উর্দু সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ মুহাম্মদ হোসাইন আজাদ । আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম শহীদ সাংবাদিক মৌলভি মুহাম্মদ বকর, যাকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পরপরই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। তিনি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমর্থক ছিলেন এবং তাঁর সম্পাদিত ‘দিল্লি উর্দু আখবার’ এ দেশীয় সিপাহিদের বিদ্রোহে ইন্ধন জোগানো হতো বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁর পুত্র মোহাম্মদ হোসাইন আজাদ (১৮৩০-১৯১০), যিনি পরবর্তী সময়ে উর্দু ভাষার খ্যাতিমান পণ্ডিতে পরিণত হয়েছিলেন, তিনি পিতার পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি দিল্লি কলেজের ওরিয়েন্টাল বিভাগে ভর্তি হয়ে সিপাহি বিদ্রোহের তিন বছর আগে ১৮৫৪ সালে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। সিপাহি বিদ্রোহের পর তাঁর পরিবারের ওপর আরও জুলুম নেমে আসতে পারে আশঙ্কা করে মুহাম্মদ আজাদ প্রথমে লক্ষেèী যান এবং সেখান থেকে ১৮৬১ সালে লাহোরে চলে যান এবং সেখানে ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লাহোর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে শিক্ষকতা করেন। এসময় তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘আঞ্জমান-ই-পাঞ্জাব’, যে প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক। যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮৫৭ সালে ১৮৫৭ সালে মৌলভি আবু বকরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, ত্রিশ বছর পর ১৮৮৭ সালে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ হোসাইন আজাদকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ “শামস-উল-উলামা” (শিক্ষিতদের সূর্য) খেতাবে ভূষিত করে।

উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে মুহাম্মদ হোসাইন আজাদ আজও এক প্রবাদ-পুরুষ। তিনি শুধু সাহিত্যের ইতিহাস রচনা ও সমালোচনার নতুন সীমারেখাই টেনে দেননি, এবং আধুনিক উর্দু গদ্যের ধাঁচের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং উর্দু ‘নজম’ (বর্ণনামূলক কবিতা) এর জন্ম ও বিকাশে অবদান রেখেছেন, যা এতদিন পর্যন্ত প্রচলিত আঙ্গিকে রোমান্টিক ভাবনা প্রকাশের উপায় হিসেবে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার মধ্যে ছিল। এছাড়াও তিনি কবিদের জন্যও রীতি ও শর্ত নির্ধারণ করেছিলেন যে তারা নিজেদের ভাব প্রকাশ করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে কবিতা রচনা করবেন এবং উন্মুক্ত মুশায়রায় তা আবৃত্তি করবেন, যাতে তাদের কবিতা সাধারণভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের আরেক দিকপাল আলতাফ হোসেন হালির (১৮৩৭-১৯১৪) সঙ্গে মিলে মুহাম্মদ আজাদ ‘সহজাত কবিতা’র আন্দোলনের সূচনা করেন, যে আন্দোলনের উদ্দেশ ছিল প্রচলিত উর্দু কবিতার সংস্কার সাধন। তিনি বলতেন, “কবিতার লক্ষ্য হতে হবে যাতে আমরা যেভাবে প্রকাশ করি, তা শ্রোতাদের হৃদয়ে একই ধরনের আবেগ, একই ধরনের আলোড়ন ও একই ধরনের উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। তিনি প্রচলিত উর্দু কবিতার নান্দনিকতাকে নাকচ করেন, যা তাঁর কাছে মনে হয়েছে কৃত্রিম এবং ‘শব্দের খেলা’ এবং এ কারণে এসব কবিতা প্রকৃত আবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। উর্দু সাহিত্যের একটি সহজ ও বাস্তবধর্মী রূপরেখা স্থির করার লক্ষ্যে আলতাফ হোসেন হালি ও মুহাম্মদ হোসাইন আজাদের এ উদ্যোগকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) উৎসাহিত করেন ও সমর্থন দেন।

উর্দু ভাষার উৎপত্তি নিয়েও তিনি স্মৃতি জাগ্রত করার তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যে উর্দুর ভাষার বিকাশের উৎস ছিল ব্রজ ভাষা এবং ধীরে ধীরে উর্দু নিজস্ব সুনির্দিষ্ট পরিচয় অর্জন করে। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালীর করার ক্ষেত্রে অন্যান্য উৎস, বিশেষ করে ইংরেজি উৎসের ওপরও আলোকপাত করেছেন। মুহাম্মদ হোসাইন আজাদ উর্দু সাহিত্যকে যে ব্যাপকতায় সমৃদ্ধ করেছেন, তার মতো আর কেউ করেননি বলে দাবী করা হয়। তাঁর রচিত ‘সুখান দান-এ-ফারাস,’ ‘কাসাস-এ-হিন্দ,’ ‘দরবার-এ-আকবরী,’ ‘নিগারিস্তান-এ-ফারাস,’ ‘দিওয়ান-এ-জওক এবং ‘নইরং-এ-খেয়াল’ উর্দু সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ১৮৮০ সালে প্রকাশিত তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘আব-এ-হায়াত’ বহুল পঠিত একটি গ্রন্থ, যা একাধারে উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস, তাঁর স্মৃতিচারণের সমন্বয়। তবে অনেকের কাছে মুহাম্মদ আজাদ তাঁর এই গ্রন্থের কারণে বিতর্কের উর্ধে নন। তবে তাঁর আকর্ষণীয় গদ্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।

মুহাম্মদ হুসাইন আজাদ এক ব্যতিক্রমী গ্রন্থপ্রেমিক ছিলেন এবং আগ্রহী গ্রন্থ সংগ্রাহক ছিলেন। গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতে তিনি তার জীবনের সকল সঞ্চয় ব্যয় করেছেন এবং তাঁর সংগ্রহে বিপুল সংখ্যক দুর্লভ গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি ছিল। জনগণের জন্য তিনি তার গ্রন্থাগার খুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সংগ্রহের উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি হয়ে যায়। প্রথমে তিনি মধ্য এশিয়া ভ্রমণে যান এবং বহুসংখ্যক বই নিয়ে ফিরে আসেন। এরপর তিনি কলকাতায় যান এবং সেখান থেকে প্রচুর বই সংগ্রহ করেন। ১৮৮৫ সালে তিনি ইরানে যান এবং ওই সময়ের হিসেবে দশ হাজার রুপির বই কেনেন। তিনি লাহোরে যে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটি ১৮৯০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে লাইব্রেরির অধিকাংশ বই চুরি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তাঁর পুত্র লাইব্রেরি বন্ধ করে দেন। মুহাম্মদ হোসাইন আজাদ ১৯১০ সালে ইন্তেকাল করেন। তার সংগৃহীত গ্রন্থের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যেগুলো পরিবারের কাছে ছিল, সেগুলো তাঁর নাতি ১,৮১৬টি গ্রন্থ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হয়।

লেখকঃ উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *