এডভোকেট সুলতানুজ্জামান ছিলেন নি:স্বার্থ হিতকামী ।। সাঈদ চৌধুরী

আমেরিকা প্রবাসী সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

চলে গেলেন নি:স্বার্থ হিতকামী এডভোকেট সুলতানুজ্জামান। শুক্রবার (১৪ জুন ২০২৪) স্থানীয় সময় সকাল ৬টায় আমেরিকার মিশিগানে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ’ন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পরিবার নিয়ে প্রবাসে থাকেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার দাওরাই গ্রামে।

সিলেটে শিক্ষার্থীদের জন্য এডভোকেট সুলতানুজ্জামান ছিলেন বিশেষ ধরনের আগ্রহ এবং ভালোবাসার মানুষ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এমন হিতকামী ভাবনা সত্যিই বিরল। শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে তাঁর অনুরাগ ছিল ঈর্ষণীয়। নৈতিকতার চর্চা আছে এমন কাউকে পেলে ভীষণ খুশি হতেন। কীভাবে সহায়তা করলে বড় মানুষ হবে, তা নিয়ে ভাবতেন। আপন সন্তানের মতো তাদের ভালোবাসতেন। কত শত ছাত্র তার মমতা পেয়েছেন, সে হিসাব রাখা সহজ ছিলনা।

ব্যক্তিগতভাবে এডভোকেট সুলতানুজ্জামানের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। সিলেটের সাহিত্য অঙ্গনে আলোকিত লেখক ও সংগঠক আমাদের প্রিয় মালেকা আপার (ডা. মালেকা বেগম) স্বামী হিসেবে সম্পর্কের সূচনা। এক সময় সখ্য থেকে নিবিড় সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। সাদা মনের এই মানুষটি পেশাগত ভাবে আইনজীবী হলেও সার্বক্ষণিক ধর্ম চর্চা করতেন। সত্যের সন্ধান ও স্রষ্টার দর্শন তাঁর মনোকামনা ছিল।

জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক আর অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে খুব কৌতুহলি ছিলেন এডভোকেট সুলতানুজ্জামান। জ্যোৎস্নার আলোয় ভ্রমণ করতেন। প্রকৃত সত্যকে জানবার জন্যে ছিলেন উদগ্রীব। দেখা হলেই এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিল। আকাশ ও পৃথিবীর নয়নাভিরাম দৃশ্য থেকে মহান মাবুদকে অনুসন্ধান করতেন। আল কুরআন সব সময় অধ্যয়ন করতেন। সুরা আল-হজ্জের ৪৬ নম্বর আয়াত নিয়ে গবেষণা করতেন। যেখানে আল্লাহ বলেছেন- ‘তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তি সম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বুকের মধ্যে অবস্থিত হৃদয়’। তারপর সহজ ভাবে বিশ্লষণ করতেন সুরা আল-আনআমের ৬ষ্ঠ আয়াত। এতে আল্লাহ বলেছেন- ‘কোন মানব-দৃষ্টি তাঁকে দেখতে পারেনা, অথচ তিনি সকল কিছুই দেখতে পান এবং তিনি অতীব সূক্ষ্মদর্শী এবং সর্ব বিষয়ে ওয়াকিফহাল’।

যুগপৎ বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর ও মাঠের মানুষ এডভোকেট সুলতানুজ্জামানের অমূল্য স্মৃতি লিখলে একটা গ্রন্থ রচনা করতে হবে। ১৯৮৯ সালের কথা, আমি তখন দৈনিক সংগ্রামের সিলেট প্রতিনিধি। তারপর সিলেট বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এক সময় সারা দেশকে ৫টি জোনে ভাগ করে সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তখন যে কয়জন অগ্রসর মানুষ আমাকে উৎসাহ দিতেন তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৯০ সালে ৮ অক্টোবর সিলেট নগরির কুদরত উল্লাহ মার্কেটে আমাদের অফিস নেয়া হল। সংগ্রাম পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান, সম্পাদক আবুল আসাদ, জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল ওয়াদুদ খান ও চীফ একাউন্টেন্ট আব্দুস সাত্তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের উল্লেখযোগ্য সিনিয়র সাংবাদিক এতে অংশ গ্রহন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানের জন্য অনেক খাবার এবং বেশ কিছু আইনজীবী নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন।

আমি তখন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ি। একদিন ক্লাস শেষে চৌহাট্টা মোড়ে বন্ধুদের নিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ তার সাথে দেখা। কিছুটা জোর করে আমাকে বাসায় (দরগা মহল্লা পায়রা ৮৬) নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম এক এলাহী কান্ড। অনেক শিক্ষার্থী তার বাসায় থাকেন। সবাকে খাবার দিলেন। আমাকেও খাওয়ালেন। এমন নি:স্বার্থ হিতকামী মানুষটি দ্রুত আমার হৃদয় জয় করে নিলেন। তিনি জানতেন সৎ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জে। লুকিয়ে রাখা এবং চাপা পড়া সত্যকে আবিষ্কার বা উম্মোচন করতে পারা যে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, তা তিনি বুঝতেন। এ কারণেই হয়ত দারুণ ভালোবাসতেন। আমার কাজে প্রেরণা সঞ্চার করতেন।

আশি ও নব্বই দশকে সিলেটের সাংবাদিকতায় আমরা একঝাক প্রশিক্ষিত উদ্যমী সংবাদকর্মী ছিলাম। জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন খবর প্রদানে আমাদের এক ধরণের প্রতিযোগিতা ছিল। আমি তখন স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদেও জড়িত ছিলাম। ১৯৯৩-৯৪ সালে সিলেট প্রেস ক্লাবের নির্বাহী পরিষদে যুক্ত হই। ক্লাবের মিটিংয়ে গেলে পার্শ্ববর্তী এলাকা পায়রা ৮৬তে তাঁর সাথে প্রায়ই মিলিত হতাম। যে কোন বিষয়ে সুগভীর পর্যবেক্ষণ ও যথার্থ সুরহা পাওয়া যেত। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার রূপ-রূপান্তর, দ্বন্দ্ব ও বিকাশের চালচিত্র বাতলে দিতেন।

এডভোকেট সুলতানুজ্জামান ছিলেন চিরতরুণ, উদ্যমী এবং সমাজহিতৈষী কর্মবীর। এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করতাম, যথেষ্ট সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোন রকম বিলাসিতা করতেন না। তাঁর সন্তানেরাও একই রকম। বড় ছেলে আমেরিকার মিশিগান ওয়ারেন সিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ রুহুল হুদা মুবিন ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর শুক্রবার ইন্তেকাল করেছেন। শিক্ষা জীবনে মুবিন দীর্ঘদিন লন্ডন ছিলেন। তখন আমাদের সংবাদ সংস্থা মিডিয়া মহলের টিম মেম্বার হিসেবে নির্ভরতার প্রতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। দূরদৃষ্টি, গতিশীলতা আর সাহসের সমন্বয়ে মুবিন আপন সুষমায় নিজকে সুশোভিত করেছিলেন। মিডিয়া মহলে কর্মকালীন সময়ে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও বিভিন্ন মিডিয়া হাউজে যথাসময়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার সক্ষমতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সংবাদ সংস্থা ‘মিডিয়া মহল’। লন্ডন মুসলিম সেন্টার (এলএমসি) বিজনেস উইংয়ে মিডিয়া মহলের অফিস ছিল। কমিউনিটি মিডিয়া সার্ভিস-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে সেখান থেকে। ২০০৩ সালে আমার সম্পাদনায় মিডিয়া মহল থেকে প্রকাশিত হয় ব্রিটেনে বাংলাদেশী ব্যবসা বিষয়ক তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ গাইড ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’। ২০০৪ সালে আরো সমৃদ্ধ কলেবরে ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’ প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের সকল এশিয়ান রেস্টুরেন্ট নিয়ে আমার সম্পাদিত ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি। ২০১০ সালে আমার সবচেয়ে ফ্লাগশিপ প্রকাশনা ছিল ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা-ওআইসি’র ৫৭টি দেশের তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ ডাইরেক্টরি ‘মুসলিম ইনডেক্স’। আমাদের এই ডাইরেক্টরিসমূহ আজো বিলেতে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে এক অপরিহার্য অনুসঙ্গ।

মিডিয়া মহলের প্রথম প্রকাশনা হিসেবে ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’তে সবচেয়ে বেশি শ্রম ও মেধা দিতে হয়েছে। এতে অনেকে কাজ করেছেন। তাদের সাথে প্রিন্টার্স লাইনে রুহুল হুদার নামও প্রকাশিত হয়েছে। শুধু আমার প্রতি নয়, মিডিয়া মহল ও আমাদের কাস্টমারদের প্রতি অনুপম ভালোবাসার জন্য তাকে একাধিকবার পুরস্কৃত করেছি। দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস ও বিবিসি-সহ মূলধারার গণমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে নিপুণতার সঙ্গে প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে তাকে হাতে কলমে ট্রেনিং দিয়েছি। মুবিন অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে সংবাদ সংস্থার কাজ হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন এবং টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে আমরা কমিউনিটির মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বাসা জোগাড় করা, চাকরির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজে আমার সহায়ক শক্তি হিসেবে তার ওপর নির্ভর করেছি।

পড়ালেখা, চাকরি ও সমাজসেবায় দৃঢ়তা, অধ্যবসায় ও অঙ্গীকারের মাধ্যমে রুহুল হুদা মুবিন একজন স্বপ্নচারী তরুণ সংগঠক হিসেবে অন্যদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে সাদাসিধে জীবনের অধিকারী অথচ বহুমাত্রিক গুণের সমাহারে চৌকস এই তুরণের মৃত্যুর খবরে চোখের জল আটকাতে পারিনি। স্বচ্ছতা, বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার মাধ্যমে রুহুল হুদা মুবিন আমার অতিপ্রিয় এক মানুষে পরিনত হয়েছিলেন। বিলেতে অধ্যয়ন শেষে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাবা-মার কাছে আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও বিভিন্ন সময় যোগাযোগ হয়েছে। মাঝখানে একবার আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তখন তার ছোট ভাই আরেক মেধাবী চৌকস তরুণ রুহুল আখলাক শাহীও সাথে ছিল।

তারও আগে মুবিন আমার সাথে শিক্ষকতা করেছেন। সিলেটে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও চলমান বাস্তবতা নিয়ে একটি রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে আমি ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষায়তন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমার শিক্ষা কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি অবহিত হয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন শহরের জিন্দাবাজার কাজী ম্যানশন মার্কেটের সত্ত্বাধিকারি ও এপেক্স বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কাজী এনাম উদ্দিন আহমদ। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কয়সর জাহান-সহ আরো কয়েকজনকে সাথে রাখার অনুরোধ করেন। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের আরো ক’জন বন্ধুও সম্পৃক্ত হন। প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস)। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের পাঠানটুলায় নিজস্ব জায়গায় কলেজে উন্নীত হয়েছে।

এভাবে এডভোকেট সুলতানুজ্জামানের পরিবারের সাথে আমি ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ডা. মালেকা বেগম, দ্বিতীয় ছেলে রুহুল আখলাক শাহী ও ছোট দুই ছেলে জাকির ও শাকির-সহ অনেকগুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মরহুমের নামাজে জানাজা আরাফাতের দিন শনিবার বাদ জোহর ডেট্রয়েট আল ফালাহ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। প্রিয় পুত্র রুহুল হুদা মুবিনের পাশে তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে। মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।

* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *