ভিডিও: https://youtu.be/KJyr_GkkXAA?si=v9JnEBGodhuz65TS
আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা বা পিআর পদ্ধতির ভোট, নির্বাচনের সময় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করাসহ সাত দাবি এবং আগামীতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে। খবর বিবিসি
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শনিবার প্রথম বারের মতো ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশের আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী। এর আগে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা বদলানোর দাবি তুললেও এবার সমাবেশ থেকে সেই দাবি স্পষ্ট করলো দলটি, যে দাবি নিয়ে অন্যতম আরেক রাজনৈতিক দল বিএনপি পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থানে আছে।
শনিবারের এই সমাবেশ থেকে আগামীতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। সভা মঞ্চে টানা দুইবার অসুস্থ হয়ে ঢলে পড়েন তিনি। এরপর তিনি বসে বক্তব্য শেষ করেন। এই বক্তব্যে জামায়াতের আমির ঘোষণা দেন, আগামীতে দলের কেউ এমপি মন্ত্রী হলে কিংবা সরকার গঠন করলে তারা সরকার থেকে কোনো প্লট গ্রহণ করবে না, চড়বে না ট্যাক্স বিহীন গাড়িতে।
জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সমাবেশ হলেও এই কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। এই আয়োজনে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে জামায়াত ইসলামী জানিয়েছে, বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
দুপুরে সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও ভোর থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশস্থল আসতে শুরু করে মানুষ। বাস, ট্রেন, লঞ্চে চড়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এতে অংশ নেন অনেকেই। দুপুরের আগেই সমাবেশ ময়দান পূর্ণ হয়ে যায়। দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লার পক্ষে স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা।
তীব্র গরম ও বিপুল কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে অনেকেই সমাবেশে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দলটির আমির বক্তব্যের শুরুতেই জানান, সমাবেশে অসুস্থ হয়ে একজন ও অংশ নিতে আসার পথে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আরও দুইজন।
দুইবার অসুস্থ হয়ে বসে পড়েন জামায়াত আমির
তীব্র গরমের মধ্যে দ্রুতই সমাবেশ শেষ করতে অল্প সময়েই বক্তব্য শেষ করছিলেন জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে সমাপনী বক্তব্য দিতে মঞ্চের ডায়েসে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন দলটির আমির শফিকুর রহমান। শুরুতেই তিনি মঞ্চে দাড়িয়ে ঘোষণা দেন- “ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের পর আগামীতে বাংলাদেশে আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে”।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বক্তৃতা মঞ্চে দাড়িয়ে থাকা অবস্থা থেকে অসুস্থ হয়ে বসে পড়েন জামায়াত আমির। নেতাদের সহযোগিতায় কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে জামায়াত আমির বলেন, ‘সবাই নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করুন। আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আবার আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি। আমি বলেছিলাম, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ আমরা সবাইকে নিয়ে গড়ব”।
তখন আবারো অসুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়েন জামায়াত আমির। এ সময় মাইকে বলা হয়, “আমিরে জামায়াত একটুখানি অসুস্থ হয়েছেন গরমের কারণে”। কিন্তু তিনি বারবারই চেষ্টা করছিলেন বক্তব্য দেওয়ার জন্য, তবে মঞ্চে থাকা ডাক্তাররা বলছিলেন তার আর বক্তব্য রাখা ঠিক হবে না। এরই মধ্যে জামায়াতের আমির নিচে বসেই মাইকে আবার বক্তৃতা শুরু করেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা
একদিকে যখন মেডিকেল টিম জামায়াত আমির শফিকুর রহমানের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন, তখন মাইক হাতে বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এসময় শফিকুর রহমান বলেন, “জামায়াত যদি আল্লাহর ইচ্ছা এবং জনগণের ভালোবাসায় দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়, তাহলে মালিক হবে না, সেবক হবে ইনশাআল্লাহ।”
তিনি বলেন, “যদি আল্লাহর ইচ্ছায় ও জনগণের ভালোবাসায় জামায়াত থেকে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন, তাহলে কোনো এমপি-মন্ত্রী আগামীতে সরকারি কোনো প্লট গ্রহণ করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী ট্যাক্সবিহীন কোনো গাড়ি চড়বেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী নিজের হাতে কোনো টাকা চালাচালি করবেন না।”
কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী যদি তার নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য থাকবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন।
শফিকুর রহমান বলেন, “চাঁদা আমরা নেব না, দুর্নীতি আমরা করব না। চাঁদা আমরা নিতে দেব না, দুর্নীতি সহ্য করব না। এই বাংলাদেশটাই আমরা দেখতে চাই। যুবকদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, তোমাদের সঙ্গে আমরা আছি।”
পরে বক্তব্য শেষ করে দলের নেতাদের সাথে নিয়ে মঞ্চে উঠে দাঁড়ান জামায়াতের আমির। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। পরে শফিকুর রহমানকে দেখতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হাসপাতালে যান বলে জানায় বিএনপির মিডিয়া সেল।
বিএনপি কি আমন্ত্রণ পেয়েছিল?
গত কয়েক কয়েক মাস ধরে বিএনপির সাথে টানাপোড়েন চলছে জামায়াতে ইসলামীর। অন্যদিকে নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। শনিবার জামায়াতের এই কর্মসূচিতে সমমনা দলগুলোকে অংশ নিতেও দেখা যায়। তারা পিআর পদ্ধতিতে ভোটসহ জামায়াতের সাত দফা দাবির পক্ষে তাদের একাত্মতা প্রকাশও করেন।
কিন্তু জামায়াতের এই জাতীয় সমাবেশে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি বা শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি দেখা না যাওয়া এ নিয়ে নানা প্রশ্নও দেখা যায়। শনিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে জানান, জামায়াতের এই অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যে কারণে তারা এতে অংশ নেননি।
প্রশ্ন ছিল কেন তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি? জবাবে মি. আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এমনিতেই তাদের একটা অন্যতম দাবি ছিল পিআর পদ্ধতিতে ভোট। আমরা আগেই আমাদের বক্তব্যে এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছি। তারা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য দেবে। আমরা আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য দেবো।”
তিনি আরো বলেন, “তাদের অধিকার আছে আমন্ত্রণ না জানানোর। সে বিষয়ে আমরা কী বলবো?”
বিষয়টি নিয়ে জামায়াত ইসলামীর সাথে যোগাযোগ করা হলে দলটি জানিয়েছে তারা বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের নিজে সালাহউদ্দিন সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেই সাথে তার মাধ্যমেই দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছেও এই আমন্ত্রণ পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে।” “আমন্ত্রণ জানানোর পরও যদি বিএনপি দাবি করে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তাহলে তো আমাদের আর কিছু বলার নেই,” বলেন তিনি।
যা বললেন অন্যান্য দলের নেতারা
জামায়াত আয়োজিত এই সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, “ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে উচ্চকক্ষের জন্য ভোটের অনুপাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যারা উচ্চকক্ষ চাই না বলে বক্তব্য দেয়, তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করে।” তিনি আরও বলেন, “আর যেন ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার জন্ম নিতে না পারে, এজন্য আওয়ামী লীগকে অবিলম্বে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।”
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাশেমী বলেন, “অতীতের কোনো শাসন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।” অতীতের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দল মত নির্বিশেষ এক প্ল্যাটফর্মে এসে আগামী নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় একক প্রার্থী দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সরকারের উদ্দেশে বলেন, “শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না করে আপনারা নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না। নির্বাচনের আগে সমস্ত রাজনৈতিক দল যেন নির্বিঘ্নে যেন প্রচার প্রচারণা করতে পারে নিরপেক্ষ একটি প্রশাসনিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।”
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের বলেন, “এই মুহূর্তে দেশে ইসলামি ঐক্যের প্রয়োজন। আমরা চাই আগামী নির্বাচনকে কেউ জবরদস্তি করে নির্বাচনকে বানচাল করতে না পারে। কেন্দ্র দখল না করতে পারে আমরা চাই সে রকম একটি নির্বাচন। যেনতেন-ভাবে নির্বাচনে এই জাতির মুক্তি আসবে না।”
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মহিউদ্দিন রব্বানী, ইসলামী শক্তিকে ঐক্যবব্ধ থাকার আহবান জানান। পাশাপাশি হেফাজতের নামে দায়ের হওয়া অতীতের মামলাগুলো প্রত্যাহারেরও দাবি জানান।
পিআর পদ্ধতিসহ সাত দফা দাবি নেতাকর্মীদের
ঘোষণা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ ছিল দুপুর দুইটায়। কিন্তু ভোর থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশস্থলে জড়ো হতে শুরু করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। দুপুরের আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়িয়ে শাহবাগ, মৎসভবন টিএসসিসহ আশপাশের এলাকা চারপাশের সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাস, ট্রেন ও লঞ্চে করে আসা নেতাকর্মীরা রাজধানীতে এসে মিছিল সহকারে সমাবেশস্থলে জড়ো হন। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা শোভা পাচ্ছিল। দলীয় মনোগ্রাম সম্বলিত টি-শার্ট,পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন অনেক নেতাকর্মী।
আগামীতে অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানান দলটির নেতাকর্মীরা। এ জন্য নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোরও পরামর্শ দেন তারা। বাগেরহাট থেকে আগত জামায়াত নেতা মঞ্জুরুল হক রাহাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জামায়াত ইসলামীকে পাশ কাটিয়ে কেউ যেন দেশের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারে, আমরা এই বার্তাটি বাংলাদেশ সরকারসহ সব জনগণের কাছে দিতে চাই।” এই সমাবেশ থেকে দলটির অন্যতম দাবি ছিল আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের। যেই দাবিতে বক্তব্য দিতে দেখা যায় কেন্দ্রীয় নেতাদের।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পিআর পদ্ধতি নিয়ে আজ আমরা শুধু না, দুয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। চলমান ভোটে কালো টাকার ব্যবহার হয়, পেশিশক্তির ব্যবহার হয়, মনোনয়ন বাণিজ্য হয়, এ সমস্ত ব্যাপারগুলো থেকে আমরা চাচ্ছি নতুন কিছু”।
পিআর পদ্ধতিতে ভোট ছাড়াও জামায়াতের দাবি ছিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ও অন্যান্য সময় সংঘটিত সব গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্রের সব স্তরে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, ও ভোটের সময় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা। বিবিসি