সে হিসাবে কোনও একদিন সেই একই লোকের বাসাতে ইমাম সাহেবের ইফতারের দাওয়াতের তারিখ পড়ে।

কিন্তু সেই স্বামী-স্ত্রী এটা মেনে নিতে পারছিলেন না যে, তাঁদের বাসাতেই একজন “চোর ইমাম”কে সম্মানের সঙ্গে ইফতার খাওয়াতে হবে!

অবশেষে স্ত্রী তাঁর স্বামীকে বোঝালেন, “হয়তো তখন ইমাম সাহেবের টাকার অনেক দরকার ছিল। তাই তিনি নিয়েছেন টাকাগুলো। থাক তুমি ভুলে যাও। তাঁকে ক্ষমা করে দাও।”

স্ত্রীর কথা স্বামী মেনে নিলেন এবং আবারও ইফতারের আয়োজন করলেন।

কিন্তু এবার ইমাম সাহেব তাঁর দূরদৃষ্টি থেকে বুঝতে পারছিলেন যে, ভদ্রলোক কোনও বিষয়ে হয়তো স্বস্তি পাচ্ছেন না।

ইফতারশেষে তিনি জানতে চাইলেন, “কোনও সমস্যা?”

গৃহকর্তা আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন গত বছরের টাকা চুরির কথা।

গৃহকর্তা ইমামকে বললেন, “আপনি এ ঘরে একা বসে ছিলেন আর আমরা ভেতরে ইফতার বানাচ্ছিলাম। সেদিন আর কেউ বাসায় আসেনি।

ইফতার করে আপনি চলে গেলেন এবং তারপর থেকেই আমরা টাকা পাচ্ছিলাম না।”

তিনি আরও বললেন যে, সেই টাকা হারাবার পর থেকে তাঁরা তাঁকে সম্মানের চোখে দেখতে পারছেন না। সন্দেহ করছেন। অস্বস্তিতে ভুগছেন।

ইমাম সাহেব সব শুনছিলেন এবং তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ছলছল করছিল।

ইমাম প্রশ্ন করলেন, “কেন আপনি আমাকে এতদিন কথাটা বললেন না?”

গৃহকর্তা বললেন, “কীভাবে বলি? আমরা তো লজ্জায় কাউকে কিছুই বলতে পারিনি!”

গৃহকর্তা প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি আমাদের টাকা নিয়েছেন?”

ইমাম সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হ্যাঁ, আমি ওই টাকা নিয়েছিলাম।”

ইমাম সাহেবের মুখে কথাটা শুনতেই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যারপরনেই অবাক হয়ে গেলেন!

ইমাম সাহেব এবার বললেন, “আপনারা যখন ভেতরের ঘরে ইফতারের আয়োজন করছিলেন, আমি একা বসেছিলাম। এক পর্যায়ে আমি দেখেছি আপনাদের টাকাগুলো ওইখানে ছিল। হঠাৎ ওই খোলা জানালাটা দিয়ে বাতাস আসে আর টাকাগুলো উড়ে এদিকসেদিক এলোমেলো হয়ে যায়। টাকাগুলো কুড়িয়ে হাতে রাখি যেন আপনি আসা মাত্রই দিতে পারি। কিন্তু আমি দেখলাম সামনেই ওই কুরআনটা ছিল, যেটা এখনও আছে। আমি ওই কুরআনের ভেতর টাকাগুলো রেখে দেই।”

তারপর ইমাম সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি এ জন্য কাঁদছি না যে, আমাকে টাকা চোর বলা হয়েছে। বরং আমি এ জন্য কাঁদছি, বিগত পুরো একটি বছরেও আপনাদের দুজনের কেউ একটিবার কুরআনটা খুলে পড়েননি। আপনারা কুরআন ভুলে গেছেন। কুরআন পড়া ছেড়ে দিয়েছেন।”

তিনি আরও বললেন, “আপনাদের কোনও একজন কুরআনটা অন্তত একবার ধরলেই টাকাগুলো পেয়ে যেতেন।”

এরপর ইমাম সাহেব রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন এবং বললেন, “অবশ্য আমারই উচিত ছিল আপনারা কুরআন নিয়মিত পড়েন কিনা। পড়তে পারেন কিনা, এটা জিজ্ঞেস করা। এটা আমার দারুণ গাফলতি হয়েছে।”

হ্যাঁ, আমরা এভাবেই পবিত্র কুরআন ঘরের তাকে রেখে দেই বছরের পর বছর। পড়ি না। আল্লাহর কিতাবের প্রতি নজর দেই না। কুরআনের সিডি ইত্যাদিও হয়তো পড়ে থাকবে। কেউ চালাবে না। অথচ কুরআন একটি নিত্যপাঠ্য কিতাব। এর প্রতিটি শব্দ ও আয়াতে মানুষের অশেষ অফুরন্ত কল্যাণের কথা রয়েছে। জীবন সুন্দর করবার নির্দেশনা দেয়া আছে। ইহ-পারলৌকিক কল্যাণের বারতা বিবৃত হয়েছে প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে। অথচ আমরা এর প্রতি উদাসীন! পবিত্র কুরআনের প্রধান বিষয় হচ্ছে মানুষ। মানুষের সার্বিক কল্যাণের কথাই বলা হয়েছে সমগ্র কুরআনে। অথচ খুব কম মানুষের মনোযোগ এর প্রতি।

আরও পড়ুন
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স; প্রয়োজন সতর্কতা
দেহকে সুস্থ রাখবে অ্যালোভেরা
বসন্তের বাতাসে অ্যালার্জির প্রবণতা, একটু গাফিলতি হলেই মারাত্মক বিপদ
রাসূল সা: প্রবর্তিত খাদ্যবিজ্ঞান । ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যে খাবারে শিশুর উচ্চতা বাড়ে
ইন্ডাস্ট্রির সকলের স্বার্থে কপিরাইটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিঃ ফাহিম ফয়সাল
অতিরিক্ত আবেগ মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি
ওজন কমাতে সাহায্য করে যে সকল খাবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *