এরদোগান : ধূলির ধরায় এক অপরাজিত রণবীর, আল্লাহর দরবারে বিনয়াবনত এক আলোকিত বান্দাহ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ব্যারিষ্টার হামিদ আজাদ

দ্বিতীয় রাউন্ডের (রান অফ) এক ঐতিহাসিক নির্বাচনে তায়েফ এরদোগান তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এটি তাঁর টানা ৬ষ্ঠতম নির্বাচন। এবারের বিজয়টি মোহাম্মদ ফাতেহ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ৫৭০তম বার্ষিকীর ঠিক আগের দিন অনুষ্ঠিত হল।

ইসলামী সভ্যতার একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে এমন মিল একটি বড় কাকতালীয় ঘটনা। জানিনা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের সময় এ ঐতিহাসিক দিনটিকে সামনে রেখে তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল কিনা।

যাহোক, তুর্কি জনগনের বিজয় উল্লাস দেখে মনে হচ্ছে, তারা ওসমানীয় খেলাফতের সে ঐতিহাসিক বিজয়ের সাথে এ বিজয়ের ঐতিহাসিক যোগসুত্র নির্ণয় করছে। মহান আল্লাহ এ বিজয়ের সুফলকে স্থায়ী করুন এবং মুসলিম উম্মাহসহ বিশ্বমানবতার জন্য এ বিজয়ের মাধ্যমে কল্যাণের ফলগুধারা প্রবাহিত করে দিন। আমীন।

দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে জনাব এরদোগান ১৯৯৪ সালে তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর এবং ইসলামের ইতিহাসের ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তিনি কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি।

পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনগনের ভালবাসা সহ সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় থাকার নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি। তাঁর শাসনামলে তিনি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, সামাজিক চ্যালেঞ্জ, মিডিয়া চ্যালেঞ্জ, কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তৈরী করা অভ্যন্তরীন চ্যালেঞ্জ এবং নিজের এবং দলের অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জের মতো সব ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।

সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা তাঁকে দেখেছি ধৈর্যশীল, সাহসী, কূটনৈতিক, কৌশলগত, দূরদর্শী, সরল এবং নিজের দায়িত্বের প্রতি সদা মনোযোগী এক প্রেরণাদায়ক নেতা হিসেবে। সর্বোপরি আমরা তাঁকে মহান প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর সদা নির্ভরশীল বান্দাহ হিসেবে দেখতে পেয়েছি।

আল্লাহর রহমতে এবং সহকর্মী ও নাগরিকদের অপ্রতিরোধ্য সমর্থনে তিনি সমস্ত চ্যালেঞ্জ এবং অসুবিধা কাটিয়ে উঠেছেন। দলকে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থানে নিয়ে নিজেকে সবচেয়ে জনপ্রিয়, শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য নেতার আসনে আসীন করেছেন।

এই নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের আগে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তিনি একের পর এক নানামূখী চ্যালেন্জের সম্মুখীন হয়েছেন। সব পশ্চিমা শক্তি এবং মিডিয়া একাট্টা হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে। প্রতিপক্ষরা তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অশ্লীল ভাষায় কটুবাক্যের শানিত তীর নিক্ষেপ করতেও কুন্ঠাবোধ করেনি।

এই সমস্ত সঙ্কট এবং উস্কানির মুখে আমরা তাঁকে কোন খারাপ ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখিনি। বরং সবসময় দেখেছি তিনি সকল বাঁধার মুখেও তাঁর মিশনের দিকেই মনোনিবেশ করেছেন।

২০১৬ সালে যখন সে দেশের সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং তাঁকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়েছিল, সমগ্র বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছেন যে, তিনি সেই কঠিন সময়েও এক মূহর্তের জন্যও নার্ভাস বা অধৈর্য হননি। বরং এ জীবন-মরন চ্যালেন্জের মুখেও আমরা লক্ষ্য করেছি তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা, মহান প্রভুর সাহায্যের প্রতি তাঁর অবিচল বিশ্বাস এবং তাঁর প্রতি জনগনের আস্থা ও ভালবাসার উপর পূর্ণ বিশ্বাস।

যখন তাঁকে প্রতিবেশী দেশ এবং তাঁর অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দিকে রুজু হয়ে শুধু মাবুদের সাহায্য কামনা করেন। অতঃপর পূর্ণ বিশ্বাস ও ভালবাসার সাথে তাঁর জনগনকে দেশের স্বার্থে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান।

আপামর জনতা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর ট্যাংকের মুখে নিরস্ত্র অবস্থার রাস্তায় ঝাপিয়ে পড়ে তাদের নেতার প্রতি ভালবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জনতা দলে দলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করেছেন। সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে বিপথগামী সেনাবাহিনীকে ভালবাসা ও অভূতপূর্ব সাহসিকতার সাথে পরাজিত করেছেন। সেদিন তাদের প্রিয় নেতার জীবন বাঁচাতে আড়াই শতাধিক মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন ইস্তাম্বুল ও আন্কারার রাজপথে।

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিশ্ব রাজনীতির সংস্কার সাধনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশেষতঃ মুসলিম উম্মাহ এবং সামগ্রীকভাবে মানবতার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও অনুরাগই বিশ্বরাজনীতিতে তাঁর ভূমিকার মূল চালিকা শক্তি।

ফিলিস্তিনের ওপর প্রতিটি ইসরায়েলি হামলার সময়েই তিনি ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের সাহায্যকারী ও বন্ধু হিসেবে পাশে ছিলেন। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি সাহসিকতার সাথে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি সরকারের অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করেন।

২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি প্যানেলে আলোচনার সময় তিনি প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনি হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে কড়া প্রতিবাদ করেন এবং গাজা আক্রমণের প্রতিবাদে ততকালীন ইসরাইলী প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেসের সাথে বৈঠক ত্যাগ করেন। তাঁর সাহসী ভূমিকা এবং বৈশ্বিক ফোরামে ইসরায়েলি রাষ্ট্রপতির সাথে সাহসী প্রতিবাদ তুরস্কসহ সমগ্র দুনিয়ায় ব্যাপক সমর্থন লাভ করে এবং কয়েক ঘন্টা পরে জেনেভা থেকে ইস্তাম্বুলে পৌঁছানোর সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ জনতা তাঁকে বীরের সম্বর্ধনা প্রদান করেন।

ইসলামি ভ্রাতৃত্বের নীতি অনুসরণ করে এরদোগান সিরীয় শরণার্থীদেরকে তাঁর দেশে “মেহমান” হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ সিরীয় উদ্বাস্তুদের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠেন তিনি।

শুধু ফিলিস্তিন ও সিরিয়া নয়, তিনি সকল নিপীড়িত ও বঞ্চিত জাতির-গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, যখনই তাদের সাহায্য ও সমর্থনের প্রয়োজন হয়। তিনি বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের উপর নিপীড়ন বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। সোমালিয়া পুনর্গঠনে তাঁর অবদান মানবতার সেবায় তাঁর বদান্যতা এবং নেতৃত্বের আরেকটি জলন্ত উদাহরণ।

কাতার যখন শক্তিশালী প্রতিবেশীদের অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিল, তখন এরদোগানের মানবিক ও সাহসী নেতৃত্বে তুরস্ক তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। আজকের বিজয়ের পর কাতারের আমিরের অভিনন্দন বার্তায় দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এরদোগানের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতারই সুস্পস্ট প্রতিধ্বনি।

কাতারের আমীর তামীম বিন হামাদ লিখেন, “আমার প্রিয় ভাই রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, আপনার বিজয়ের জন্য অভিনন্দন। আমি নতুন মেয়াদে (প্রেসিডেন্ট হিসাবে) আপনার সাফল্য কামনা করি এবং এ বিজয়ের মাধ্যমে তুর্কি জনগণ আরো অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করুক এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো শক্তিশালী ও গতিশীল হউক এ কামনা করছি।”

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বার্তায় তায়েফ এরদোগান কিভাবে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণা এবং শক্তির উৎস হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। এরদোগান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন; “তিনি নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য একটি শক্তির স্তম্ভ এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের জন্য একটি প্রেরণাদায়ক কণ্ঠস্বর”

কিছু ক্ষেত্রে বৈরিতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াসহ পশ্চিমা নেতারা এরদোগানকে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন পাঠাতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনি। এ তড়িৎ অভিনন্দন প্রমান করে, এরদোগান কেবল তাঁর দেশের একজন জনপ্রিয় নেতাই নন, তিনি বৈধভাবে নির্বাচিত একজন শক্তিশালী নেতা এবং বিশ্ব রাজনীতিতেও একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক।

বিবিসির পল কিরবি এক নিবন্ধে এই সত্যটিকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন: “একটি সাধারন অবস্থান থেকে শুরু করেও, রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান একজন রাজনৈতিক মহাশক্তি হয়ে উঠেছেন। ২০ বছর ধরে তুরস্ককে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর থেকে যে কোনো নেতার চেয়ে তিনি তাঁর দেশকে আরও বেশি অগ্রগতি দিয়েছেন।”

আমরা যদি তায়েফ এরদোগানের সাফল্যের রহস্য অনুসন্ধান করি তবে আমরা তাঁর চরিত্রে কিছু হৃদয় নিংড়ানো গুণাবলী খুঁজে পাই, যা তাঁকে জনগণের হৃদয়ে একটি ভালবাসাপূর্ণ স্থান দখল করতে সহায়তা করেছে।

১. আকর্ষনীয় বিনয়
নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে তিনি তাঁর জনগনের সাথে মিশার ক্ষেত্রে নম্র এবং বিনয়াবনত চরিত্রের অধিকারী। তিনি সবসময় তাঁর জীবনের মূল ভিত্তি ও সূচনাকে মনে রাখার চেষ্টা করেন যে, তিনি একটি অত্যন্ত সাধারন ও বিনয়ী পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর বাবা একজন কোষ্টগার্ড ছিলেন এবং তিনি যখন ছোট ছিলেন, তখন তিনি জীবন জীবিকার জন্য ইস্তাম্বুলের রাস্তায় লেবুর রস এবং তিলের বান বিক্রি করতেন। তিনি কখনোই অতীতকে ভুলে যাননি, ছোটবেলার বন্ধুদের কখনও অবহেলা করেননি, যা তাঁকে তৃণমূল মানুষের কষ্ট ও অনুভূতি বুঝতে সক্ষমতা দান করেছে। আমি বিভিন্ন সময় ইস্তাম্বুল সফরকালে টেক্সি ড্রাইভার ও সাধারন মানুষের সাথে কথা বলে তাঁর এ চুম্বকীয় চরিত্রের অনেক গল্পগাঁথা শুনেছি।

২. আপন দায়িত্বের প্রতি নিবিষ্টতা ও দূরদর্শিতা
প্রথম দিন থেকেই তিনি একজন দূরদর্শী এবং দায়িত্ব সচেতন নেতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছেন। শত্রুর কোন চক্রান্ত অথবা চলতি পথের হাজারো চ্যালেন্জ তাঁর নজরকে কখনও আপন গুরু দায়িত্ব থেকে ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি। তরুন বয়স থেকেই তাঁর অনুপম বৈশিষ্ট এমনকি ভিনদেশী মেহমানের দৃষ্টিও এড়ায়নি। আমার এক সিনিয়র ভাই ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলন থেকে ফিরে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি ইস্তাম্বুলে একজন অত্যন্ত দূরদর্শী এবং আকর্ষনীয় চরিত্রের যুবককে দেখেছি। তিনি ভবিষ্যতে তুরস্কের বড একটা কিছু হবেন।” কয়েক মাসের মধ্যে আমরা দেখলাম যে তিনি রেকর্ড ব্রেকিং জনপ্রিয়তার সাথে ইস্তাম্বুলের সর্বকনিষ্ঠ মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর থেকে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে জাতির টেকসই উন্নয়নের জন্য বিশাল বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প চালু করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছেন এবং সমৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া তুরস্ককে আধুনিক তুরস্কে পরিণত করেেছন। তুলনামূলকভাবে দরিদ্র তুরস্ককে একটি সমৃদ্ধ তুরস্কে পরিণত করেছেন।

৩. সাহস
দুর্নীতি দূরীকরণ, দেশে নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অবশেষে ১৬ জুলাই ২০১৬ সালে তাঁর অভাবনীয় ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে একটি অবৈধ সামরিক অভ্যুথান ও তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টা জনগণকে সাথে নিয়ে সফলভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া তাঁর সেই অপরিসীম সাহসেরই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। নেতৃত্বের এই গুণ তাঁকে জনগণ এবং তাঁর দেশের গন্ডির বাইরেও এক বিশ্বস্ত চ্যান্জ-মেকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৪. অগ্রাধিকার নির্ণয়ের অপরিসীম সক্ষমতা
অগ্রাধিকার নির্ধারণে তিনি একটি দুর্দান্ত উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে তিনি সফলভাবে জনগণের সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের অগ্রাধিকার অনুযায়ী সমাধান করেছিলেন, যা তাঁকে জনগণের প্রয়োজন পূরণে সক্ষম এবং একজন সময়োপযোগী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৫. ধৈর্য এবং অধ্যবসায়
সম্ভাব্য সকল ধরণের উস্কানি এবং আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। একজন মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে ক্রোধান্বিত করার জন্য এটা যথেষ্ট। তায়েফ এরদোগান সকল উস্কানির মুখেও সবসময় ধৈর্যশীল ছিলেন এবং উস্কানি ও চ্যালেঞ্জের মুখে কখনো প্রতিক্রিয়াশীল হননি, যা তাকে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের মুখে অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে নিবিড়ভাবে সাহায্য করেছে।

৬. মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা
সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তায়েফ এরদোগান তাঁর মৌলিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার নীতির সাথে আপোস করেননি। এই মহান গুণটি তাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন নেতা হিসেবে দেশবাসীর মনের মনিকোটায় স্থান করে নিতে সাহায্য করেছে।

৭. দম্ভ ও অহংকারমুক্ত জীবন
এই মহান গুণ তাঁকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পদে থাকা স্বত্বেও সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকতে সাহায্য করেছে। নির্বাচনে আমরা দেখেছি এরদোগানের জনপ্রিয়তা উচ্চবিত্তদের চেয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশি যা সমাজের সাধারন মানুষের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার বাস্তব প্রতিফলন। তাঁর সমর্থকরা শুধু ভোটারই নয়, তারা তাঁর আন্তরিক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী।

৮. মহান প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এবং নির্ভরতা
তায়েফ এরদোগান আল-কুরআনের একজন হাফিজ এবং একজন অনুশীলনকারী মুসলিম। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, চূড়ান্ত ক্ষমতা সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতেই রয়েছে এবং তিনি সমস্ত কাজের জন্য আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। এ কারণেই আমরা দেখতে পেয়েছি এমন একটি ঐতিহাসিক বিজয়ের পরে, অন্যান্য অনেক বিজয়ী নেতাদের বিপরীতে তিনি আনন্দ ফুর্তি করার পরিবর্তে মহান প্রভুর কাছে সেজদায় অবনত হয়েছেন এবং আল্লাহর অসীম করুণার জন্য নম্রতা ও কৃতজ্ঞতার সাথে মাবুদের গুন সমৃদ্ধ কবিতা লিখে জনগনের দৃষ্টিকে মহাপ্রভূ আল্লাহ্‌র দিকে নিবদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

বিজয়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি সমর্থকদের সামনে এক হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য উপস্থাপন করেন যা ছিল নিম্নরুপঃ

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের যত কথা, যত বাণী, সবকিছুর মুকুট বানিয়ে রাখি আপনার হামদ-সানাকেই। আপনার যিকিরকেই আমাদের হৃদয়ের মি’রাজ মনে করি। আপনার কিতাবকে আমাদের জীবন-বিধান করে নিয়েছি।

একদিন আমাদের অস্তিত্ব ছিলো না, আপনি আমাদের সৃষ্টি করলেন, আপনার নির্দেশাবলী জানিয়ে দিলেন। আমরা যখন অন্তরের প্রশান্তি খুঁজেছি, আপনার ভালোবাসাতেই তা পেয়েছি। আমরা নেয়ামতের সন্ধানে ছিলাম, আপনার দুয়ারেই তা পেয়েছি। আমরা হেদায়েত চেয়েছি, আপনার অপার করুণাতেই তা পেলাম।

আমরা আপনি ছাড়া আর কারুর ইবাদত করি না, আমরা যেন আপনার ক্ষমা পাই। আমাদেরকে ভয় ও সংকটের মুখোমুখি করবেন না ইয়া আল্লাহ, হক কথার ওপর অটল থাকতে আপনি আমাদের সাহায্য করুন।

আমাদেরকে আনন্দের সংবাদ শোনান, হাকিকতের জ্ঞান আমাদের দিন। আপনি যদি আমাদের খুশি বয়ে নিয়ে না আসেন, পৃথিবীর কোথাও খুশি হওয়ার সাধ্য আমাদের নেই। আপনার ভালোবাসার পথ আপনিই যদি না শিখিয়ে দেন, ভালোবাসার হক আদায়ে আমরা দুর্বল হয়ে পড়বো।

ইয়া আল্লাহ, আপনি যাদের ভালোবাসেন, আমাদের মনে তাদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দেন। যারা আপনার কাছে যেতে পেরেছে, আমাদেরকে তাদের কাছাকাছি রাখুন।

ইয়া আল্লাহ, আপনার প্রিয়ভাজন হিসেবে যাদের মঞ্জুর করেছেন, তাদের মধ্যে আমাদেরকেও শামিল করুন। আপনি তো আপনার হাবিব (সা)-কে ভালবেসেছেন, তারপর সমস্ত সৃষ্টির মাঝে তার ভালবাসা ছড়িয়ে দিলেন। ভালবেসেই তাঁকে রিসালাতের চাদর পরিয়ে দিয়েছেন। ভালবেসেই তাঁকে ‘মাকামে ইবরাহীম’ থেকে ‘মাকামে মাহমুদে’ পৌঁছে দিয়েছেন। সমস্ত নবি-রাসূলের নেতা বানিয়েছেন মুহাম্মাদ (সা)কে। তাঁর প্রতি আমাদের সালাত, তাঁর প্রতি আমাদের সালাম। হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি, তাঁর সাথীবর্গ, পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদের প্রতি।”

এই গুণাবলী এরদোগানকে একজন সত্যিকারের নেতা, একজন অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা, একজন সাহসী নেতা, একজন ভদ্র ও সুশীল নেতা হিসেবে তাঁর দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বময় কোটি কোটি বনি আদমের হৃদয়ের মনিকোটায় স্থান করে দিয়েছে। তাঁর বিজয়ের পর বিশ্বের আনাচে কানাচে মানুষের আনন্দ, শোকর প্রকাশ এবং বিজয় উৎসব তারই বাস্তব উদাহরন।

যাহোক, নির্বাচন এখন শেষ, এখন কাজের পালা। মানুষ আশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর বিরাট আমানতের বোঝা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি তায়েফ এরদোগান। সামনে সবচেয়ে বড় কাজ হল মানুষের আশাগুলোকে ফুলে ফলে সুশোভিত করা। আর প্রতিপক্ষ হিসেবে যারা হতাশা ও ভয় নিয়ে ঘরে ফিরেছেন তাদের হতাশা ও ভয় দূর করা। এ ক্ষেত্রে তায়েফ এরদোগানের বিজয় বার্তাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং এ কারনে আমার বেশ ভালো লেগেছে। তিনি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পালন করতে পারলে তিনি চিরকালের জন্য জয়ী হবেন, ইনশাআল্লাহ।

তিনি তাঁর কর্মী বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, “আমরাই একমাত্র বিজয়ী নই। বিজয়ী তুরস্ক। বিজয়ী আমাদের গণতন্ত্র।”

আর আপামর জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, “আমরা একসাথে একই রাস্তায় হেঁটেছি। আমরা দিবারাত্র হেঁটেছি, আর আপনারা আবার আমাদের উপর এই দায়িত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ চাহেতো তারই সাহায্য নিয়ে আমরা একসাথে ‘তুরস্কের শতাব্দী’ নির্মাণ এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাজ করবো।”

কথাগুলোকে বাস্তবে পরিণত করার সময় এসেছে। এই কথাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে অবশ্যই অর্থনীতিকে ঠিক করা এবং ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনর্গঠনকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এই দুটির পাশাপাশি, তায়েফ এরদোগানের এখনই, কাল বিলম্ব না করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দেওয়া দরকার।

১. মনোকষ্ট নিরসন ও ব্যবধান দূরীকরন
এটা স্পষ্ট যে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচনে জিতেছেন। এখন তিনি তুরস্ক এবং তুর্কি জাতির রাষ্ট্রপতি। তিনি ৫২% এরও বেশি মানুষের হৃদয় ও মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে একথাও বাস্তব যে, আরও ৪৮% মানুষের মন ও হৃদয় তাঁর সাথে নেই। তারা কোনো না কোনোভাবে অসন্তুষ্ট বা মনোকষ্টের শিকার। তাদের জয় করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই উদ্যোগ এবং সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। তাকে অবশ্যই তাদের মনের মধ্যে এ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে, তিনি তাদেরও রাষ্ট্রপতি, তাঁর দরজা তাদের জন্য খোলা এবং তারা নির্ভয়ে তাদের মনে যা কিছু আছে তা পরিষ্কার করে তাঁর কাছে পেশ করে তাদের বুক পরিষ্কার করতে পারে।

২. উত্তরাধিকার পরিকল্পনা
গত ২০ বছরে তায়েফ এরদোগান তুরস্ককে অনেক কিছু দিয়েছেন। কোটি কোটি মানুষকে তিনি আশা দিয়েছেন। তিনি তাদের মৌলিক অধিকার, মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করেছেন। তাঁকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁর পরে কেউ যেন এই অর্জনগুলোকে হাইজ্যাক করতে না পারে এবং ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিতে না পারে। এজন্য এখনই একজন নির্ভরযোগ্য উত্তরসূরি নিশ্চিত করা আবশ্যক। তাঁকে অবশ্যই এমন একদল নেতা তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে যারা জনগণের কাছে বিশ্বস্ত ও গ্রহনযোগ্য হবেন এবং তাঁর কষ্টার্জিত অর্জনগুলোকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।

৩. তরুণ প্রজন্মের মন ও মনন জয় করা
এটা লক্ষণীয় যে এরদোগানের বিপক্ষে দাঁড়ানো ভোটারদের মধ্যে ৩০ বছরের কম বয়সীরাই বেশী। জনাব এরদোগানকে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। তাঁর উচিত তাদের কাছে যাওয়া, তাদের রিজার্ভেশন বোঝা এবং তাদের মনে আশা জাগানো এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা। আমার বিশ্বাস প্রেসিডেন্ট এরদোগান একাজটি সর্বোচ্চ দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে করতে পারবেন।

৪. বৈশ্বিক শক্তির সাথে উত্তেজনা হ্রাস করা
“প্রতিবেশীদের সাথে শূন্য সমস্যা” (Zero problem with neighbours) আলোকে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে অবশ্যই প্রতিবেশী এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলির সাথে উত্তেজনা এবং ব্যবধান কমানোর জন্য একটি নীতি এবং কৌশল তৈরি করতে হবে। সফল কুটনীতির মাধ্যমে সৌহার্দপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তুরস্ককে বিশ্বসভায় আরো মর্যাদাপূর্ণ আসন প্রতিষ্ঠায় সবায়তা করবে। এটাই আমাদের বিশ্বাস এবং কামনা।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রতি সন্তুষ্ট হউন, তাঁকে আপন জাতি এবং উম্মাহর আশা পুরনে সক্ষম করুন। আমিন।


খ্যাতিমান সংগঠক ও লেখক ব্যারিষ্টার হামিদ আজাদ লন্ডনে আইন পেশায় নিয়োজিত। চ্যারিটি সংস্থা মুসলিম এইড এবং মুনতাদা এইড-এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *