কবি আসাদ চৌধুরী : আলোকিত রাহবার

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

নাসিম আহমেদ

কবি আসাদ চৌধুরীর (১৯৪৩-২০২৩) ব্যক্তিত্বের যে গুণগুলো আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো তা হলো তাঁর সহজ-সাধারণ প্রকাশ, আত্মীয়রূপ, উপকারব্রতী, সৃজনশীল কাজে তরুণদের উৎসাহদান এবং প্রেমময় মধুর আলাপচারিতা। এক প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং সমীহ তাঁর প্রতি আমি অনুভব করেছি বহু বছর ধরে এবং তা কেবলই লাবণ্য ছড়িয়েছে। ‘তবক দেওয়া পান’-এর বিহ্বলতা আমার রয়েই গেছে।

সেই ১৯৭৫ সালে আমার কিশোর বেলায় কিনেছিলাম ‘তবক দেওয়া পান’ প্রথম সংস্করণ খুলনা থেকে। আমরা তখন খুলনায় থাকি, বাবার কর্মস্থলে। বইটি এখনো আছে আমার সযত্নে সংরক্ষণে। বইয়ের ‘সত্য ফেরারী’ কবিতার জিজ্ঞাসা আমার ভালো লেগেছিলো এবং এখনো আমাদের ভাবিয়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে জাতীয় জীবনের অনেক প্রত্যাশা হরণ করে নেয় সর্বগ্রাসী অসত্য দুরাশার কুহুক। তখন থেকেই লড়াইটা অসত্যের বিরুদ্ধে। কবি আসাদ চৌধুরী তারই ইঙ্গিত করেছেন ‘সত্য ফেরারী’ কবিতায়।

তাঁর কবিতার সাথে পরিচয়ের অনেক পরে সত্তর দশকের শেষের দিকে তাঁকে আমি পাই বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানমালায়। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর বিশুদ্ধ উচ্চারণে দরদ দিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন, কখনো আবৃত্তি করছেন। এই প্রথম একজন কবির সন্ধান পেলাম যিনি অসম্ভব সুন্দর আবৃত্তি করেন। জেনেছি, কবি ফররুখ আহমদ, কবি শাহাদাৎ হোসেন চমৎকার আবৃত্তি করতেন রেডিওতে মঞ্চে। কিন্তু আমার শোনার সৌভাগ্য হয়নি।

আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠের দানাদার আওয়াজে শব্দগুলো কড়কড় করে বেজে উঠতো পুরুষালি বলিষ্ঠতায়। চলনে বলনে ভূষণে তিনি প্রকৃত সাধারণ এবং এটিই তাঁর স্টাইল, অহংকারের লেশমাত্র নেই–এলোমেলো বেখেয়ালি। পাজামা-পাঞ্জাবি, কখনো প্যান্ট-পাঞ্জাবি, কাঁধে সমসময়ের ঝোলা এবং শীতের দিনে আরেক কাঁধে চাদর, পানের রসে রঙিন ঠোঁট একটু পরপর ঝোলা থেকে পান বের করে মুখে পুরে দিচ্ছেন সদা গাল্পিক প্রাণময় মায়াময় আড্ডাবাজ কবি।

বাহির তাঁকে পাগল করে রাখে। ‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে যেমন লিখেছিলেন–“আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, হয়তো সবটা দেহ কোনদিন ঘরে ফেরেনি। এটা আমি আগে টের পাইনি, আর পেলেই বা কী হতো? চিকিৎসার জন্য আমি তো আর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না সাহানা, তোমার কাছেই এসেছি। এবার দ্যাখোতো, আমার শরীরের কিছু অংশ বাইরে কোথাও ফেলে এলাম কি না?”

তিনি স্বল্পতম পরিচয়ে যে কারো অভিভাবক হয়ে যান অনায়াসে, রাখ-ঢাক নেই চাওয়া পাওয়া নেই, যে কোন ভাল কাজে নিঃসঙ্কোচে হাজির হন কোন কিছুর পরোয়া না করেই। আমাদের দেশের গোমরামুখো অতি-হিসাবি বিদ্বৎসমাজ থেকে তিনি একেবারেই ভিন্ন।

আসাদ চৌধুরী গণমুখি। তাঁর এই বিশিষ্টতা আমার ভালো লাগার কারণ। বোধকরি আমাদের সময়ের সকল তরুণ-তরুণির কাছে আসাদ চৌধুরীর গ্রহণ-গ্রাহ্যতার এটি বড় কারণ তাঁর গণমুখিতা।

আশির দশকের প্রথম দিকে ১৯৮২ সালে আমরা ডাকসুর পরিচালনায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দল’ গড়ে তুলি। পারফর্মিং আর্টের অনেকগুলো বিভাগ নিয়ে তৈরি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দল। আমি পরিচালনা করতাম আবৃত্তি ও উপস্থাপনা বিভাগ। আবৃত্তি আন্দোলন ও শুদ্ধ উচ্চারণ বেগবান করতে আমরা সচেষ্ট ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলের সিদ্ধান্ত হলো, দীর্ঘমেয়াদী আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হবে। প্রশিক্ষক হবার সম্মতির জন্য বাংলা একাডেমিতে আসাদ ভাইয়ের কাছে অনুরোধ নিয়ে গেলাম, তিনি রাজী হলেন সাথে সাথেই। ব্যাপারটি এমন যেন এখনই ক্লাস নিতে চলে আসবেন টি এস সি-তে।

আবৃত্তি ও বাচিক শিল্পের প্রতি তাঁর সে-কি প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা। অনেকগুলো ক্লাস তিনি নিয়েছিলেন সম্মানী ছাড়াই। আমাদের মনে হতো আহা! কোর্সের সবগুলো ক্লাসই যদি তিনি একা নিতেন কতই না উপকৃত হতাম। আবৃত্তি শেখানোর জন্য যত আয়োজন-নিয়োজন এসবের জন্য আসাদ চৌধুরী একাই যথেষ্ট। এভাবে ঘনিষ্ঠতা তাঁর সাথে। প্রায়ই যেতাম বাংলা একাডেমিতে তাঁর অফিসে, কখনো তিনি ডেকে পাঠাতেন–একাডেমির মঞ্চে আবৃত্তি করার জন্য।

বাংলা একাডেমি তখন রত্নরাজিতে পরিপূর্ণ, অনেক জ্ঞানি-গুণি ব্যক্তিত্বের সমাহার। মনে পড়ে বাংলা একাডেমিতে তখন তিনজন সেরা আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক ছিলেন। তাঁদের উপস্থাপনা-বাচনভঙ্গি-কণ্ঠস্বর-উচ্চারণ এবং পরিমিতিবোধ ছিল ঈর্ষণীয়ভাবে সুন্দর। এঁরা হলেন, কবি আসাদ চৌধুরী, ফরহাদ খান এবং ম. জিল্লুর রহমান।

আবৃত্তি করতে গিয়ে আমি তাঁদের সামনে অসহায় বোধ করতাম। আসাদ ভাই প্রায়ই বলতেন তোমার আবৃত্তি খুবই ভাল হয়। আমার মনে হতো এ ছিলো তাঁর উৎসাহ ও ভালোবাসার মিশ্রিত আশ্রয়। তিনি খুলে দিয়েছিলেন তাঁর সকল সহায়, তাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছিলাম আমরা কিছু তরুণ বাচিকশিল্পী শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তির চর্চা করবো বলে।

আবৃত্তির বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে নতুন নতুন প্রস্তাব দিতেন তিনি– ঐ কবিতাটি দ্বৈত আবৃত্তি করো, এই ছন্দবদ্ধ কবিতাগুলোর বৃন্দ আবৃত্তি করো– সমান সংখ্যক ছেলে মেয়ে দল বেঁধে। তালের কবিতা তবলার বোলের সাথে প্রাক্টিস করো। তাঁর পরামর্শে আবৃত্তির এসব নিরীক্ষা আমরা টি.এস.সি-র মঞ্চে, টেলিভিশনে উপস্থাপন করেছি বহুবার। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিল্পসাহিত্য বিষয়ক একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘প্রচ্ছদ’ পরিচালনা ও উপস্থাপনা করতেন আসাদ চৌধুরী। সেখানে আমাদের দিয়ে অনেক আবৃত্তি করিয়েছেন তিনি।

‘প্রচ্ছদ’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন সম্প্রচারিত হয়েছিলো এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। আমি ছিলাম তাঁর পরামর্শের উত্তম তামিলকার। তিনি বলতেন–উচ্চারণ গুরুমুখি বিদ্যা– নিজে নিজে শেখা যায় না গুরুর কাছে শিখতে হয়। সুন্দরভাবে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারা একটি বিশেষ যোগ্যতা, শুদ্ধ উচ্চারণ হলো আভিজাত্যের প্রতীক। বলতেন, আমাদের শিক্ষিত সমাজের বাংলা উচ্চারণের যে দুরাবস্থা তোমরা এগিয়ে এসে এর একটা বিহিত করো-তো, বাংলা কথ্যভাষাকে শিষ্ট-মিষ্ট রূপ দাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এই আন্দোলন শুরু করতে হবে।

আমরা অবশ্য উচ্চারণ, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, অভিনয়সহ অন্যান্য শিল্পমাধ্যম নিয়ে সফল আন্দোলনের সুপরিসর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলের বিশাল সংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে। ১৯৮২ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ছিল মূলত সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রসার ঘটানো এবং পারফর্মিং আর্টে শিষ্ট রুচির বিকাশ গড়ে তোলা।

১৯৮৩ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোরে মাইকেল মধুসূদন মেলা, বাংলা একাডেমি ও বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন)-এর যৌথ আয়োজন। ২৪ জানুয়ারি ফজর ওয়াক্তের পরপর আসাদ ভাই আমাকে তুলে নিলেন জীপগাড়িতে যশোরের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে বললেন, মহাকবির জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান যশোর সাগরদাড়ীতে, চলো। আমরা তাঁর একান্ত অনুগত সহযাত্রী।

বললেন, একজন মহাকবির জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান-মেলা, তিনদিনব্যাপী অথচ আবৃত্তির আয়োজন নেই? কি আশ্চর্য! এটা কীভাবে সম্ভব? সাগরদাড়ীতে গিয়ে আমরা তিনদিন ধরে মধুসূনের অনেক কবিতা-নাটকের সংলাপ আবৃত্তি করেছি। বিশাল অনুষ্ঠান, মাইকেল প্রেমিক সকল স্তরের মানুষের সে কী উচ্ছাস আর ভালোবাসা। মনে পড়ে মধ্য মাঘের শান্ত কপোতাক্ষ নদের তীর আমরা মধূকবির আবৃত্তিতে আবৃত্তিতে মুখর করেছিলাম।

আসাদ ভাই প্রায় সময় আমাদের নির্দিষ্ট করে বলে দিতেন অমুক কবির অমুক কবিতাটি আবৃত্তির জন্য তৈরি করো– রেকর্ড করবো টেলিভিশনের জন্য কিন্তু কখনো নিজের বই এগিয়ে দিয়ে বলেননি আমার এই কবিতাটির আবৃত্তি রেকর্ড করো। আবৃত্তি উপযোগী তাঁর অনেক ভাল কবিতা আছে কিন্তু তাই বলে সেধে সেধে তিনি কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও কাব্যশক্তিকে খর্ব করেন নি।

আমার বিবেচনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সর্বোচ্চ আবৃত্তি গুণসম্পন্ন কবিতা এবং জনপ্রিয় আবৃত্তির কবিতাগুলো হলো : সত্য ফেরারী, শহীদদের প্রতি, বারবারা বিডলার-কে, ফাগুন এলেই, জানাজানি, তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, অজ্ঞাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা, একটি শালিক, ফেরদৌসী তনয়ার স্বর্ণমুদ্রা প্রত্যাখ্যান, ইত্যাদি।

আবৃত্তি শেখার বইগুলোতে, ক্যাসেটে, সিডিতে, মঞ্চে এই কবিতাগুলোর রেফারেন্স ও আবৃত্তি ঘুরে ফিরে এসেছে। কবিতাগুলোর মধ্যে ‘শহীদদের প্রতি’, ‘বারবারা বিডলার-কে’, ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’, ‘অজ্ঞাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা’, কবিতা চারটি মুক্তিযুদ্ধের।

আসাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অনুভুতি উঠে এসেছে এই চারটি কবিতায়, যেমন :

১. তোমাদের যা বলা ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল?
ঘৃণার ছিল?
নাকি ক্রোধের
প্রতিশোধের
কোনটা ছিলো।
(শহীদদের প্রতি)

২. আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁ’র ছবি ছাপা হয়–
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দ্যাখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনের লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলাটিপে হত্যা করেছে
অদ্ভ‚ত যাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।
(বারবারা বিডলার-কে)

৩. নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস-করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে
মরার চোখে আগুন ছিলো–
এ-কথা কে ভাববে?
আগুন ছিলো মুক্তিসেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিলো সব অন্যায়।
(তখন সত্যি মানুষ ছিলাম)

৪. প্রতিশোধ পরায়ণ হয়েছিলো নিরীহ যুবক
আর কিছু নয়।
তার অস্থির পায়ের ছাপ পড়েছিলো এদিক-সেদিক
এলোমেলো গ্রামে-গঞ্জে, ক্যাম্পে আর
বাংলার বনে ও বাদাড়ে।
থ্রিনট থ্রি আদর পেয়েছিল গর্ভ-সোদর ভাইয়ের অধিক।
চোখের তারার চেয়ে প্রিয় ছিলো
কালো কুচকুচে গ্রেনেড
তার আর গল্প নেই, শেষ অংশ আমার অজানা।
(অজ্ঞাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা)

স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, রেডিও-টেলিভিশনে বা মঞ্চের অনুষ্ঠানে বা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় এই চারটি কবিতা থেকে শিল্পীরা আবৃত্তি করবেই করবে। আমরা যাকে বলি ‘কমন’ কবিতা। তেমনিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে নিচের কবিতাদুটি আবৃত্তি করা হবেই। তবে কিশোর-কিশোরিদের বেশি আবৃত্তি করতে দেখা যায়:

১. ফাগুন এলেই পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আসা
নাম দিয়েছি ভাষা
কতো নামেই তাকে ডাকি
মেটে না পিপাসা ……..
(ফাগুন এলেই)

২. বাংলাদেশের পাখি কেন মধুর সুরে ডাকে
জানো?
বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে
জানো?
জানি, জানি, জানি
পাখির ভাষার মান দিতে যে
বাঙালি দেয় জান
পাখি যে তা জানে
তাই তো পাখি পাগল করে
বিহান বেলার গানে।
(জানাজানি)

শিশুরা আর একটি ছড়া খুবই আবৃত্তি করে ঘঁৎংবৎু জযুসব-এর মত করে, কখনো একা কখনো দল বেঁধে। শুনতে খুবই ভাল লাগে, যেমন :

যে-দিক তাকাই
একটি শালিক
পাজি শালিক
দুষ্টু শালিক
মিষ্টি শালিক
ভীষণ চালাক একটি শালিক
খয়েরি রঙ ডালে-ডালে
উড়ে বেড়ায়, নেচে বেড়ায়
সবুজ ঘাসের কচি ডগায়
হাঁটছিলো সে সাত সকালে।
(একটি শালিক)

দু’টি খুব সিরিয়াস কবিতা, যেমন :

১। কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা বেতারে,
নৌকার খোলে সাপের ঝাঁপিতে নেই তো!
(সত্য ফেরারী)

২. তুমি চলে যাও
এখনো ঘরের মধ্যে লোবানের ঘ্রাণ
গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে
যার জন্যে এসেছিলে এই বিদ্রোহী ভবনে
তিনি নেই,
শোকার্ত কবিতা-প্রিয় নাগরিকদের কেউ কেউ
হয়তো বা গোরস্থান থেকে
এখনো ফেরেনি–
আমি দু’ চোখের পানি মুছে শেষ করতে পানিনে
আমি কবি নই, আমার জনক কবি, তিনি নেই,
(ফেরদৌসী তনয়ার স্বর্ণমুদ্রা প্রত্যাখ্যান)

এই কবিতা দু’টির মধ্যে ‘সত্য ফেরারী’ কবিতাটি আমার জানামতে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল আবৃত্তি করতেন কবি আসাদ চৌধুরী নিজে।

আগে বলেছি আসাদ চৌধুরী শুধু নিজের কবিতা না, যে কোন কবির কবিতারই উত্তম আবৃত্তিশিল্পী ছিলেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগে কবিতাশিল্প ও আবৃত্তিশিল্প যেমন মিলে মিশে একক শিল্প ছিলো আসাদ চৌধুরী সেই বলিষ্ঠ ধারার একজন সফল প্রতিনিধি। যেমন: মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, শাহাদাৎ হোসেন, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান–এঁরা একই সাথে কবি ও আবৃত্তিশিল্পী ছিলেন।

আসাদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে আমরা আবৃত্তি করতে শংকিত থাকতাম, আমি নিজে তো অবশ্যই– হলো কি হলো না অজানা ভয় পেয়ে বসতো। আসাদ চৌধুরী আবৃত্তি শিল্পের একজন সেরা প্রশিক্ষক ও বিচারক ছিলেন। আবৃত্তি কর্মশালাগুলোতে দক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে এবং আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে তাঁর নাম স্মরণযোগ্য। রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চের শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠানে তিনি আবশ্যক ছিলেন বহুকাল ধরে।

মৃত্যুর কিছুকাল আগেও আক্ষেপ করে তিনি বলেছিলেন, বছর পনের আগেও বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে স্টান্ডার্ড উচ্চারণ ও প্রমিত বাকভঙ্গি অনুসরণ করা হতো এখনো সে ধারা কিছুটা অবশিষ্ট আছে কিন্তু চ্যানেল টিভিগুলোর করুণ দশা আর, এফ.এম ব্যান্ড রেডিওর কথা কি বলবো তারা রীতিমত উচ্চারণ-দূষণ ছড়াচ্ছে, এটা অপরাধ, তরুণ শ্রোতাদের মাঝে এর কুপ্রভাব দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার। উচ্চারণ শিল্প নিয়ে আমাদের এতো দিনের অর্জন ওরা ধ্বংস করে দিচ্ছে।

আসাদ চৌধুরীর চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো তিনি কাউকে ‘না’ করতে পারতেন না, ফিরিয়ে দিতে পারেন নি। সে কারণে তরুণ প্রজন্ম তাঁর কাছে বারবার ছুটে গিয়েছে কেননা তিনি কারো আশা ভঙ্গ করতেন না। আর সে কারণে তাঁকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে কবিসভা, সাহিত্য-সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, আবৃত্তির অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে। এবং এই কাজগুলো তিনি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই করেছেন। দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্যরে সম্পর্ক তিনি বজায় রাখতেন সব সময়। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিলো কিন্তু তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক। আসাদ চৌধুরীর মতো আসর জমানো কবি বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কমই আছে। কেননা তিনি সুবক্তা হওয়ায় যে কোন বিষয়ে আলোচনার মধ্যমণি হয়ে আসর নিয়ন্ত্রণ করার পটুতা রাখতেন, গুরুগম্ভীর আলোচনাকেও হাস্যরসাত্মক বিষয় দিয়ে প্রাণবন্ত করার দক্ষতা তাঁর ছিলো। তিনি কথা বলতেন হৃদয়ের উৎসারিত ধ্বনিপুঞ্জ দিয়ে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিল্প-সাহিত্যিকেরা যখন অন্ধভাবে রাজনীতির দলীয় আনুগত্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজস্ব শিল্পসৃষ্টির শক্তিমত্তা বিনাশে ব্যস্ত তখন আসাদ চৌধুরী এ বিষয়ে নিরাসক্ত থেকে সাহিত্যকেই তাঁর জীবনের প্রতিপাদ্য করেছেন। তিনি সাহিত্যে দলীয় রাজনীতির প্লাটফর্ম পছন্দ করেন নি। সে কারণে তাঁকে প্রায় সকল মত ও পথের মানুষের সাথে একই মঞ্চে সহজেই একাত্ম হতে দেখা গেছে। তাঁকে বৃত্ত করেই শুরু হয়ে যেতো উপস্থিত জনের আলাপ-সালাপ। মনে পড়ে অনেক বছর আগে একবার আসাদ ভাই আমাকে বলেছিলেন–‘নাসিম, নাচতে নেমে ঘোমটা দিয়ে কি লাভ?’ কেন বলেছিলেন সেকথা জানতে চাওয়া হয়নি। তবে হ্যাঁ আমি আমার অতি ক্ষুদ্র শিল্পপ্রয়াস নিয়ে বাছ-বিচার করেই চলি, আব্রু রক্ষা করে চলি। শিল্পচর্চাকে আমি আভিজাত্যের মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করেছি, স্রোতে গা ভাসিয়ে চলার মানুষ হতে ইচ্ছে করেনি।

দেখেছি আসাদ চৌধুরী সব সময় সত্য ও বিবেক দিয়ে পরিচালিত তোষামদহীন মানুষ, মস্তক নত করেছেন শুধু আল্লাহর কাছে সিজদায়। তিনি ধার্মিক ও বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। পুরস্কারের পরোয়া তাঁর কখনোই ছিলো না, তিনি পুরস্কার থেকে মোহমুক্ত একজন বিরল সাহিত্যিক।

পেশা ও নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় নিয়মিত দেখা হয়নি তাঁর সাথে। কিন্তু যখনই দেখা হয়েছে নিতান্ত চিরচেনা কাছের অভিভাবকের মতই প্রগাঢ় কুশল বিনিময়, মধুর হাসি এবং আন্তরিক কথোপকথনে না দেখা সময়ের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছেন।
জীবনের শেষপ্রান্তে কানাডা প্রবাসী হয়েছিলেন তিনি এবং সে মাটিতেই কবর নিয়েছেন। অনেকের মতো আমারও তা ভালো লাগেনি। কবি আসাদ চৌধুরী আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম উপদেশক ছিলেন। আলোকিত রাহ্বার হয়ে তিনি এ জাতির নতুন পথের যাত্রীদের দিক নির্দেশনা দান করে গেছেন। আরো বহুদিন তিনি চিরঞ্জীব থাকুন বাংলা কাব্যভুবনে, বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও বাংলা আবৃত্তির আঙিনায়।

* নাসিম আহমদ আবৃত্তি শিল্পী ও লেখক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *