এনাম আলী এমবিই ছিলেন বৃটেনে কারিশিল্পের পথিকৃৎ

প্রবাসী সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

কারি কিং হিসেবে পরিচিত কারি অস্কার খ্যাত বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলী এমবিই রোববার (১৭ জুলাই ২০২২) ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না- ইলাইহি রা-জিউ-ন। তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে ও ১ মেয়ে সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

এনাম আলী এমবিই বৃটেনে কারিশিল্পের একজন পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে ও বরিস জনসনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বৃটেনের মূল ধারায় একজন প্রভাব বিস্তারকারি ব্যক্তিত্ব।

বিভিন্ন সময় বিবিসি, চানেল ফোর, সিএনএন, আল-জাজিরা সহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তার অভিমত কারি ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে খুবই অর্থবহ এবং সময়ের দাবি পূরণে সহায়ক হয়েছে।

এনাম আলী এমবিই বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সরকারের হসপিটালিটি এডভাইজারি কমিটির সদস্য হিসেবে ৫ বছর সার্ভিস প্রদান করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সময়কাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এসময় কারি ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন নীতিমালা ফেয়ার থাকার ব্যাপারে তিনি সর্বাত্বক ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রস্তাব নিয়ে হাউজ অব কমন্সে জমজমাট বিতর্ক হয়েছে। সাম্প্রতিক বিন্দালু ভিসা চালুর প্রক্রিয়ায়ও তার সরব ভূমিকা অভিবাসী মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

লন্ডন আসার আগে বৃটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যখন লেখালেখি করেছি, তখন মনে হয়েছিল সরেজমিন একটা বিশেষ প্রতিবেদন করা উচিত। সে সময় বৃটিশ অর্থনীতিতে এই ইন্ডাস্ট্রির অবদান ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন পাউন্ড। বর্তমানে কারি ইন্ডাস্ট্রির অবদান ৪.৩ বিলিয়নে (৪,৩০০,০০০,০০০ পাউন্ড) দাড়িয়েছে। অতি সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে হয়তো সামান্য ব্যত্যয় ঘটতে পারে। এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রির সিংহ ভাগের মালিক বৃটিশ বাংলাদেশি। এটা একটা বিশাল ব্যাপার এবং এর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব সহজ বিষয় নয়।

২০০০ সালের ৪ আগস্ট শুক্রবার সাংবাদিক স্টিভ টার্ণার সহ আমরা কয়েকজন বৃকলেন আলাদিন রেষ্টুরেন্টে খাচ্ছি। স্টিভ আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশি ও ইন্ডিয়ান খাবারের তফাৎ জানতে চান। আমি তাকে এই রেষ্টুরেন্ট সহ ইন্ডিয়ান বলতে যে মূলত বাংলাদেশি খাবার, তা বুঝাতে চেষ্টা করি। তখন তার প্রশ্ন ছিল, তাহলে এগুলোর নামে ইন্ডিয়ান যুক্ত কেন?

স্টিভ একজন সাংবাদিক নেতা। বৃটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব জার্নালিস্টস বিএজে’র জেনারেল সেক্রেটারি। যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত ছাড়া তাকে সহজ ভাবে বুঝানো বেশ কষ্টকর ছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।

স্টিভকে বিদায় দিয়ে আমি টেলিফোন করি বৃটেনের কারি কিং খ্যাত এনাম আলী এমবিইকে। তিনি তখন কয়েকজন স্বদেশী নিয়ে ডাইন বাংলাদেশি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছেন। বিষয়টি শুনেই তিনি লুফে নিলেন এবং টেলিফোনে একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। এবষিয়ে তার গভীর ভাবনা ও সিরিয়াসনেস আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরের দিনই আমি তার সাথে বসে কারি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করে আরো প্রাণিত হই।

এনাম আলী এমবিই জানালেন, বিবিসি’র যাস্ট ফর দ্যা জব ডকুমেন্টরি অনুষ্ঠানে জেম্স ওয়েল’র এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তিনি ডাইন বাংলাদেশি ক্যাম্পেইন শুরু করেন। কমিউনিটি নেতা আব্দুল মোহাইমিন মিয়া, আজিজুর রহমান, মৌলা মিয়া, সাইদুর রহমান রেনু, মোহাম্মদ আফসার ওয়েস, ফয়সল চৌধুরী, আনা মিয়া প্রমুখ এই আন্দোলনের সূচনা থেকে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালে কেনারি ওয়ার্ফের বৃটানিয়া হোটেল থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের যাত্রা শুরু হয়।

প্রায় দুই বছর প্রচার তৎপরতা চালিয়ে ১৯৯৪ সালে এটাকে সাংগঠনিক পক্রিয়ায় নিয়ে আসেন। তখন থেকে নাম হয় গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেটার্স। এর জন্মানুষ্ঠানে তৎকালিন ফুড মিনিষ্টার আন্জেলা ব্রাইন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। সেন্ট্রাল লন্ডনের অভিজাত ভেন্যু দ্যা গভর্নর হাউজ পাকলেইন হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্জেলা পুরো বিষয়টি অবহিত হয়ে এর স্বপক্ষে তার অভিমত ব্যক্ত করেন।

বৃটেনে তখন আমাদের প্রায় সকল রেষ্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত ছিল। প্রথম যারা এদেশে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা চালু করেন তারা অখন্ড ভারতের নাগরিক হিসেবে খুব স্বাভাবিক কারণেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নাম দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান হলেও প্রতিষ্ঠিত রেষ্টুরেন্টের নাম বদলের চিন্তা বা সাহস কেউ করেননি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হবার পরও পূর্বের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। ডাইন বাংলাদেশি ক্যাম্পেইন এক্ষেত্রে নব জাগরণের সৃষ্টি করে এবং এনাম আলী হলেন এর প্রাণপুরুষ।

এক সময় বাংলাদেশি কুইজিন হিসেবে নাম বদলের ব্যাপারে গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেটার্সের সরব প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীতে বিলেতের বাংলা মিডিয়া বিশেষ করে ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি ও ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি এবং বিসিএ, বিবিসিসি’র বহুমুখি প্রয়াস উল্লেখের দাবি রাখে। আজকে গর্বের সাথে বলা যায়, এই প্রচার তৎপরতা যথেষ্ট সফল হয়েছে। মূল ধারার মিডিয়া ও বৃটিশ জনগন বাংলাদেশী খাবার সম্পর্কে এখন যথেষ্ট সচেতন।

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার সম্পাদিত মাসিক সময়ে বাংলাদেশি রেষ্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান হয়ে আর কতকাল? শীর্ষক কভার স্টোরি করি। ১৩ ডিসেম্বর বৃটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনপ্রিয় রাজনীতিক রবিন কুক পূর্ব লন্ডন সফরে আসেন। তার সাথে ছিলেন বেথনাল গ্রীণ এন্ড বো আসনের এমপি উনা কিং সহ লেবার পার্টির নেতৃবৃন্দ। এসময় আনুষ্ঠানিক ভাবে মাসিক সময় তাকে প্রদান করলে তিনি শীর্ষ প্রতিবেদন রেষ্টুরেন্ট প্রসঙ্গ অবহিত হয়ে বলেন, ২০০১ সালে চিকেন টিক্কা মাসালাকে বৃটিশ জাতীয় খাবার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য এটা শুনে অনেকেই তখন অবাক হয়েছিল বলেও তিনি জানান।

সেদিন রবিন কুক ডাইন বাংলাদেশি ক্যাম্পেইন ও আমাদের প্রতিবেদনকে খুবই ইতিবাচক বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি সম্ভব হলে বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেষ্টুরেন্ট সমূহের একটি তালিকা তৈরী করে জনসমক্ষে ঘোষনার পরামর্শ দেন। তখন আমাদের প্রকাশিতব্য ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরিতে রেষ্টুরেন্ট সহ বিলেতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দেয়া হয়েছে এবং শীঘ্রই ছাপার কাজ সম্পন্ন হবে বলে তাকে আমি অবহিত করি। অবশ্য আরো পরে ২০০৭ সালে আমি বৃটেনের সকল এশিয়ান রেষ্টুরেন্টের তালিকা, এওয়ার্ড উইনিং রেস্টুরেন্ট সমূহের রিভিউ এবং কারি ইন্ডাস্ট্রির জন্য স্পেশাল রেসিপি সম্বলিত ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরিও প্রকাশ করেছি।

রবিন কুক কর্তৃক এই ঘোষনার পেক্ষাপট বর্ণনা করে কারি কিং এনাম আলী বলেছিলেন, খাবারে কৃত্রিম রঙ না দেয়ার ব্যাপারে সরকারি সহায়তায় ও তার লে রাজ রেষ্টুরেন্টের অংশিদারিত্বে পরিচালিত ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ড প্রমোটিং চলাকালে ২০০১ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক চিকেন টিক্কা মাসালাকে বৃটিশ জাতীয় খাবার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।

এনাম আলী এমবিই বৃটেনের রাজনীতিতে আমাদের কমিউনিটির স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। মার্গারেট থ্যাচারের সময় থেকে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির সাথে সক্রিয় ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামেরনের একজন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাথেও ছিলেন সখ্য। তিনি টেরাকিউ লিমিটেডের উপদেষ্টাদের একজন। প্রতিষ্ঠানটি জাতীসংঘের সাথে কাজ করছে। ইতিপূর্বে তিনি ইউনাইটেড নেশন্সে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট (এডুকেশন) এর সদস্য ছিলেন।

কারি কিং এনাম আলী ২০০৫ সালে বৃটিশ কারি এওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বৃটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রিতে এটাই ছিল প্রথম এবং নতুন প্রজন্মের উপযোগী কারি এওয়ার্ড। করোনা কালের আগে অস্কারখ্যাত বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের ১৫তম রাজকীয় আয়োজন ছিল ২৫ নভেম্বর ২০১৯ তারিখ। বৃটিশ জিনিয়াস সাইটে বাটার্সি পার্কের দৃষ্টিনন্দন ভেনুতে হয়েছে এটি। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড উইনার আয়োজকদের আন্তর্জাতিক মানের পরিকল্পনা মোতাবেক সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। মান ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অনুষ্ঠানস্থলে চলে সপ্তাহব্যাপী রিহার্সেল। এওয়ার্ডের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারিদের না জানিয়ে রেষ্টুরেন্ট সমূহ ঘুরে ঘুরে দেখেছেন জুরি বোর্ডের সদস্যরা। নানারকম নান্দনিকতার মিশেলে সাজানো এসব রেষ্টুরেন্টে খাবার পরিবেশনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, হেল্থ এন্ড সেইফটি ইত্যাদির রকমফের তলিয়ে দেখেছেন তারা।
বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের ফাউন্ডার এনাম আলী এমবিই, তার মেয়ে জেস্টিন আলী ও ছেলে জেফরী আলী একের পর এক আইডিয়া উদ্ভাবন করেন তাদের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নতুনত্ব সৃষ্টির জন্য।

দেড় যুগ ধরে এনাম আলী কারিশিল্পকে একটি অভিজাত শিল্পে পরিণত করার লক্ষ্যে বহুমুখি প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। তাই তাকে বলা হয় আধুনিক কারি শিল্পের অগ্রদূত। আর বৃটিশ কারি এওয়ার্ড এখন অস্কার খ্যাত। রাজকীয় এই অনুষ্ঠান সমূহে বৃটেনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের তিন জন প্রধানমন্ত্রী, মূলধারার সাংবাদিক, খ্যাতিমান ব্যবসায়ী, টিভি ও ফিল্ম ব্যক্তিত্ব, বৃটিশ রাজ পরিবারের সদস্য, পার্লামেন্ট সদস্য এমনকি মন্ত্রীপরিষদ সদস্যরা আগ্রহভরে অংশ গ্রহন করেছেন।

বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০১২তে লন্ডন মেয়র হিসেবে অংশ নিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আজ তা কারি ইন্ড্রাষ্টির জন্য নেয়ামতে পরিনত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের সাথে এনাম আলী এমবিই‘র সংখ্যতা সর্বজন বিদিত। কারি এওয়ার্ডে এসে ডেভিড ক্যামেরুন এতো বড় আয়োজনের অকপট প্রশংসা করে এই এওয়ার্ডকে বলেছেন কারি অস্কার। যৌক্তিক কারণে উপস্থিত সকল বাংলাদেশী এতে গৌরবান্বিত হয়েছেন।

সালোয়ার-কামিজ পরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। ডাচেস অব ইয়র্ক সারাহ ফার্গুসনের হীরা খচিত পাদুকার সাথে একেবারে বাঙালি বধূর সাজে শাড়ি পরে লাল গালিচায় হাটার স্মৃতি দর্শকদের হৃদয়ে রয়েছে অমলিন।

আইটিএন নিউজ প্রডাক্শন এর অনুসন্ধানে সারা বিশ্বে ৪৩৪ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছা বৃটিশ কারি এওয়ার্ডে বৃটেনের সেরা রেস্টুরেন্ট গুলোকে ১১টি রিজিওনে পুরস্কৃত করা হয়। প্রায় 8 ঘণ্টার এ আসরে ছিল বিশ্বমানের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন থিমকে সামনে রেখে অনুষ্ঠান সাজানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল কোরিগ্রাফার জাস্টিন আলীর তত্বাবধানে বিশ্বমানের লাইভ এন্টারটেইনমেন্ট সহ নতুন অনেক কিছু দেখা গেছে প্রতিটি কারি এওয়ার্ডে।

বৃটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স বিবিসিসি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট এনাম আলী এমবিই ১৯৯১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত বিবিসিসি’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের একজন। বাংলাদেশের সাথে বৃটেনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি সহ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বিবিসিসি’র প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বাংলাদেশে ঝাকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এনআরবি দিবস উদযাপন করেছেন। অনুষ্ঠানটি সফল করতে আমি তাকে সার্বিক সহায়তা করেছি।

সিলেটে অনুষ্ঠিত ’এনআরবি গ্লোবাল বিজনেস কনভেনশন ২০১৭ ’ ছিল প্রবাসিদের জন্য একটি মাইল ফলক। ৪৯টি দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশ গ্রহন করেন। সেখানে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসিদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়। দেশের মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ প্রধান, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ গ্রহন করেন। আগত অতিথিরা প্রবাসিদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বাংলাদেশের উন্নয়নে শুধু কথামালা নয়, এনাম আলী এমবিই তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীর সাথে ২০০৬ সালে গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান ‘সিলেট মহিলা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল।’

এনাম আলী এমবিই ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্যে লন্ডন আসেন। তার নিজের ভাষায় শুনা যাক প্রবাসযাত্রা ও সাফল্যের গল্পমালা।

‘লন্ডনে যাপিত জীবন’ নামে বিলেতের স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা আমার একটি গ্রন্থে অনেক কমিউনিটি নেতার জীবন ও কর্ম তুলে ধরা হয়েছে। ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল তারিখে লন্ডনে যাপিত জীবন নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকালে এনাম আলী ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৪ বছর বয়সে পড়াশোনা করতে পাড়ি জমাই লন্ডনে। বুকের ভেতর নাড়ি ছেঁড়ার যন্ত্রণা, চেনা অলিগলি ফেলে আমি কোথায় এলাম! বিলেত এসে তীরহারা নাবিকের দশা হলো। ভিনদেশ, অচেনা পরিবেশ আর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভেবে কাতর। মামা ছিলেন চিকিৎসক, আত্মীয়স্বজনও নেহাত কম নয়। বর্ণমাউথ কলেজ, এখন যেটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়, শর্ত সাপেক্ষে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলাম। তবে মূল কোর্সে যাওয়ার আগে ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হল। এক বছর পর হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হলাম।

এদিকে আয়-রোজগারও দরকার। সপ্তাহে তিন দিন পাঁচ পাউন্ড বেতনে আমার আত্মীয়ের তাজমহল গ্রুপের রেস্তোরায় কাজ শুরু করি। দেশে খেলাধুলা করতাম। ধীরে ধীরে টের পাচ্ছিলাম, ফুটবলের প্রেম থেকে আমি দূরে সরে যাচ্ছি। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় রেস্তোরায় এসে আঁকিবুঁকি করতাম, শিখে আসা বিদ্যা দিয়ে নতুন কিছু করা যায় কি না। ভেতরে নাড়া দেয়, ভালোবাসা বেড়ে যায় যখন দেখি রেস্তোরার গ্রাহকেরা আমার ছোটখাটো সংযোজনে বাহবা দেয়।

এনাম আলী নিজের অগ্রগতি অবলোকন করে মুগ্ধ হন। ফেলে আসা অতীত স্মরণ করে বলেন, রেস্টুরেন্ট বিষয়ে পড়ছি আর আত্মীয়ের রেস্তোরা সাজাচ্ছি। খাবার তালিকার কোনো পদ সংযোজন কিংবা পরিবেশনে নতুনত্ব আনার চেষ্টায় আমার ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। পাবলিক রিলেশন এবং কাস্টমার নেটওয়ার্ক আমাকে নিজস্ব রেষ্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে। আমার প্রথম কন্সেপ্ট ছিল ওয়ার্ড ফ্লায়িং ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল।

মনে আছে, খাবার পরিবেশন বৈচিত্র্যের কারণে সুনাম কুড়াল। এতে আমার আগ্রহ বেড়ে চলে। ১৯৭৮ সালে শেষ হয় স্নাতকের পড়াশোনা। বর্ণমাউথ কলেজ থেকে ১৯৮০ সালে হোটেল ব্যবস্থাপনায় ডিগ্রি নিয়ে বের হই। এরপর ১৯৯০ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টস থেকে ফেলোশিপ অর্জন করি।

ব্যবসায়ীক জীবনের সূচনা ও সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে এনাম আলী বলেন, আমি প্রথম রেষ্টুরেন্ট চালু করি ১৯৭৯ সালে। আর এপসম সারেতে ১৯৮৯ সালে নতুন রেস্তোরা চালু করি ‘লে রাজ রেস্টুরেন্ট’ নামে। সাজসজ্জায় আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল, হয়তো সে কারণেই সবাই সেখানে খাওয়ার জন্য আসতো।

রেস্তোরার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে আরেকটি কারণ, দেশ-বিদেশের নামীদামি সব লোক এখানে খেতে আসতেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী এবং অনেক তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী। জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের পছন্দের তালিকায়ও প্রথম ছিল রেস্তোরাটি। ১৯৯২ সালে বৃটিশ ন্যাশনাল এওয়ার্ড লাভ করার পর এই ধারা আরো গতিশীল হয়।

২০১২ সালের ঘটনা, লন্ডনে তখন অলিম্পিক গেমস চলছে। একমাত্র অফিশিয়াল খাবার সরবরাহকারি হিসেবে মনোনীত হলো লে রাজ রেস্টুরেন্ট। সারা বিশ্ব থেকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা বিভিন্ন দেশ ও খেলোয়াড়দের কাছে বেশ সমাদৃত হয় আমাদের খাবার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই বিলেতের টপ-টেন ‘কারি রেস্টুরেন্ট’ এর মধ্যে স্থান পেয়েছে লে রাজ। মিশেলিন রেটিংয়ে ১৯ বছর ধরে আমরা শীর্ষে অবস্থান করছি।

লে রাজ রেস্টুরেন্টের সাফল্যে বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছি। তবে এটিই শেষ নয়, আরও কিছু কর্মক্ষেত্র আছে আমার। বৃটেনে এমন রেস্তোরা প্রতিষ্ঠার সুবাদে CONFRERIE DE LA CHAINE DES ROTISSEURS এর স্বীকৃতি পাই। এই স্বীকৃতি আমাকে কারি শিল্পে একটা অবস্থানে নিয়ে যায়। কোনো এশীয় রেস্তোরার মধ্যে এমন স্বীকৃতি আমরাই প্রথম লাভ করি।

মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন স্বনামধন্য গণমাধ্যম থেকেও আমন্ত্রণ আসতে শুরু করে। তারা বেশ জোরেশোরেই আমাদের রেস্তোরার প্রচার করে। এই সময়ে বাংলাদেশেও রেস্তোরাটি প্রচার পেয়েছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি খাবারেরও ভাবমূর্তি বাড়তে থাকে। বৃটেনে ভারতীয় রেস্তোরার চেয়ে বাংলাদেশি রেস্তোরায় মানুষের আগ্রহ বাড়তে শুরু করে।কারি ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনত্ব ও বৈচিত্র সৃষ্টির কাহিনী তুলে ধরে কারি কিং এনাম আলী বলেন, রেস্তোরার জনপ্রিয়তা বাড়াতে মাথায় তখন নানা ভাবনা ঘুরপাক খেত। ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি ৫০ থেকে ৬০ জন অতিথি নিয়ে লন্ডন সিটি এয়ারপোর্ট থেকে দুই ঘণ্টার জন্য আকাশে উড়ল ‘লে রাজ এভিয়ন’—বিশ্বের প্রথম উড়ন্ত রেস্টুরেন্ট। সপ্তাহের প্রতি রোববার ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে চিতল মাছের কোপ্তা, কাচ্চি বিরিয়ানি বা এ রকম ব্যতিক্রমী খাবার খেতেন অতিথিরা। বিশ্বের খ্যাতনামা মানুষজন এতে অংশ নিয়ে ছিলেন।
সংবাদ মাধ্যমগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল, জোরেশোরে প্রচার পেল ‘লে রাজ এভিয়ন’ রহস্য। স্কাই টিভি পাঁচ হাজার পাউন্ড দিল তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য। রেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান তার ছবি বিক্রি করতে শুরু করল। ভালো চাহিদা থাকলেও একসময় লে রাজের এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিই।

সেবা ইন্ডাস্ট্রিতে নান্দনিকতা ও কুয়ালিটি সার্ভিস প্রসঙ্গে এনাম আলী এমবিই বলেন, শুধু ক্ষুধার্ত হলেই মানুষ খাবার খায় না, খাবার যদি সুস্বাদু হয়, পরিবেশনা যদি মান সম্পন্ন হয়, তবে এটিও অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে একই কাতারে থাকতে পারে। মানুষ তখন বারবার সেই রেস্তোরায় ফিরে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে তার অতিথি বা প্রিয়জনকে।

প্রকাশনা জগতে আসার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এনাম আলী এমবিই বলেন, রেস্তোরার যখন বেশ রমরমা অবস্থা, এমনই সময়ে ঝুঁকেছিলাম পত্রিকা প্রকাশে। ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে আমার ব্যবসা খাতের সাময়িকী স্পাইস বিজনেস। অল্প দিনের মধ্যে এই ম্যাগাজিন সুধিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারি ইন্ডাস্ট্রিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে স্পাইস বিজনেস একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

এমবিই ও ফ্রিম্যান স্বীকৃতি লাভের অনুভূতি প্রকাশ করে এনাম আলী বলেন, ২০০৮ সালে বৃটেনের রানি হসপিটালিটি শিল্পে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মেম্বার অব দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য বৃটিশ এম্পায়ার’ (এমবিই) পদকে ভূষিত করেন। ২০১১ সালে সিটি অব লন্ডন থেকে ফ্রিম্যান স্বীকৃতি লাভ করি। কাজের ক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করে। কারি শিল্পের উন্নতিতে নিজের সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর এই সব কিছুর পেছনেই আছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের চেষ্টা। এখন বিদেশিরা অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি বাংলাদেশি খাবার বেশ পছন্দ করছে। রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।

২০১১ সালে কাউন্টি কাউন্সিল আমাকে ‘পারসোনালিটি অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকেও ‘এনআরবি পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত করা হয়েছে। ২০০৫ সালে শুরু করি বৃটিশ কারি এওয়ার্ড। পরে এটি কারি অস্কার হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের দেওয়া নাম এটি। কারি এওয়ার্ডের এক অনুষ্ঠানে এসে তিনি বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় এই শিল্পের শুরু হলেও বৃটেনে বেশি বিকশিত হয়েছে। এখন বৃটেনের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ এটি।

বৃটেনের বহুজাতিক সংস্কৃতির মধ্যে নিজেদের অবস্থান সংহত করার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এনাম আলী এমবিই বলেন, বৃটেনে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখানকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। তবে ব্যবসা যে একটি কমিউনিটিকে স্বতন্ত্র পরিচয় এনে দেয়, তা প্রমানিত হয়েছে। এক রকম নীরব বিপ্লবের মাঝে আমরা বদলে দিয়েছি বৃটিশ খাদ্যাভ্যাস। কারি শিল্প বৃটেনে এক বিশাল স্থান দখল করে রেখেছে।

আগে সামর্থ্যবান বাঙালিরা বিদেশি রেস্তোরা খুঁজে নিতেন। এখন বিদেশিরা খোঁজেন বাংলাদেশি রেস্তোরা। তাঁরা অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করতে খাবারের তালিকায় কারি ডিস রাখেন। যুক্তরাজ্যের আনাচকানাচে এখন চিকেন টিক্কা মাসালার জয়জয়কার।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশরা এখন নিজেদের রেস্তোরার নাম বদলাচ্ছেন। স্টার অব ইন্ডিয়া থেকে স্টার অব ব্যঙ্গল, রাজেস্থান থেকে রাজশাহী হয়েছে। নামের সাথে ইন্ডিয়ান রেস্তোরা না লিখে লিখছেন বাংলাদেশি রেস্তোরা। আগে যেখানে বোম্বে, দিল্লী বা তাজমহল নাম হত সেখানে এখন জাফলং, মধুবন, তাল, সোনারগাও, ধানসিড়ি বা হাসন রাজা রাখা হচ্ছে।

শেফ সহ দক্ষ জনশক্তির অভাবে বৃটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রিতে যে অচলাবস্থার সৃস্টি হয়েছিল, শীঘ্রই তার অবসান হতে চলেছে উল্লেখ করে এনাম আলী এমবিই বলেন, গত ২০ বছর ধরে নানা রকম ক্যাম্পেইন পরিচালনার পর বৃটিশ ইমিগ্রেশন নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। লো স্কীল ওয়ার্কারদের কাজের সুযোগ দিতে মাইগ্রেশন এডভাইজারি কমিটি কারি ইন্ডাস্ট্রির অনুকূলে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ বিশ্বের যেকোন জায়গা থেকে বৃটেনে কাজের সুযোগ পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এতে কর্মী সংকটে জর্জরিত বৃটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষ শেফ ও দক্ষ জনশক্তি আনার সুবিধা হয়েছে। এক্ষেত্রে আবারো সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের।
বৃটিশ ইমিগ্রেশন নীতিতে সমঅধিকারের দাবি নিয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছেন, তারা এটাকে নিজেদের প্রচারণার সাফল্য বলেই মনে করছেন। বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলী এমবিই সহ অনেকেই কারি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিকুলে প্রণিত ইমিগ্রেশন আইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। বৃটিশ ইমিগ্রেশন নীতিতে পরিবর্তনের খবরে স্বভাবতই তারা আনন্দিত।

কারি ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম মুখপাত্র এনাম আলী এমবিই বলেন, গত দেড় যুগ ধরে বৈষম্যমূলক ইমিগ্রেশন নীতির বিরুদ্ধে জোর লবিং ও প্রচারণা চালিয়ে আসছি। ২০০৫ সালে বৃটিশ কারি এওয়ার্ড চালু হওয়ার পর এটা গণদাবিতে পরিনত হয়। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে সহ বিভিন্ন স্তরে এই দাবি তুলে ধরেছি। কারি ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ২০১৬ সালে ১০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছিলাম। যেখানে কারি সমস্যা সমাধানের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। বহুদিন পর তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে টেকওয়ে সংযুক্ত রেস্টুরেন্ট সমূহে দক্ষ শেফ আনার সুযোগ সৃষ্টির দাবি ছিল। আমার এই দাবি ডেলিগেশনের সামনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন যথার্থ বলে মেনে নেন এবং পরবর্তীতে অফিসিয়াল চিঠিতে টেকওয়ে রেস্ট্রিকশন সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করার পক্ষে অভিমত প্রদান করেন।

বহুমাত্রিক সাধনা ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এনাম আলী বলেন, বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’কে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম, কারি ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষ জনশক্তি আনার ক্ষেত্রে যে ডাবল স্ট্যান্ডাড নীতিমালা রয়েছে তা পরিবর্তন করতে হবে। তেরেসা মে তখন এই দেশে শেফ গড়ার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরীর পরামর্শ দেন। বৃটিশ মূল ধারা থেকেও বিভিন্ন সময় এধরণের দাবি জানানো হলে আমি লি রাজ একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি। নর্থইস্ট সারে কলেজের সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই একাডেমিতে শুধু শেফ হবার জন্য নতুন প্রজন্মের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। দীর্ঘ প্রতিবেদনে এই বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

ইমিগ্রেশন নীতির বর্তমান পরিবর্তনকে দেড় যুগের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করে এনাম আলী বলেন, আমি খুবই আনন্দিত যে, সরকার আমাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে। সম্প্রতি বিবিসি, আইটিভি ও চ্যানেল ফোর সহ জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবিয়টি অরো বিসৃতভাবে বর্ণনা করেছি।

বৃটেনে রেস্টুরেন্ট সমূহে স্টাফ সংকট সমাধান, কাগজপত্রহীন দক্ষ স্টাফদের বৈধতাদান সহ নানা দাবীতে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের নানা দিক আলোকপাত করে এনাম আলী বলেন, নতুন ইমিগ্রেশন নীতির সুবিধা নিয়ে কারি ইন্ডাস্ট্রি আবারো প্রাণ চঞ্চল হবে, বিকশিত হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনমান। অর্ধশত বছরের ঐতিহ্যবাহী কারি ইন্ডাস্ট্রিতে সৃষ্টি হবে নতুন মাত্রা। সেই সাথে সৃষ্টি হবে লন্ডনে আবারো রেষ্টুরেন্ট শ্রমিক আসার সুযোগ।

ফিরে দেখা অতীতের স্মৃতিচারণ করে এনাম আলী এমবিই বলেন, নিজ দেশের কথা আমি কখনো ভুলিনি। যেকোনো দুর্যোগের মুহূর্তে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। এটি মানবতার খাতিরেই এগিয়ে আসা। এছাড়া বিভিন্ন বৃটিশ সংগঠনেও নিয়মিত সহযোগিতা করে আসছি। বাংলাদেশের দুর্যোগময় মুহূর্তে বিশেষ করে বন্যার্তদের সহায়তায় গত ২৫ বছরে ১.৩ মিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় ১৬ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করেছি যা গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বৃটেনে এনথ্রনী নোলান ট্রাষ্ট, দ্যা ভিকটিমস অব তাইফুন হায়েন, বিবিসি চিলড্রেন ইন নিড এন্ড দ্যা ওয়্যার আর্চার একাডেমি, সাভারে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা এবং বাংলাদেশ ফ্লাড আপিলসহ স্থানীয় ও আন্তজার্তিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনকে সহায়তা প্রদান করেছি।

২০১৮ সালে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ‘আইঅন টিভি’ নামে একটি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করেন এনাম আলী এমবিই । তখন এই টিভির আন্তর্জাতিক মান সৃষ্টির জন্য আমার সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। তার বিশেষ অনুরোধে ২০১৯ সালে আমি (সাঈদ চৌধুরী) আইঅন টিভি’র সাথে যুক্ত হই। দীর্ঘদিন সেখানে মিডিয়া ও বাণিজ্য উভয় দিকের দায়িত্ব পালন করি। একসময় তিনি এই টিভি ছেড়ে দেন। যারা এখন পরিচালক হয়েছেন তারাও মান ধরে রেখে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন।

আইঅন টিভিতে এনাম আলী এমবিইকে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। যদিও লন্ডন আসার আগে থেকেই তিনি আমার পরিচিত। বাংলাদেশের সাথে বৃটেনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি সহ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে ভূমিকা পালন করেছি ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স – বিবিসিসি’র মাধ্যমে। ২০১২ সালে আমি বিবিসিসি’র ডাইরেক্টর নির্বাচিত হই এবং ২০১৩-১৪ সালের নির্বাহী কমিটিতে প্রেস এন্ড পাবলিসিটি ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। তবে অনেক আগে থেকেই সদস্য ছিলাম। বিসিসির উদ্যোগে এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনের সহায়তায় অনুষ্ঠিত এক্সপো বাংলাদেশ ২০০৫ সফল করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি। লন্ডনের অভিজাত ভেন্যু বার্বিকান সেন্টারে ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর তিনদিন ব্যাপী এই বাণিজ্য মেলা ছিল। প্রকাশনা ও ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ছিলাম। মেলাকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য বিশেষ প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছি। ঢাকাস্থ বৃটিশ হাই কমিশন এবং এফবিসিসিআই সহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছি। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব এবং সিলেট প্রেসক্লাবে বিবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে এক্সপো সম্পর্কিত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি। সামগ্রীক আয়োজনে বিশেষ করে মিডিয়া সার্ভিস প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি।

তখন থেকে প্রায়ই নানা বিষয়ে এনাম আলী এমবিই’র সাথে আলোচনা হত। অনেক সেবামূলক কর্মকান্ড একত্রে করেছি। আইন টিভিতে যুক্ত হবার পর আমি ছিলাম তার প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের এডভাইজারের মত। তিনিও আমার সংবাদ প্রতিবেদন এবং গল্প-উপন্যাস সহ সাহিত্যের নিয়মিত পাঠক ছিলেন। সাংবাদিক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েব ও আমি আইঅন অফিসে এমনকি তার বাসাতে বহু আলোচনা ও পরিকল্পনার জন্ম দিয়েছি। তারই অংশ হিসেবে কারিশিল্পে পথিকৃৎ ১০০ ব্যক্তিত্বের অবদান তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এটি সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে। আগামী মাসে এনিয়ে প্রথম আনুষ্ঠিানিক ঘোষনা দেয়ার কথা ছিল। কিন্ত তার আগেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

সেদিন এনাম আলী এমবিই তার জীবনের সাধনার কথা দিয়েই গল্পের শেষ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সকলের সাথে মিলেমিশে জীবনটা কাটাতে চাই। পাশাপাশি কিছু অসাধারণ কর্ম সম্পাদনও করে যেতে চাই।’

হ্যা, তিনি চলে গেছেন। বৃটেনে কারিশিল্পে কিংবদন্তি তুল্য এই পথিকৃৎ অনেক অসাধারণ কাজ করেছেন। একই ভাবে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চির বিদায় নিয়েছেন। দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ইন্তেকালের খবর দেখে এই ভালোবাসা সহজে অনুমেয়।

মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

আরও পড়ুন
কোথাও আগুন লাগলে সতর্কতার জন্য যা করবেন, যা করবেন না
আগুনে পুড়লে মৃত ব্যক্তির মর্যাদা ও আগুন লাগলে যে দোয়া পড়বেন
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মাঙ্কিপক্স; প্রয়োজন সতর্কতা
দেহকে সুস্থ রাখবে অ্যালোভেরা
বসন্তের বাতাসে অ্যালার্জির প্রবণতা, একটু গাফিলতি হলেই মারাত্মক বিপদ
রাসূল সা: প্রবর্তিত খাদ্যবিজ্ঞান । ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যে খাবারে শিশুর উচ্চতা বাড়ে
ইন্ডাস্ট্রির সকলের স্বার্থে কপিরাইটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিঃ ফাহিম ফয়সাল
অতিরিক্ত আবেগ মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি
ওজন কমাতে সাহায্য করে যে সকল খাবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *