কবি ও সৌন্দর্যের জগৎ ।। জাকির আবু জাফর

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সেটিই সুন্দর যা দেখে দৃষ্টি জুড়ায়! যা অনুভব করে মুগ্ধ হয় মন। তৃপ্ত হয় হৃদয়ের চারিধার। যা একবার এবং বারবার দেখতে ইচ্ছে হয়। যা দেখে মন ধরে রাখে তাকে। যার স্মৃতি ভুলতে চায় না কেউ। এবং যা মানুষ আগ্রহের আনন্দে গ্রহণ করে তা- ই সুন্দর।

সুন্দরের কাছেই ছুটে যায় মানুষ। ছুটে যায় প্রবল আকর্ষণে। পাওয়ার ইচ্ছে করে তাকে। নিজের জীবনের জড়িয়ে নিতে চায়। জীবনকে জাগ্রত রাখতে চায় সুন্দরের সান্নিধ্যে। তাই সুন্দরের দিকে মানুষের আজীবন পক্ষপাত। তাকে পেলে ভীষণ খুশি। না পেলে বাড়ে পাওয়ার তৃষ্ণা। হারালে আফসোস করে খুব। হারিয়ে পেলে খুশির সীমা থাকে না।

বিশ্ব জগতের অঙ্গে লেপে আছে সৌন্দর্য। ছড়িয়ে আছে বিচিত্র রঙের লীলা। পাতায় পাতায় তার নকশা। ফুলে ফুলে তারই মুখ। ফলে ফলে তারই দৃশ্য। দিগন্ত বিশারি ফসলের শরীরে জড়ানো রূপের বাহার!

পাহাড় ও সাগরের সান্নিধ্যে সৌন্দর্য হয়ে ওঠে অনন্য। বনের গহনে ছড়ানো সুন্দরের ছটা। আমাদের চারপাশে তারই প্রাণময় উৎসব! মানুষ সুন্দর খোঁজে। সুন্দর তালাশ করে বেড়ায়। চলতে চায় সুন্দরের সাথে। বলতেও চায় তেমন করে। দৃষ্টির প্রতিটি বাঁকে চায় সুন্দরের উপস্থিতি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো পৃথিবীতে এতসব সুন্দরের শরীরে ভাষা দিয়েছেন কারা ? কারা একে মানুষের বোধগম্য করেছেন! জবাবটি সহজেই বলা যায় – কবিরা। কবিরাই সুন্দরের দিকে ফিরিয়েছেন মানুষের দৃষ্টি। কবিদের ভাষার সুষমায় প্রকাশ পেয়েছে সুন্দর! কবিগণ সুন্দরের কৃষক। তারা সুন্দর চাষ করেন। ফসল ফলান সুন্দরের। সুন্দরকেই লালন করেন। যত্নে রাখেন সুন্দরের সুখ।
কবিগণ ভাষা না দিলে সুন্দর প্রকাশে ভাষা দিতো কারা। কারা বলতো ফুলের রঙের খবর। কারা দিতো গন্ধের আনন্দ উত্তাপের খবর! তাই এ কথা বলতে দ্বিধা নেই – কবিরাই খুলে দেন সুন্দর জগতের দরোজা।

এখন কেউ যদি বলেন কবিগণ কীভাবে খুলে দেন সৌন্দর্যের জগৎ! এর জবাবও সহজ – তারা খুলে দেন ভাষার আনন্দে। খুলে দেন শৈল্পিক শব্দের কুশলতায়! এবং খুলে দেন নান্দনিক ভাষার ঔদার্যে। আমরা জানি- সুন্দরকে প্রকাশ করতে হয় সুন্দর দিয়েই। অসুন্দর দিয়ে সুন্দরের ব্যাখ্যা চলে না। তাই সুন্দর প্রকাশে ভাষাও চাই সুন্দর! চাই উত্তম ভাষার উপহার। খানিক উপমা দিয়েই বলি- ধরুন আকাশের কথা –

সবার চোখ কি আটকে থাকে আকাশের গায়ে! সবাই কি ভাবেন কেনো আকাশ এতো ডুবে থাকে মৌনতার গাম্ভীর্যে! কোটি বছর ধরে কেনো এতো চুপচাপ দাড়িয়ে। কেউ কি নীরবে একাকী দেখে আকাশের রঙ! কে দেখে এতো রঙের খেলা। কেনো রঙের এত খেলা খেলতে থাকে বিরাট আকাশ! ভাবে কি আকাশের গায়ে এতো নীল! এতো গাঢ নীলান্ত নিঃসীম! কেমন করে আকাশের বুকে জমজমাট হয় মেঘের পাল। কেমন করে মেঘ থেকে নামে বৃষ্টির ধারা!

বৃষ্টি মেঘের কোলে হঠাৎ চমকে ওঠা বিদ্যুৎ নিয়ে কে ভাবে! বজ্রের বিকট ধ্বনি নিয়ে ভাবনা জাগে কার বুকে! কে দেখে নিস্তব্ধ রাত্রির আকাশ! অন্ধকারের পোশাক পরানো রাতের আকাশে নক্ষত্রের মেলার দিকে কে তাকায়। কে দেখে চাঁদের হৃদয় থেকে ঝরা দ্যুতির রঙ! পূর্ণিমার দুধ সাদা জোছনার প্লাবনে কে সাঁতার কাটে!

আকাশের গায়ে ছড়িয়ে পড়া ছায়াপথের কথা জাগে কারো ভাবনায়! খুঁটিবিহীন মস্ত এ আকাশকে কল্পনায় মনের মধ্যে তুলে আনার সাহস কার হয়! কোনো কবি এবং কাব্যরশিক ছাড়া আকাশ নিয়ে এমন করে ভাবেন কেউ! নাকি ভাববেন কখনও। জবাবে বলতেই পারি- না। এমন করে ভাবেন না কেউ। ভাববেনও না। তাহলে? তাহলে হিসাবটি সহজ – ভাবেন কবিরাই।

কবিদের দৃষ্টিই আকাশের বিস্ময় সুন্দর আবিষ্কার করে। তাতে ভাষা জোগায়। সে ভাষা হয়ে ওঠে মানুষের আগ্রহের। অবশ্য হেসে উড়িয়ে দেবার মানুষও কি নেই! নিশ্চিত আছে। সস্তা বলে উপহাস করার লোকও কি নেই! নিশ্চয় আছে। ছিলো অতীতেও। ভবিষ্যতেও থাকবে। থাকুক। কিন্তু সত্য সত্যই। এই সত্যের রূপও সুন্দর ছাড়া আর কিছুতেই মানায় না।

কেউ বলতেই পারেন- এক আকাশ নিয়ে এতো জিজ্ঞাসা! এতো প্রশ্নের জবাব কে দেবে! কেমন করে দেবে! হ্যা দেবে। খুব সহজ করে জবাব দেবে এর! কে দেবে? কারা দেবে? কবি দেবেন। কবিরা দেবেন।

খুব বিস্ময় জাগে বুঝি! না বিস্মিত হবার কিছু নেই। একজন কবির কাছে এসকল জিজ্ঞাসারই অতি সহজ জবাব আছে। একজন কবি তিনি নিয়ত আকাশে চোখ রাখেন। আকাশে বিচিত্র রঙের খেলার তিনি দর্শক! শুধু কি দর্শক! না। তিনি সেই বিচিত্র রঙের বিস্ময় জাগানিয়া সৌন্দর্যের বর্ণনাকারী। ভাষার অসামান্য লালিত্যে তিনি বিরাট আকাশের শৈল্পিক সৌন্দর্যের রূপ চিত্রিত করেন। তিনি দেখিয়ে দেন- ভোরের আকাশ কেমন করে রক্তজবার মতো রাঙা হয়ে ওঠে। মুহূর্তে মুহূর্তে কীভাবে বদল হয় রঙের লালি। সন্ধ্যার আকাশ কেমন করে হয়ে ওঠে পলাশের প্রান্তর!

তিনি বর্ণনা করেন- গভীর রজনীর বুকে একা চাঁদটি কীভাবে তার জোছনা ঢালে পৃথিবীর দিকে। গোটা বিশ্ব প্রকৃতি ঘুমিয়ে যায়। চাঁদটিই জেগে থাকে একাকী। একাই বিলিয়ে যায় তার বুকের আলো। যখন চাঁদ থাকে না?

হ্যা তখনও সৌন্দর্যের এক লীলাময় রূপ জেগে থাকার দৃশ্য বর্ণনা করেন কবিই। তিনি জগতকে দেখিয়ে দেন – তারকার রূপালি রূপ! কেমন করে ঝিকিমিকি জাগ্রত তারা। কেমন করে ঝিলমিল হয়ে জ্বলে সারারাত। আরও দেখিয়ে দেন – অন্ধকারের সৌন্দর্য! দেখান কীভাবে অন্ধকার হয়ে ওঠে জ্যোতির্ময়!

বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের নয়নাভিরাম দৃশ্যের ভাষা কবিরাই জোগান। ধানের মাঠে বাতাসের ঢেউয়ের ভাষা কে বলে কবি ছাড়া। প্রজাতির ঝাঁক বেঁধে চলা। কিংবা তার রূপের রহস্য বিশদ করার ভাষা কবিরাই তো নির্মাণ করেন। মৌমাছির মৌচাকের দৃশ্য! বাবুই পাখির বাসার শিল্প এবং পিঁপড়ের সমাজের ভাষা কবি না দিলে কে দেবে?

মানুষের স্বপ্নের ভাষাও কবিদেরই। কল্পনার জগৎও বর্নিত হয় কাব্যিক আনন্দে! এভাবেই জগতের সকল সুন্দরের দিকে ইংগিত করেন কবি। একজন কবির কাছে সুন্দর ভাষা পায়। কবিই বলেন – কীভাবে দেখতে হয় সুন্দর! কীভাবে গ্রহণ করতে হয়। কীভাবে যেতে হয় সুন্দরের কাছে। কীভাবে নিতে হয় সুন্দরের সৌরভ।

কবিই খোলেন জগৎ- সৌন্দর্যের গোপন দরোজা। খোলেন তার মনোরম ভাষার আনন্দে। কবি-ই দেখিয়ে দেন বিশ্ব জগতের নিপুণ সুন্দর! এই বিশ্ব- সুন্দরের ভাষা দিতেই কবিদের সৃষ্টি করেছেন মহান রব!

* জাকির আবু জাফর কবি ও কথাশিল্পী, সাহিত্য সম্পাদক- দৈনিক নয়াদিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *