ওসমানী বিমানবন্দর সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক হলে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে

সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

নাম সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর। প্রতিষ্টা হয়েছিল বৃটিশ শাসনামলে। প্রতিষ্টার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জাপানের আগ্রাসন রুখা। প্রথমে নাম ছিল সিলেট বিমানবন্দর। স্বাধীনতার পর সিলেটের কৃতিসন্তান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল (অব:) আতাউল গনী ওসমানীর নামানুসারে এটির নামকরণ করা হয়। বিমানবন্দর ও রানওয়ে সম্প্রসারন করে ২০০২ সালে এটির নাম দেয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।

সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নামে আন্তর্জাতিক হলেও আসলেই কি এটি পূর্নাঙ্গ ও সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলতে যা বুঝায় তা? সবকিছুর বিবেচনায় তো তা মনে হয় না। সত্যিকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে তো বহুজাতিক এয়ারলাইনগুলোর ফ্লাইটসমুহ (যেমন: কাতার এয়ারওয়েজ, তার্কিশ এয়ারলাইন্স, ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্স, এমিরাত এয়ারলাইন্স, জেট এয়ারওয়েজ, সৌদি এয়ারলাইন্স ইত্যাদি) সিলেট থেকে সরারসরি আসা যাওয়া করতো বা সেখানে অবতরণ করার সুযোগ থাকতো। শুধুমাত্র বিমানের কয়েকটি ফ্লাইট দেশের বাহিরে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ও মধ্যপ্রাচ্যে যায় ও আসে। আর এতে করেই আন্তর্জাতিক হয়ে গেল? এটা তো অনেকটা “কানা ছেলের পদ্মলোচন নাম” এর মতো হয়ে গেলো না!

সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরকে সতিকার অর্থে ও পূর্নাঙ্গভাবে আন্তর্জাতিক করতে অসুবিধা কি? কেন করা হচ্ছে না? যুগের পর যুগ ধরে শুনে আসছি রানওয়ে দীর্ঘ করার কথা ও রিফিউলিং- এর ব্যবস্থা করার কথা। কেন করা হচ্ছে না? রিফিউলিং আর রানওয়ে বড় করার কিচ্ছা আর কত দিন শুনবো? পৃথিবীর ৬০ টি দেশের অন্তত: ৯০টি এয়ারপোর্ট দেখার ও ঐসব এয়ারপোর্টগুলো দিয়ে যাতায়াত করার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে। সাইপ্রাসের লারনাকা বিমানবন্দর, ইতালির রিমিনি শহরের রিমিনি বিমানবন্দর, আফ্রিকার দরিদ্র দেশ উগান্ডার এন্টেবে বিমানবন্দর – এগুলোর কোনোটাই তেমন বড় নয়। নিজ চোখে দেখেছি – অনেকটা সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরের মত। কিন্তু ওখানে সব ধরনের বহুজাতিক আন্তর্জাতিক এয়ারক্রাফট নামতে পারলে সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরে পারে না কেন?

যুক্তরাজ্যের সর্ববৃহৎ ও বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ও বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে হিথ্রো বিমানবন্দর যা লন্ডন নগরীর উপকন্ঠে অবস্থিত। তারপরেও লন্ডনের ৫০/৬০ মাইলের ভিতর Gatwick Airport, Stansted Airport ও Luton Airport নামের তিনটি পূর্নাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর আছে। তথাপি খোদ লন্ডন সিটির ভিতর London City Airport নামে একটি বিমানবন্দর আছে যা সিলেট এমএজি ওসমানী বিমান বন্দর থেকে অনেক ছোট, অনেকটা অর্ধেক হবে। London City Airport – এর রানওয়ের দৈর্ঘ হচ্ছে মাত্র ৪৯৪৮ ফুট আর সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ হচ্ছে ৯৬৪৬ ফুট। অথচ London City Airport থেকে গোটা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি আমেরিকায় ফ্লাইট যাওয়া-আসা করে।

২০১৮ সালে সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রী যাওয়া আসা করেছেন ৫,৩৩২০৮ জন। অপরদিকে London City Airport দিয়ে ২০২২ সালে যাত্রী যাওয়া আসা করেছেন ৩০,০৯,৩১৩ জন। অর্থাৎ সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের অর্ধের সাইজের London City Airport অনেকটা full-fledged আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে সার্ভিস দিয়েছে যার মধ্য দিয়ে ওসমানী বিমানবন্দরের চেয়ে ছয়গুন বেশী যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন।

২০২২ সালের অক্টোবরে ঘুর্নিঝড় সিত্রাং এর সময় প্রমান হয় যে সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চাইলে বিদেশী যে কোন এয়ারলাইন্স নামতে ও উঠতে পারে ও পারবে। কেননা ঢাকা থেকে ডাইভার্টেড হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ৮টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সিলেটে উঠা-নামা করেছে। মানবজমিন ২৫ অক্টোবর ২০২২ “ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং: শাহজালালে নামতে না পেরে ওসমানীতে অবতরণ করলো” শিরোনামে রিপোর্ট করেছে। এতে বলা হয় “জরুরি ভিত্তিতে অবতরণ করেছে ৮টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। রাত ১১টা থেকে দেড়টার মধ্যে এসব ফ্লাইট অবতরণ করে।” এতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে বহুজাতিক বা আন্তর্জাতিক যেকোন ফ্লাইট সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে সক্ষম।

অনেকে মনে করেন কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও দুর্নীতিবাজ কিছু ব্যক্তি ও গোষ্টির কারণে সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর সত্যিকার অর্থে ও পূর্নাঙ্গভাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে উঠছে না। এর ফলে বহির্বিশ্বে থাকা সিলেটের যাত্রীরা অযথা বৈষম্য ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বৃটেন থেকে চড়া দামে তারা শুধুমাত্র বাংলাদেশ বিমানের টিকেট কিনে সিলেট যেতে হচ্ছে। কাতার বা তার্কিশ এয়ারলাইন্সে যেখানে ৫০০ বা ৬০০ পাউন্ডে লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়া যায় সেখানে বিমানে লন্ডন থেকে সিলেটে ডাইরেক্ট ফ্লাইটে যেতে গুনতে হয় ১০০০ পাউন্ড থেকে ১৪০০ পাউন্ড। অর্থাৎ দ্বিগুন বা দ্বিগুনের কাছাকাছি! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ইংল্যান্ড থেকে বিমান প্রথমে সিলেটে যায়। এরপর যায় ঢাকা। এখানেও ঢাকা থেকে সিলেটের ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ পাউন্ড বেশি। এর কারণ মোটেই বোধগম্য নয়। এটা তো রীতিমত সিলেটের প্রতি বৈষম্যমূলক ও বিমাতাশুলভ আচরণ।

পূর্নাঙ্গ ও সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করত: বিভিন্ন দেশের বিমান বা এয়ারলাইন্সকে অরতরণের জন্য উন্মোক্ত করে দিলে সার্ভিসের মান ও ভাড়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হতো যা তুলনা ও যাচাই করে যাত্রীরা অপেক্ষাকৃত ভালোটা বেছে নিতে পারতেন। বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্স উঠানামা করলে এভিয়েশন ফি, ল্যান্ডিং চার্জ, Fuel Costs ও পার্কিং চার্জসহ বিভিন্ন খাত থেকে বিপুল পরিমান অর্থ বাংলাদেশ আয় করতে পারতো। এই সুযোগটি হাতছাড়া হচ্ছে।

ভৌগোলিকভাবে সিলেটের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আর এটা ভেবেই কিন্তু বৃটিশরা সিলেটে বিমানবন্দর স্থাপন করেছিলো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, শিমুল বাগান, দেশের বৃহৎ জলপ্রভাত মাধবকুন্ড, লালাখাল, রাতারগুল জলাবন, বিছানাকান্দি, ডিবির হাওর, মালনীছড়া চা বাগান, জাফলং, তিন নদীর মোহনা, তামাবিল, সাদাপাথর, ক্বীন ব্রিজ, ওসমানী যাদুঘর, আলী আমজদের ঘড়িসহ বহু দর্শনীয় ও প্রাকৃতিক স্থানের সমারোহ এই সিলেটে। সিলেটকে বলা হয় বাংলাদেশের “আধ্যাত্বিক রাজধানী”, ওলীকুল শিরোমনী হযরত শাহজালাল (র:) ও হযরত শাহপরাণ (র:) এই সিলেটে শুয়ে আছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের বিশেষ উপলক্ষ ও নির্বাচনকে ঘিরে তাদের কার্যক্রম সাধারণত শুরু করেন সিলেটের হযরত শাহজালাল (র:) মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে। দুটি মাজারসহ সিলেটের উপরোক্ত প্রাকৃতিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি দিন সিলেটে ভীড় জমান হাজার হাজার পর্যটক।

এমতাবস্থায় পূর্নাঙ্গ ও সত্যিকার অর্থে ওসমানী বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক হলে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। গোটা ভারত ও দক্ষিন এশিয়ার বিভিন্ন সিটি থেকে ২/৩ ঘন্টার ফ্লাইটে পর্যটকরা সিলেটে আসতে পারেন উপরোল্লিখিত প্রাকৃতিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে। অনেক বিদেশীরা ডে ট্রীপে বা ২/৩ দিনের ইউকএন্ড ব্রেকে (সপ্তাহান্তের ছুটিতে) আসতে পারেন সিলেটে, যেভাবে বৃটিশ ভ্রমনপিপাসুরা যান ইউরোপের বিভিন্ন সিটি ও দর্শনীয় স্থান দেখতে। এতে সিলেট হতে পারে দক্ষিন এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ন চক্রকেন্দ্র (Hub)। বাংলাদেশ সরকার ট্যুরিজম থেকে বিপুল অর্থ আয় করতে পারে।

অপরদিকে সিলেটের লক্ষ লক্ষ অধিবাসী ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকায় বসবাস করেন। শুধু যুক্তরাজ্যেই বসবাস করছেন প্রায় সাত লক্ষের উপর সিলেটের অধিবাসী। তাদেরকে ‘ওয়ান ম্যান শপ’ এর মতো চড়া দামে শুধু বিমানে আসা-যাওয়া করতে বাধ্য না করে অন্যান্য এয়ারলাইন্সগুলোকে সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করার সুযোগ দিলে তারা সিলেটে নিজে ও পরিবারকে নিয়ে ঘনঘন বেড়াতে আরো বেশী আগ্রহী হবেন, আগ্রহী হবেন বিনিয়োগ করতে অথবা ইতিমধ্যে করা বিনিয়োগের পরিধি বাড়াতে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রকারান্তরে লাভবান হবে। প্রতিযোগীতার কারণে বিমানের সেবার মানও বাড়বে। তার সাথে সাথে কমবে বা বন্ধ হবে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় আসা বিমান সংশ্লিষ্টদের দূর্ণীতি।

বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি ট্যুরিজমের উপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভুমি, প্রাকৃতিক কোন সৌন্দর্য্য নেই – এমন অনেক দেশও কৃত্রিম উপায়ে দর্শনীয় স্থান বানিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ট্যুরিষ্টদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। অথচ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য স্রষ্টা প্রদত্ত। কিন্তু আমরা এই স্রষ্টা প্রদত্ত অপার সম্ভাবনাকেও ভালভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। শুধু নামেই নয় বরং পূর্নাঙ্গ ও সত্যিকার অর্থে সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করা হলে বাংলাদেশের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। দেশ ও সরকারের একেবারে উচ্চ মহলের সুদৃষ্টি আকর্ষন করছি।

* নাজির আহমদ বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *